শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্ররাজনীতি এখন আতঙ্কের নাম। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে দেশব্যাপী।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (রুয়েট) বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নামে নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার বদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কমেনি ছাত্র নির্যাতন। যখন যে সংগঠন ক্ষমতায় এসেছে, তারাই শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। নির্যাতনে খুন, হাত-পা হারানো ও মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে।
বিভিন্ন সময়ে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতায় থাকা ছাত্র সংগঠগুলোর নেতা-কর্মীরা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাধারণ শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও কর্মচারীদের মারধর, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, ছাত্রী উত্ত্যক্ত, সিট বাণিজ্য, হলগুলোতে ‘পলিটিক্যাল ব্লক’ তৈরি করাসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িয়েছেন। গত চার দশকে রাবি ও রুয়েটে কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে খুন হয়েছেন ৩৬ জন শিক্ষার্থী।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর মামলা হলেও উদঘাটন হয়নি কোনো খুনের রহস্য। হয়নি মামলার নিষ্পত্তি। ফলে ছাত্র সংগঠন দ্বারা ক্যাম্পাসে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এছাড়া, গত তিন বছরে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্ররাজনীতি তার গৌরব হারিয়ে পথভ্রষ্ট হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে অসংখ্য বার সাধারণ শিক্ষার্থীরা খুন-নির্যাতনের শিকার হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এতে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার মনোনীত প্রশাসন থাকায় তারা ছাত্র সংগঠনের অপকর্মগুলো এড়িয়ে যান। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমান্তরালে অবস্থান করে ছাত্র সংগঠনগুলো। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্ররাজনীতি।
রাবির রাকসু আন্দোলন মঞ্চের সমন্বয়ক আব্দুল মজিদ অন্তর বাংলানিউজকে বলেন, ছাত্ররাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষা করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার তাদের পক্ষের লোকদেরই দায়িত্ব দেয়। ফলে ক্ষমতাসীন সরকারের লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। তারা সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের একক আধিপত্য ধরে রাখতে চেষ্টা করে। ফলে কেউ বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করলে ছাত্র সংগঠন ও প্রশাসন এক হয়ে যায়। এতে ছাত্ররাজনীতির সম্পর্কে মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
রাবির ফোকলোর বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কাজ করতে পারেন না। দেশের মূল রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরও কোনো স্বাধীনতা নেই। তাকে সরকারের স্বার্থ বা অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়ন করে চলতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ও ছাত্রদের সুবিধা নিয়ে শিক্ষক রাজনীতির কাজ করা উচিত ছিল। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বার্থের চেয়ে রাজনৈতিক ধারাকে খুশি করার বিষয়টি শিক্ষক রাজনীতিতে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
জানতে চাইলে রুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম শেখ বলেন, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা ঘটেছে। তবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিবার। এখানে সবাইকে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। ছাত্র নির্যাতনের মতো কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা আলোচনা করে মীমাংসা করি।
রাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কর্তৃত্বের আওতায় চলে গেলে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়। আমরা চেষ্টা করছি যেন ছাত্র সংগঠন দ্বারা সাধারণ শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের শিকার না হয়। কেউ যেন উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ড ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৯
এসএস/এএ