রোববার (৭ জানুয়ারি) তাবলিগ জামায়াতের কানাডা শুরার সদস্য আবির রশিদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, টঙ্গী ইজতেমায় নিজামউদ্দিন মারকাজের মাওলানা মোহাম্মদ সাদের অংশগ্রহণ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে আমরা জেনেছি।
‘দিল্লির নিজামউদ্দিন মসজিদ থেকে শতবর্ষ আগে তাবলিগ জামাতের এই যাত্রা ও প্রসারের ক্ষেত্রে মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াস (রহ.)-এর অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও দোয়ার কথা বিশ্ববাসী জানে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, টঙ্গীর ইজতেমা কেবল লাখো মুসল্লির জমায়েতই নয়, এটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবীণ নীতি-নির্ধারকদের মিলনমেলাও, যারা বিশ্বের আনাচে-কানাচে মানুষের শান্তি ও কল্যাণের স্বার্থে কাজ করেন।
কানাডা শুরার পক্ষ থেকে বলা হয়, পুরো তাবলিগের ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, টঙ্গীসহ এ ধরনের ইজতেমার দায়িত্বভার নিজামউদ্দিন মারকাজের উত্তরসূরিদের ওপরই থাকছে, যেটা ক’বছর ধরে অত্যন্ত সুচারুভাবে পালন করে আসছেন মাওলানা মোহাম্মদ সাদ।
‘তারই ধারাবাহিকতায় কিছু লোক তার বিরোধিতা করলেও সারাবিশ্বের মুসলিম উম্মাহর মতো কানাডার শুরাও কেবল নিজামউদ্দিন মারকাজের উত্তরসূরি হিসেবে মাওলানা সাদকে আমির ও ফয়সাল হিসেবে গ্রহণ করবে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ শুরা যদি অতীতের রেওয়াজ ভেঙে নিজামউদ্দিন মারকাজের উত্তরসূরিকে দায়িত্বভার থেকে সরিয়ে দেয়, তাহলে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে, আর সেটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই। এমন কিছু হলে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা চিরতরে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ২০১৮ সালকে বিশ্ববাসী মনে রাখবে। ’
একই দিন শুরা মালয়েশিয়ার চিঠি শুরা বাংলাদেশের পাশাপাশি পাঠানো হয়েছে সরকার ও উলামা কাউন্সিলের কাছে।
আবদুল্লাহ চেওংয়ের স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়েছে, নিজামউদ্দিন মারকাজের মাধ্যমেই বিশ্বে তাবলিগ জামায়াতের সৃষ্টি ও প্রসার। সে কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত টঙ্গী ইজতেমায় তারই উত্তরসূরিকে আমির ও ফয়সালের দায়িত্ব দিতে হবে। যদি আয়োজকেরা অতীতের এই রেওয়াজ বজায় রাখতে ব্যর্থ হন, তবে বাংলাদেশের পরিবর্তে মালয়েশিয়ায় এ ইজতেমা আয়োজনে প্রস্তুত শুরা মালয়েশিয়া। ’
সবশেষ সোমবার (৮ জানুয়ারি) শুরা বাংলাদেশ, সরকার ও উলামা কাউন্সিলকে ইন্দোনেশিয়া শুরার পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ইজতেমার দায়িত্বভার নিয়ে কিছু আলাপ ও জটিলতার বিষয়ে আমরা জেনেছি। আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই, বরাবরের মতোই নিজামউদ্দিনের উত্তরসূরিদের নেতৃত্বে বিশ্ব ইজতেমা পালন হওয়া উচিত।
‘যদি অতীতের রেওয়াজ ভেঙে এই দায়িত্বভারে পরিবর্তন আসে, তবে বিভ্রান্তি তৈরি হবে এবং পুরো মুসলিম বিশ্বের ঐক্য বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যেতে পারে। সেজন্য ইন্দোনেশিয়া শুরা কেবল মাওলানা সাদকেই টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার ফয়সাল হিসেবে গ্রহণ করবে। ’
তাবলিগ জামাতের অন্যতম শীর্ষ মুরুব্বি, দিল্লি নিজামুদ্দিনের জিম্মাদার মাওলানা সাদের কিছু বক্তব্য ও একক নেতৃত্বের প্রশ্নে বেশ কয়েক বছর যাবৎ আলেম-উলামা ও তাবলিগের মুরুব্বিদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
এর প্রেক্ষিতে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাওলানা সাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, আর নিজামুদ্দিন ছেড়ে চলে যান মাওলানা ইবরাহিম দেওলাসহ বেশ কয়েকজন মুরুব্বি। বিশ্বব্যাপী তাবলিগের বিভিন্ন মারকাজগুলোও দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে তাবলিগের মারকাজ কাকরাইলও দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। কেউ মাওলানা সাদের একক নেতৃত্বের প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা প্রকাশ করছেন, কেউ বিরোধিতা করছেন। বিরোধীপক্ষের দাবি, মাওলানা সাদকে তার বিতর্কিত বক্তব্যের বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করে তওবা করতে হবে। আর নেতৃত্ব একক নয়, শুরাভিত্তিক হতে হবে। যেভাবে তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মৃত্যুর পর শুরাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় তাবলিগ চলে এসেছে, সেভাবে চলবে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আলেম-উলামারা উদ্যোগ নেন ভারতের নিজামুদ্দিনের মুরুব্বিদের দ্বন্দ্ব নিরসনের। এর অংশ হিসেবে কাকরাইলের মুরুব্বি ও আলেম-উলামাদের একটি দল ভারত সফর করে চেষ্টা করেন নিজামুদ্দিনের দু’পক্ষের মধ্যে বিবাদ মেটানোর। কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হন।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব ইজতেমাকে সামনে রেখে রোববার (৭ জানুয়ারি) ঢাকায় যাত্রাবাড়ীর জামিয়া মাদানিয়ায় উলামায়ে কেরাম, কাকরাইলের শুরার উপদেষ্টা, সদস্য ও ভারত সফরকারী প্রতিনিধি দলের সদস্যদের উপস্থিতিতে বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কাকরাইলের শুরার উপদেষ্টা কমিটির যোগাযোগ ও সমন্বয়ের জিম্মাদার, গুলশান আজাদ মসজিদের খতিব মাওলানা মাহমূদুল হাসান।
বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ছিল- এবারের বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা মোহাম্মাদ সাদের আসা না-আসা প্রসঙ্গ। ইজতেমায় মাওলানা সাদের আসা না আসা বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত আসার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয়, এবারের বিশ্ব ইজতেমায় নিজামুদ্দিনের ভেতরের ও বাইরের উভয়পক্ষের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। বিবাদমান গ্রুপের নেতাদের কেউ অংশ নেবেন না।
বৈঠকে উপস্থিত ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন এবারের ইজতেমায় মাওলানা সাদের না আসার পক্ষে মত দেন। তারা হলেন- বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলী, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহাদ্দিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, তাবলিগের শুরা সদস্য মাওলানা মোহাম্মাদ যোবায়ের, মাওলানা মুহাম্মাদ হোসাইন ও মাওলানা ফারুক, বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, আল্লামা আহমদ শফির প্রতিনিধি মাওলানা আনাস মাদানি, তাবলিগের শুরা সদস্য মাওলানা উমর ফারুক ও মাওলানা রবিউল হক, শাইখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মাওলানা মিজানুর রহমান সাঈদ, হাটহাজারী মাদরাসার মুফতি কেফায়াতুল্লাহ, আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের প্রতিনিধি মাওলানা মুফতি মোহাম্মাদ আলী, ভারত সফরকারী প্রতিনিধি দলের সদস্য মুফতি মাহফুজুল হক।
তারা নিজামুদ্দিন মারকাজের মুরুব্বি মাওলানা মোহাম্মাদ সাদ ও মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ এবং নিজামুদ্দিন ছেড়ে চলে যাওয়া মাওলানা ইবরাহিম দেওলা ও মাওলানা আহমাদ লাটের পরিবর্তে তাদের প্রতিনিধি আসার পক্ষে মতামত দেন।
অপরদিকে ৭ জন মাওলানা সাদের আসার পক্ষে মত দেন। তারা হলেন- তাবলিগের শুরার সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, মাওলানা আবদুল হামিদ মাসুম, মুহাম্মাদ খান শাহাবুদ্দিন নাসিম, মাওলানা জিয়া বিন কাসেম, ইউনুস শিকদার, মাওলানা মোশাররফ হোসাইন ও আনওয়ার হোসাইন।
আলেমদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের হাতে হস্তান্তর করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৮
এমএইউ/এইচএ/এএ