নীল বাদরের ইতিহাস যেন বিড়ি হয়ে ফিরে এসেছে সেই রংপুরে! যেই রংপুর নীল বিদ্রোহের অন্য নাম।
জেলা শহর থেকে ১১-১২ কিলোমিটার দূরত্বের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌরসভা।
‘অলাভজনক’ হওয়ায় বন্ধের পথ ধরেও সাবলীলভাবে এখনও এখানে বড় বড় কয়েকটি বিড়ি কারখানা টিকে আছে। এছাড়া ঘরে ঘরে ছোট-খাটো ইউনিটেও থেমে নেই উৎপাদন।
কেবলমাত্র শুল্ক বৈষম্যকেই উৎপাদনের পথে হুমকি মনে করছেন এখানকার শ্রমিকরা। ফলে এক একটি কারখানা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন বেকার হচ্ছেন গ্রামীণ জনপদের এই মানুষগুলো, ঠিক তেমনি ধুঁকতে থাকা কারখানায় রোজ কাজ না থাকায় আয়-উন্নতি থেকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছেন আরও অনেকে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশীয় বিড়ি শিল্পের ওপর আরোপিত শুল্ক ১১০ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে। এতে নিম্নমানের ১০ শলাকার প্যাকেটের সর্বনিম্ন দাম ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব এসেছে।
বাজেটের এমন খড়গ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বাজার ধ্বংস করে বিদেশি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে পক্ষপাতমূলক বলে অভিযোগ এ শিল্প সংশ্লিষ্টদের।
সরেজমিনে হারাগাছে গিয়ে একের পর এক বিড়ি কারখানা চোখে পড়লেও বন্ধ অধিকাংশ। শ্রমিকরা জানান, মূল্য বৃদ্ধিতে সপ্তাহে কেবল দু-তিনদিন কাজ হয়।
স্থানীয় মায়া বাজারে মায়া বিড়ি ফ্যাক্টরি খোলা পাওয়া গেলেও প্রবেশে বাধা দিলেন লাভলু। বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া এই মধ্য বয়সী ব্যক্তি শ্রমিকদের তদারকি করেন। বিড়ি শিল্পের বর্তমান অবস্থার কথা জানতে চাইলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, ভেতরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা না খেয়ে মরছি আর আপনারা (সাংবাদিক) ছবি তুলে রঙ্গ করবেন, তা হবে না। সরকার বা অর্থমন্ত্রী আমাদের কথা ভাবে না, আর আমরা হলাম মানুষ! নাগরিক!’
বিকল্প কাজ দিলে বিড়ি তৈরি ছাড়বেন জানিয়ে লাভলু বলেন, ‘এর মতো অস্বাস্থ্যকর কাজ কে করতে চায়! দিনে দিনে এতো ট্যাক্স না বাড়িয়ে এ শিল্প থেকে শ্রমিকরা যেন অন্য কোনো কাজে-পেশায় যেতে পারেন, বাজেটে সেই প্রস্তাবনা আনুন। এখনও সময় আছে বর্ধিত প্রস্তাব উঠিয়ে নিন। বড়লোকদের পকেট ভারি করতে গরিবের রক্ত আর নিয়েন না। আমাদের না হয় জীবন শেষই, কিন্তু ছেলে-মেয়েদের তো মানুষ করতে হবে’।
বছর খানেক আগেও ছিলেন শ্রমিক, এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। পেশা পরিবর্তন করে জীবনকে সঠিক পথে এনেছেন বলে মত আমজুল হোসেনের (৩৭)। আগে সপ্তাহে তিন-চার দিন কাজ করলে দিনপ্রতি ২৫০ টাকা করে আসতো। যা মাসে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা। স্বল্প এই অর্থে পরিবার চালানো, সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যয় বহন সম্পূর্ণ অসম্ভবই ছিল।
গরিবের পণ্য বিড়ি তাদের আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি তামাক পণ্য। এর ওপর শুল্ক বাড়ালেও ব্যবহার কোনোভাবেই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন শ্রমিকসহ গ্রামের কৃষক, ভ্যান চালক ও দিনমজুররা।
পৌর এলাকার আনসার বিড়ি কারখানার শ্রমিক সেলিম, মাহফুজসহ আশেপাশে জড়ো হওয়া শ্রমিকরা বলেন, ‘হারাগাছের তিন ভাগ বিড়ি শ্রমিক, একভাগ শিল্পপতি। বড়লোকরা আমাদের জন্য না করেন কর্মসংস্থান, না কষ্টের দিন লাঘবে শ্রমিকদের হয়ে সরকারকে কিছু বলেন। শহীদ ও মোহনী জুট নামে দু’টি বস্তার কারখানা ছাড়া এখানে নেই কোনো বিকল্প কর্মসংস্থানও’।
তারা বলেন, ‘সরকার বাজেটে বিড়িকে ধ্বংসের পদ্ধতি দিলেও দিচ্ছে না শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের কোনো পদ্ধতি। ফলে লাখ মানুষ, হাজারো পরিবার কি না খেয়ে মরবে!’
নাম প্রকাশ না করতে চেয়ে এক বৃদ্ধ শ্রমিক বলেন, ‘বিড়ি শিল্প থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পায় সরকার, এটি বন্ধ করা হবে না। দাম বাড়িয়ে কেবলই নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে মালিকের কিছুই আসে-যায় না, চাবুক চলছে শ্রমিকের পিঠেই’।
তিনি বলেন, ‘সরকার একদিকে নতুন করে লাইসেন্সও দেয়, আবার ট্যাক্সও বাড়ায়। এতে নীরবে মরছেন শ্রমিকরা। অন্য কোনো কাজের বন্দোবস্ত না করে আর একটা টাকা বাড়লে সেটা স্বৈরাচার ছাড়া আর কিছুই আখ্যা পাবে না’।
শ্রমিকরা চান, সরকার বিড়ি শিল্পের বিকাশে বাধ্যবাধকতা আনলেও তাদের যেন বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।
অসমর্থিত একটি সূত্র বলছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিড়ি শিল্পের উৎপাদন প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় দেড়শ’ কারখানা। তবে নতুন করে লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াও থেমে নেই। বিভিন্ন জেলায় বেকার হয়েছেন প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিক।
বাংলাদেশ বিড়ি শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও হারাগাছ বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আমিন উদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, হিসেব কষে বের করা-একজন শ্রমিক যদি ১০ হাজার টাকা আয় করেন, তবে এর থেকে সরকারের রাজস্ব অন্তত ১৮-২০ হাজার টাকা। এক হাজার শলাকা বানালে ৩১ টাকা, তা থেকে সরকার পায় ১৬০ টাকা- যা এবার বাজেটে আরও বাড়ানো হচ্ছে।
‘শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে না, বাড়বে সরকারি টাকা- এ কেমন অবিচার’- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
আমিন বলেন, তিন-চার স্তরে স্থানীয় লাখখানেক শ্রমিকের কর্মযজ্ঞ এখানে। প্রত্যক্ষভাবে আছেন প্রায় ৫০ হাজার । দেশজুড়ে এ সংখ্যা ১৮/২০ লাখ। এসব মানুষকে অচিরেই চাকরি বা বিকল্প কাজ দিতে না পারলে জনসংখ্যায় বোঝা হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না তাদের।
আরও পড়ুন:
‘লাইসেন্স দেন-ট্যাক্সও বাড়ান, মারেন শুধু বিড়ি শ্রমিকরে’
মিঠাপুকুর আ’লীগে গ্রুপিং, বিভক্ত ভোটাররা!
‘সুষ্ঠু ভোট হলে এমপি জাপার’
বিএনপির অফিস এখন আম-কলার আড়ৎ!
হাইওয়েতেও ইফতারির পূর্ণ আনন্দ!
বাংলাদেশ জিতবে আশা গ্রামবাসীর!
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৭
আইএ/এএসআর