ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

একবার খেলে ভোলা যায় না হাড়িভাঙার স্বাদ

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৪ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৭
একবার খেলে ভোলা যায় না হাড়িভাঙার স্বাদ হাড়িভাঙা শুধু উত্তরবঙ্গেই নয়, সারা বাংলায় সমান সমাদৃত। ছবি ও ভিডিও: বাংলানিউজ

রংপুর থেকে ফিরে: ‘মিঠাপুকুরের মিঠা আম, স্বাদে-গুণে দেশজোড়া নাম। ঢাকায় গেলে নিয়ে যেতে পারেন, সহজে পচে না, গলে না। কেজি মাত্র ৬০-৭০ টাকা’।

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা পরিষদের সামনে আম বেচা-কেনার উৎসবে ছন্দ মিলিয়ে বলছিলেন বিক্রেতা শফিউল ইসলাম।

উপজেলার নয়নপুর ইউনিয়নের শফিউল জানান, এটি উত্তরের ঐতিহ্যবাহী হাড়িভাঙা আম।

এর জুড়ি নেই, সহজে পচবেও না।

নয়নপুরে পারিবারিকভাবে ১০ বিঘা জমি আছে তাদের। সেখানেই হয় হাড়িভাঙার চাষ।

মিঠাপুকুর-বদরগঞ্জই হাড়িভাঙার মূল ঐতিহ্য বহন করে।  ছবি: বাংলানিউজশফিউল আরও জানান, আষাঢ়ে পাকে হাড়িভাঙা। ৪০ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি পর্যন্ত দাম হতে পারে। ঢাকায় গেলে দাম একটু বাড়লেও কেমিক্যাল-বিষমুক্ত ফল পেয়ে কিনতে দ্বিধা করেন না মানুষজন। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে মণ মণ আম কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নিয়ে যান। ব্যবসায়ীরাও ঢাকায় পাঠাতে সদা প্রস্তুত।

দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আম ব্যবসায় জড়িত আহসান হাবীব বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের বাগান আছে, আবার আমরা বিক্রিও করি। রংপুরে এখন আম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীর কর্মসংস্থান হয়েছে। চাষি থেকে শুরু করে ঢাকায় বিক্রেতাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে কাজ করেন তারা। বিভাগীয় এই জেলার বাজার চাঙায় হাড়িভাঙার গুরুত্ব দিনে দিনে বাড়ছে’।

‘চাষি হিসেবে বলবো, সবচেয়ে বড় কথা, একবার খেলে হাড়িভাঙার স্বাদ ভুলতে পারেন না কেউ। এ জন্যই এটি জনপ্রিয়’।

রংপুর সদরে মাহিগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী রাজা বাংলানিউজকে বলেন, আঁটি একেবারে ছোট আর গুড়ের মতো মিষ্টি, পেঁপের মতো গোশতের হাড়িভাঙা আম এখন শুধু উত্তরবঙ্গেই নয়, সারা বাংলায় সমান সমাদৃত। রংপুরবাসীর সেহেরি-ইফতারের পর এবার ঈদে পাত মাতাবে সুস্বাদু এই ফল’। রংপুরে ভ্যানে করে আম বিক্রি, ছবি: বাংলানিউজমিঠাপুকুরের শিল্পপতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলহাজ এসএম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর বাংলানিউজকে জানান আম নিয়ে পরিকল্পনার কথা।

তার উক্তি, ‘এই উপজেলাকে সারা বাংলাদেশে হাড়িভাঙা আমের মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং করতে চাই। সে পরিকল্পনা আমার রয়েছে। প্রত্যেকটি ইউনিয়নে কম-বেশি যেখানে চাষ হয়, তা আরও ছড়িয়ে দিতে চাই। পাশাপাশি বিদেশে রফতানির ক্ষেত্রে হাড়িভাঙা যেন আরও অগ্রগণ্য হয়, সে ব্যবস্থা আমি করবো’।

রংপুরের আরেক উপজেলা, ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বদরগঞ্জ। এখানেও প্রচুর পরিমাণে হাড়িভাঙার চাষ হয়। উপজেলার শহীদ মিনার সংলগ্ন ফুটপাতের আম বিক্রেতা ইসলাম জানান, মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জই হাড়িভাঙার মূল ঐতিহ্য বহন করে। এখানকার মাটি ও পরিবেশ মিঠা এই ফলের জন্য উপযোগী।

বর্তমানে আমের মৌসুম চলছে। কিছু কিছু চালানে বিদেশে রফতানি ছাড়াও ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশালে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

রংপুর জেলা প্রশাসন জানায়, জেলার দুই হাজার ৯৭৫ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়, যার মধ্যে হাড়িভাঙা এক হাজার ৪২৩ হেক্টরে। মোট ২৮ হাজার ১০০ মেট্রিক টনের মধ্যে হাড়িভাঙাই উৎপাদিত হয় ১৫ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন। মোট বাগানের সংখ্যা তিন হাজার ৮২৬টি, হাড়িভাঙার বাগান দুই হাজার ৬৮৫টি (অন্তত ৩ লাখ ৭ হাজার ৩০০টি গাছ রয়েছে)। গাছে মুকুল আসার সময় মাঘ-ফাল্গুন মাস। এরপর ফল ধরে। পাকে আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে। পাওয়া যায় মধ্য শ্রাবণ পর্যন্ত।

ইতিহাস বলছে, বহু বছর আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে হাড়িভাঙা আম এনে বাগান করেন মিঠাপুকুরের মাসুমপুর ইউনিয়নের জমিদার তাজ বাহাদুর সিং। জমিদার পরিবার ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে বাগানটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। পরে নদীভাঙনে তা বিলীন হয়।

এর অনেক পরে ১৯৮৫ সালের দিকে দুই একর জমিতে ব্যক্তি উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে এ আমের বাগান শুরু হয়। সে সময় স্থানীয় বাজার থেকে কেনা একটি আম লাগানো হয়, যা জমিদারের বাগানের জাতের ছিল। তখন সেটি ফলতো শুধু জমিদারের বাগানের আম বিক্রির দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তির বাসায়।

বদরগঞ্জ শহীদ মিনার সংলগ্ন ফুটপাতে আম বেচা-কেনার উৎসব।  ছবি: বাংলানিউজঅন্য জাতের আম যখন শেষ পর্যায়ে, তখন বাজারে আসতে শুরু করে হাড়িভাঙা। এ গুণ থেকেই প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয় হতে থাকে, আস্তে আস্তে পুরো দেশ ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিদেশেও।  

হাড়িভাঙার নামকরণের বিষয়ে জানা গেছে, ওই জাতের আমগাছের গোড়ায় পানি দিতে একটি হাড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরে কেউ একজন হাড়িটি ভেঙে ফেলেন। সেখান থেকে এ আমের নাম দেওয়া হয়, হাড়িভাঙা।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৬ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৭
আইএ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।