ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘গরিবের ঢেউটিন’ সুন্দরবনের গোলপাতা

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৯
‘গরিবের ঢেউটিন’ সুন্দরবনের গোলপাতা গোলপাতা। ছবি: বাংলানিউজ

সুন্দরবন থেকে ফিরে: সুন্দরবনের পশ্চিম বনবিভাগের বাইদার খালের দু’পাড়ে সর্বত্রই গোলপাতার ছড়াছড়ি। সারি সারি দীর্ঘ গোলপাতা দেখে হয়তো বেমালুম যে কেউ খানিক সময়ের জন্য বলবেন এটা গোলপাতার বন। ৩ থেকে ৪ বছরের নারিকেল চারার আকৃতি বিশিষ্ট গোলপাতা গাছ ঝাড় আকারে বিন্যস্ত রয়েছে। অনুরূপভাবে শেখের খাল, টেপারভাড়ানি খালের দু’পাড়সহ বনের প্রায় সব খালের পাড়ে সারি সারি গোলাপাতা গাছ। 

সুন্দরবনে টহলরত অবস্থায় পশ্চিম বনবিভাগের খুলনা রেঞ্জের স্মার্ট প্যাট্রোল টিমের লিডার সুলতান মাহমুদ টিটু বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনের প্রায় সর্বত্রই গোলপাতা জন্মে থাকে। তবে, নদী ও খালের পাড়ে এবং নতুন চরে অধিক পরিমাণে গোলপাতা জন্মে।

তুলনামূলকভাবে কম দাম, শক্ত ও অধিক টেকসই হওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের ঘরের ছাউনির কাজে ‘গরিবের ঢেউটিন’ হিসেবে খ্যাত সুন্দরবনের গোলপাতা। ঘরের চালে গোলপাতার ছাউনি উপকূলসহ বিভিন্ন জেলায় খুব জনপ্রিয়। এ পাতার ছাউনি ঘর গরমের সময় ঠাণ্ডা ভাব এবং শীতের সময় গরমভাব অনুভূত হয়। গোলপাতা দিয়ে ভালোভাবে ঘরের ছাউনি দিলে ৪ থেকে ৫ বছর পার হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, বাওয়ালিরা আগে গোলপাতা কাটতে এসে বনদস্যুদের কবলে পরতো কিন্তু এখন প্যাট্রোল টিমসহ বনরক্ষীদের কঠোর অবস্থানের কারণে সে অবস্থা নেই। গোলপাতা।  ছবি: বাংলানিউজ
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, গোলপাতা বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতি। গোলপাতা সুন্দরবনের একটি অতি মূল্যবান প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ। নামে গোল হলেও গোলপাতা আসলে গোলাকার নয়, লম্বা লম্বা। এর পাতা সবুজ বর্ণের অনেকটা নারিকেল গাছের পাতার মতো। বহুমুখী ব্যবহার ও সহজলভ্যতার কারণে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের প্রায় ১৬টি জেলার নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরবাড়ি ও আশ্রয়স্থাল নির্মাণে গোলপাতা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত গোলপাতা সংগ্রহের কাজ চলে।

প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টন গোলপাতা সংগৃহীত হয়। এ কাজে প্রতিবছরের মৌসুমে প্রায় ৩০ হাজার লোক নিয়োজিত থাকে। সুন্দরবন থেকে যারা গোলপাতা সংগ্রহ করেন তাদেরকে বাওয়ালি নামে ডাকা হয়। যদিও বাঘের আক্রমণের কারণে গোলপাতা সংগ্রহ করা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। তথাপিও জীবন ও জীবিকার তাড়নায় এত অধিক সংখ্যক লোক এ পেশায় নিয়োজিত থাকে। এছাড়া নদী পথে গোলপাতা পরিবহনে ছোট-বড় সবমিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার নৌকা ব্যবহৃত হয়। ছাউনি ছাড়াও রান্নার জ্বালানি হিসেবে ধরাতে শুকনো গোলপাতা পাতা ব্যবহার হয়। পাতার ডাটা জ্বালানি হিসেবেও বেড়া নির্মাণে, মাছ ধরার জন্য উপযুক্ত আশ্রয়স্থল তৈরির কাজে পাতা ব্যবহৃত হয়।
গোলফল।  বাংলানিউজ
এছাড়া পাতার ডাঁটা, মাছ ধরার সময় জালে ভাসিয়ে রাখার জন্য জেলেরা ব্যবহার করে থাকে। গোলপাতার সাহায্যে ছাতা, সানহ্যাট, রেইনকোর্ট, ঝুড়ি, মাদুর, থলে, খেলনা প্রভৃতি তৈরি করা হয়। গোলফল অনেকটা তালের মতো। কচি ফলের শাঁস খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই শাঁস খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। গাছের মাথি বিশেষভাবে রান্না করে সুস্বাদু খাদ্য তৈরি করা যায়। গোলগাছের মঞ্জুরি হতে রস সংগ্রহ করা যায়। এই রসে শর্করার পরিমাণ শতকরা প্রায় ১৮ শতাংশ। যা চিনি তৈরিতে ও টনিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়াও রস হতে ভিনিগার তৈরি হয়।  

নলিয়ান এলাকার বাওয়ালি আবুল কালাম বাংলানিউজকে বলেন, বনবিভাগের পাস পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে গোলপাতা কাটতে যেতে হয়। জলদস্যুদের চাঁদা, মুক্তিপণ এসব আগের মতো না থাকলেও বাঘের ভয় তো রয়ে গেছে বনে। গোলপাতার ঝাড়ের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার এসে লুকিয়ে থাকে। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনে গোলপাতা কাটতে যেতে হয়।  
গোলফল।  বাংলানিউজ
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বশিরুল-আল-মামুন বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৬৩ দশমিক ৪৬ হাজার কুইন্টাল গোলপাতা আহরণ হয়েছে।
 
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৪৫ হাজার ৫শ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণ হয়েছে। এতে রাজস্ব আয় হয়েছে ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৫৯ টাকা।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ২৯ হাজার ৩শ ৭৯ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণ হয়েছে। এতে রাজস্ব আয় হয়েছে ৮ লাখ ৯ হাজার ৭শ ৬৭ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ২২ হাজার ৪শ ৫৪ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণ হয়েছে। এতে রাজস্ব আয় হয়েছে ৬ লাখ ২৫ হাজার ৯শ ৭টাকা।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৯
এমআরএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।