ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

দক্ষিণখানে ট্রিপল মার্ডার: নেপথ্যে ঋণ!

প্রশান্ত মিত্র, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০
দক্ষিণখানে ট্রিপল মার্ডার: নেপথ্যে ঋণ!

ঢাকা: প্রেম থেকে পরিণয়, তবে দু-এক বছরের সংসার নয়। এক ছাদের নিচে প্রায় ১৪ বছর ধরে সুখে-শান্তিতে দিন কাটছিল রাকিব-মুন্নি দম্পতির। দুই সন্তানের বাবা-মা এ দম্পতির মধ্যে কখনো পারিবারিক কলহ দেখেননি প্রতিবেশী ও স্বজনরা। আচমকা এক ঘটনায় সেই সংসারের অবশিষ্ট বলে আর কিছু রইলো না। বন্ধ ঘরে লাশ হয়ে পড়ে রইলো মুন্নি ও তাদের দুই সন্তান।

ঘটনার পর থেকেই রাকিব উদ্দিন ভূঁইয়া নিখোঁজ থাকায় এখনো এ হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জট খুলেনি। তবে স্বজনদের ধারণা, সম্প্রতি রাকিব বিভিন্ন জনের কাছে বেশ মোটা অঙ্কের ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

এ কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেই স্ত্রী-সন্তানদের খুন করে পলাতক থাকতে পারেন।
 
গত শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর দক্ষিণখানের প্রেমবাগানে পাঁচতলা একটি ভবনের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে মুন্নি রহমান (৩৮), তার ছেলে ফারহান উদ্দিন ভূঁইয়া (১২) ও মেয়ে লাইবা ভূঁইয়ার (৩) অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসক জানিয়েছে, নারীর মাথার পেছনে জখম রয়েছে আর দুই সন্তানের গলায় দাগ রয়েছে। তবে বিভিন্ন আলামত অনুযায়ী চিকিৎসকের ধারণা একজনই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
 
এদিকে ঘটনাস্থল থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করেছে পুলিশ। ডায়েরিতে ‘ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে খুন করা হলো, আমাকে পাওয়া যাবে রেললাইনে’ এমন এক লাইন লেখা ঘিরে নিহত মুন্নির স্বামী রাকিবকেই প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, স্ত্রী-সন্তানদের খুন করে রাকিব পালিয়ে গেছেন। তাকে পাওয়া গেলে ঘটনার রহস্য উন্মোচন সম্ভব হবে।
 
পুলিশ জানায়, মুন্নির স্বামী রাকিব উত্তরা বিটিসিএলের উপ-সহকারী প্রকৌশলী। এ ঘটনায় অন্য কেউ জড়িত কিনা অথবা তিনজনকে হত্যার পর রাকিবকে কেউ অপহরণ করেছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাকিবকে ফাঁসাতে কেউ ডায়েরিতে এসব কথা লিখেছে কিনা, বিষয়টিও সন্দেহে রেখে তদন্ত চলছে।  
 
মুন্নির মরদেহের পাশে একটি হাঁতুড়ি পাওয়া গেছে, যা জব্দ করেছে পুলিশ। বর্তমানে ওই ভবনের চারটি ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করছে পুলিশ।  

এদিকে গত শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে মুন্নি, ফারহান ও লাইবার মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে রাতেই তাদের বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
 
ময়নাতদন্ত শেষে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক এ কে এম মাইনুদ্দিন জানান, আলামত দেখে মনে হচ্ছে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা একজনই ঘটিয়েছে। তিনটি মরদেহের উপরিভাগ বেশি পচনশীল ছিল। নারীটির মাথার পেছনে আঘাত আছে এবং শিশু দু’টিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে এমন আলামত পাওয়া গেছে।
 
নিহত মুন্নির দুলাভাই মোসলেহ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, তিন দিন ধরে মুন্নির স্বামীর খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছিল না। পরবর্তীতে মুন্নির ফোনেও যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই গত শুক্রবার এলাকার অন্যদের কাছে ফোন করে জানতে পারি বাইরে থেকে মুন্নির বাসায় তালা দেওয়া, ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এরপর তাদের বাসায় এসে দরজার তালা ভেঙে তিনজনের মরদেহ পাওয়া যায়।
 
রাকিব উদ্দিন ঋণগ্রস্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন দক্ষিণখানের ওই বাড়ির মালিক মো. মনোয়ার হোসেন।  তিনি বলেন, আমি শুনেছি রাকিব কিছুটা ঋণগ্রস্ত ছিলেন। তার ভাই সোহেল আহমেদ এ বিষয়ে থানায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। যতটুকু আমি জানি, গত বুধবার সোহেল ও রাকিবের মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল। প্রায় চার মাস আগেও একবার রাকিবকে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে শুনলাম তিনি অপহরণ হয়েছিলেন। তবে কে বা কারা অপহরণ করেছে তা জানি না।
 
মনোয়ার হোসেন বলেন, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে রাকিব আমার বাসায় ভাড়া থাকেন। এ দশ বছরে আমি তাদের (স্বামী-স্ত্রীর) মধ্যে কোনো বিবাদ দেখিনি। প্রায় সময় তার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হতো। তার ব্যবহার খুব ভালো। এর আগে রাকিব বাড্ডা ও গুলশান এলাকায় ভাড়া থাকতেন বলে শুনেছি।
 
মুন্নির মামাতো ভাই তানভীর রহমান জানান, মুন্নির স্বামী রাকিব বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি। ওই টাকা রাকিব কী করেছেন বা রকিবের কাছে কারা কত টাকা পায় তা আত্মীয়-স্বজন কেউই জানে না। মুন্নি-রাকিব পারিবারিকভাবে সুখী ছিলেন। আর্থিক অনটনের কারণে ছেলে ফারহানকে এ বছর স্কুলেও ভর্তি করানো হয়নি। ফারহান চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল।
 
এর আগে রাকিবের নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে তার দাবি, ঋণের কারণে চার-পাঁচ মাস আগে রাকিব স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হন। পরে কুমিল্লার বুড়িচং এলাকা থেকে স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। কেন তিনি তখন নিখোঁজ হয়েছিলেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
 
এ তিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শনিবার দক্ষিণখান থানায় মামলা করেছেন নিহত মুন্নির ভাই মুন্না রহমান। মামলায় আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ না করলেও সন্দেহের তীর ভগ্নিপতি রাকিবের দিকেই।
 
এ বিষয়ে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং নিখোঁজ রাকিবকে পাওয়া গেলে হত্যাকাণ্ডের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। তার অবস্থান শনাক্ত করে তাকে খুঁজে পেতে পুলিশ চেষ্টা করছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন গত বুধবার তাকে মসজিদে নামাজ পড়তে দেখা গেছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরা আমরা দেখেছি, সেটি সচল রয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে।
 
রাকিব কয়েক মাস আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয়দের কাছে আমরা শুনেছি, গত মাস চারেক আগে তিনি একবার নিখোঁজ হয়েছিলেন। কিছুদিন পর আবার ফিরে আসেন। তবে এ বিষয়ে থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পাওয়া যায়নি।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০
পিএম/আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।