দেশে ফিরেই বা কী করবেন? আবাদি জমিটুকুও তার নাগালের বাইরে, বাধ্য হয়ে রড বাঁধাইয়ের কাজেই লেগে পড়েন। কাজ পান ঠিকই কিন্তু আয় আটকে থাকে চল্লিশ-পয়তাল্লিশ হাজার টাকায়।
বলছিলাম রঙিন স্বপ্ন নিয়ে মালয়েশিয়ায় আসা মাগুরার মমতাজ রহমানের (ছদ্ম নাম) কথা। আসতে খরচ হয়েছে পৌনে তিন লাখ টাকা। জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়েছিলেন দালালের হাতে।
এরপর আসে ২০১৬ সাল। প্রথম দিকেই টাকার বিপরীতে মালয়েশিয়ান মুদ্রার দরপতন হয়। আগে এক রিঙ্গিতের সমান ছিল ২৭ টাকা, এখন আঠারো টাকার নিচে চলে এসেছে। অর্থাৎ বেতন ঠিক থাকলেও তার আয় কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। মমতাজ রহমানের পয়তাল্লিশ হাজার টাকার স্থলে হঠাৎ করে আয় নেমে এসেছে ত্রিশ হাজার টাকায়।
এক রুমে চারজন থাকেন মাসে ভাড়া দিতে হয় দুই’শ রিঙ্গিত (৩৬’শ টাকা), আর খাওয়া বাবদ খরচ হয় সাড়ে তিন থেকে চারশো রিঙ্গিত। প্রায় ছয়শো রিঙ্গিত চলে যায় থাকা-খাওয়া বাবদ। এর বাইরে রয়েছে পকেট খরচ, সব মিলিয়ে প্রায় বাংলাদেশি টাকায় পনের হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়।
এই হিসেবে মাসে তার নিট আয় (দেশে পরিবারের খরচ ছাড়া) পনের হাজার টাকা। সেই হিসেবে তার বছরে আয় হওয়ার কথা এক লাখ আশি হাজার টাকা। এখানেও যদির উপর নির্ভর করতে হয়। এই যদি হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন কাজ পাওয়া। যদিও মালয়েশিয়ায় এখন কাজের বাজারের খুব খারাপ দশা।
মালয়েশিয়ায় এসেছেন তিন বছর চার মাস হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ছয় মাস বেকার বসে ছিলেন। সর্বশেষ কাজ বুকিত বিনতানের ‘বুকি নানাস’ টাওয়ারের (আটচল্লিশ তলা) কাজ করেছেন। সেই প্রজেক্টের কাজ গত জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখে শেষ হয়েছে।
এরপর থেকেই পুরোপুরি বেকার। অনেক ঘুরাঘুরি করছেন কোথাও কাজ পাননি। মমতাজ রহমানের মতো আরও চারশত পঁচাশি জন বেকার হয়ে রয়েছেন। যাদের অনেকের কাছে দিন যাপনের মতোও টাকা নেই। অনেকে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। অনেকের বাড়ি থেকে টাকা আনার মতো অবস্থা নেই। আবার কেউই বাড়িতে নিজেদের কষ্ট-যন্ত্রণার কথা জানাতে চান না পরিবারের সদস্যরা দুশ্চিন্তায় পড়বেন বলে।
এখানেই শেষ নয় মততাজ রহমানের সহি আমলনামা। নিট আয় থেকে ওয়ার্ক পারমিটের নবায়ন ফি দিতে হয় তাকে। আগে নবায়ন ফি ছিল ১২শ’ রিঙ্গিত, ঘুষসহ দিতে হতো দুই থেকে আড়াই হাজার রিঙ্গিত। এখন মালয়েশিয়ান সরকার নবায়ন ফি বাড়িয়ে ১৮শ‘ ষাট টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ঘুষসহ খরচ হচ্ছে চার থেকে পাঁচ হাজার রিঙ্গিত। অর্থাৎ তার নিট আয় থেকে প্রায় আশি হাজার টাকাই চলে যাচ্ছে ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করতে।
এদিক থেকে হিসেব কষলে পরিবারের খরচ বাদে বার্ষিক নিট আয় মাত্র এক লাখ টাকা। সংসারের ঘানি টানাতে ওভারটাইম কাজ করতে হচ্ছে। সকালে ৮টায় কাজে এসে দশ থেকে এগারো ঘণ্টা কাজ করেন। এক টাকা খরচ করার আগে শতবার ভাবেন। জীবন তাদের একটি ছকে আটকে গেছে। জীবনের স্বাদ আহ্লাদ বলতে কিছুই নেই। অনেকের কাছেই জীবন এখন অর্থহীন। বিনোদন বলতে কিছুই নেই তাদের জীবনে।
এই হলো বৈধ অভিবাসীদের জীবনের চিত্র। তবে কেউ কেউ আবার ভালো লোকের সান্নিধ্য পেয়ে ভালোই রয়েছেন। অন্যদিকে অবৈধ অভিবাসীদের জীবন যেন দুঃখের মহাকাব্য। বেতন কম, কখনও কখনও এক দুই মাস কাজ করিয়ে নিয়ে বেতন যাতে দিতে না হয়, সেজন্য বাংলাদেশি দালালরাই পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিচ্ছেন তাদের।
(বিস্তারিত থাকছে মালয়েশিয়ান প্রবাসীদের সহি আমলনামা-২)
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৭
এসআই/এমজেএফ