ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মালয়েশিয়া

প্রবাসীদের সহি আমলনামা-২

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৭
প্রবাসীদের সহি আমলনামা-২ মালয়েশিয়ায় প্রবাসি বাংলাদেশীরা- ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুয়ালালামপুর থেকে: অবৈধদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। অনেকে কাজ পাচ্ছেন না। আবার পেলেও উপযুক্ত মজুরি পাচ্ছেন না। কখনও কখনও এক-দুই মাস কাজ করিয়ে নিয়ে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিচ্ছে একশ্রেণির বাংলাদেশি দালাল।

অবস্থাটা এ রকম, টালবাহনা করে বিল বকেয়া রাখছে দু’মাস। বলা হচ্ছে একবারে দিয়ে দেবে।

ঠিক যখন বেতনের জন্য চাপ দিচ্ছে তখনেই মালয়েশিয়ান পুলিশকে ডেকে এনে ধরিয়ে দিচ্ছে। এমনই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ফয়সাল।
 
এক মাস সাত দিন ধরে কারাগারে আটক তিনি। শখ করে বাদশা ফয়সলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রেখেছিলেন তার বাবা। কিন্তু ভাগ্যবিধাতা তার সহায় হয় নি। তার জন্মদাতা আগে থেকেই মালয়েশিয়া থাকেন। তিনিই ছেলেকে এনেছেন ‍সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য।
কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয় নি। গাজীপুরের (কাপাসিয়ার)বাদল নামের এক আদম ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে তার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। বলা চলে, একটি পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কথা ছিল, সাড়ে তিন লাখ টাকা দিতে হবে। গুণে গুণে দিয়েছিলেনও তা।

কিন্তু ফয়সালকে মালয়েশিয়া আনার পর ভোল পাল্টে ফেলেন বাদল। বাড়তি ১২’শ রিঙ্গিতের জন্য পাসপোর্ট আটকে রাখেন। এই অর্থ দেওয়ার জন্য সময় চেয়ে নেন ফয়সালের বাবা। দিতে দেরি হচ্ছিল এমন সময় মালয়েশিয়া পুলিশ তাকে বাসা থেকে আটক করে নিয়ে গেছে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।

এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ফয়সালের বাবা। ছেলেকে যে উদ্ধার করবেন তারও কোনো উপায় দেখছেন না। উদ্ধার করতে হলে প্রয়োজন পাসপোর্ট, তার কাছে তো পাসপোর্টেই নেই! কি নিয়ে যাবেন কারাগারে! মাস খানেক ধরে অনেকবার ফোন দিয়েছেন কিন্তু ফোনকল রিসিভই করছেন না বাদল। আবার বাদলের কোনো ঠিকানাও জানেন না ফয়সালের বাবা।

প্রবাসী জীবন, ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমবুকিত বিনতানে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে যখন এই কাহিনী শোনাচ্ছিলেন তখন আপনা থেকেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল ফয়সালের বাবার। জানালেন, তার কাছে বাড়তি কোনো অর্থ মজুদ নেই, যা তিনি বাদলকে দিতে পারেন। তাই ছেলেকে উদ্ধারের জন্য দেশের বাড়িতে ফোন করে জমি বিক্রি করে টাকা পাঠাতে বলেছেন: ‘‘বাড়িতে বলেছি, দাম কবিনা, জমি বেইচ্যা লা, যা হয় টাকা পাডা। ছেলেটারে বাঁচাইতে অইবো। ’’

ছেলের চিন্তায় নিজের কাজও ছেড়ে দিয়েছেন ফয়সালের বাবা। এখন সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বাদলের সন্ধান করছেন। যদি খুঁজে পান তবে হাতে পায়ে ধরে পাসপোর্ট আনবেন। ছেলেকে কারাগার থেকে বের করে দেশে ফেরৎ পাঠাবেন।

কিন্তু কোন কূলকিনারা পাচ্ছেন না। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো অবস্থা প্রবাসী এই বাংলাদেশি বাবার। আর যিনি এই পরিবারটিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন তিনিও একজন বাংলাদেশি। দেশে নাকি কয়েক কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন তিনি।
কিন্তু তারপরও জমিজমা বিক্রি করে মালয়েশিয়া আসা সাধারণ মানুষগুলোকে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন বাদল। শুধু ফয়সাল নন,  আরও বেশ ক’জন বাংলাদেশির পাসপোর্ট নাকি আটকে রেখেছেন তিনি। পাসপোর্ট আটকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করাই নাকি বাদলের কাজ।

প্রবাসীদের সহি আমলনামা, ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমশুধু বাদল নন, আরও কিছু বাংলাদেশি আদম-ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা প্রবাসী বাংলাদেশিদের রক্ত শুষে খাচ্ছেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সুনামও ক্ষুন্ন করছেন বিদেশিদের কাছে।

শুধু আদম ব্যবসায়ীরা নন, অনেক বাংলাদেশি ঠিকাদার রয়েছেন, যারা নির্মাণকাজের শ্রমিক সরবরাহ করার চুক্তি নিচ্ছে। তারাও এই অবৈধ প্রবাসীদের নানা দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। তুলনামুলক কম দামে কাজে নিয়োগ করছে। অবৈধদের কাজের সুযোগ কম থাকায় বাধ্য হয়ে তারাও এদের বঞ্চনার ফাঁদে পা দিচ্ছে। মাস শেষ হলে টাকা তুলে নিলেও শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করছে না। ক্ষেত্রবিশেষে টাকা মেরে দেওয়ার জন্য পুলিশে ডেকে এনে ধরিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

শরীয়তপুরের এক প্রবাসী অভিযোগ করলেন, তিনি প্রথমে এসে বাংলাদেশি এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ শুরু করেন। চুক্তির চেয়ে কম মজুরি দেয়া হতো তাকে। প্রতিবাদ করলে এক সময় তাকে অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নেওয়ার পরামর্শ দেঁওয়া হয়। ততদিনে তার দু’মাসের বেতন আটকা। তাকে ওই ঠিকাদার মাস শেষ হলে এসে মজুরি নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু কয়েক দফা গিয়েও মজুরি আর পাননি।

এ রকম মজুরি খোয়ানোর ভুরিভুরি অভিযোগ পাওয়া গেছে বাঙালি অধ্যুষিত বুকিত বিনতান ও কোতারায়া ঘুরে। অনেকেরই এমন নির্মম, তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। কারো পনের দিন, কারো দু’মাস কারো এক মাসের মজুরি খোয়া গেছে একাধিক দফায়।

প্রবাসীদের ব্যস্ততা, ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমমাগুরার বাবুল আক্তার জানালেন, বাংলাদেশিরা এখন কাজ নেওয়ার আগেই খোজ নেন সেখানে কোনো বাংলাদেশি আছে কিনা। বাংলাদেশি থাকলে সেখানে কাজে আর যোগ দেনই না তারা। বরং বিদেশিরাই ভালো। তারা অন্তত মজুরি মেরে দেয় না।

এসব মজুরি-খোয়ানো অসহায় মানুষগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো অভিযোগ করেন না। যেহেতু তাদের কাছে কাছে কোনো প্রমাণ থাকে না। আর সমাজের মুখোশধারী এই ছদ্মবেশীদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না--- এ ভয়ও সর্বক্ষণ তাদের তাড়া করে ফেরে।
বাংলাদেশ হাইকমিশনে গেলে হয়তো এই সমস্যার কিছুটা সমাধান পেতে পারেন তারা। কিন্তু সমাজের অতি সাধারণ আর অবস্থার ফেরে সবচেয়ে অসহায় আর বিপন্ন এই মানুষগুলো বিচার দিয়ে রেখেছেন উপরওয়ালার কাছে। তিনি ছাড়া বিদেশ বিভূঁইয়ে তাদের আর কেইবা আছে!

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৭
এসআই /জেএম/

** মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের সহি আমলনামা
** বুকিত বিনতানের সম্প্রীতি
** মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের আস্থা ‘লাকম ইনন’
** বাংলানিউজের সিরাজ এখন মালয়েশিয়ায়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।