ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

নরকযন্ত্রণা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
নরকযন্ত্রণা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে! লাইনের মতো গাদাগাদি দাঁড়িয়ে টোকেন নিতে হয় মালয়েশিয়া প্রবাসীদের

বাংলাদেশ হাইকমিশন, কুয়ালালামপুর থেকে: মধ্যাহ্ন বিরতি চলছিল। পাঁচ ফুটের লম্বা করিডোরটিতে গাদাগাদি করে দাঁড়ানো চার-পাঁচশ’ প্রবাসী। লাইনের মতো, কিন্তু লাইন বলা চলে না।

ভ্যাপসা গরমে অনেকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কারো কারো শরীর ঘামে ভিজে জ্যাব জ্যাব করছে।

এটি মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের টোকেন পাওয়ার লাইন। প্রবাসীরা এখান থেকে টোকেন নিয়ে ভেতরে ঢোকার পর নতুন পাসপোর্ট পাওয়াসহ প্রয়োজনীয় সব কাজ সারতে পারেন।

তবে প্রবাসীরা অভিযোগ করছেন, টোকেন পাওয়ার লাইনে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে পদে পদে দুর্ভোগ-হয়রানি পোহাতে হচ্ছে তাদের। আগে কিছুটা সুযোগ-সুবিধা থাকলেও এখন নরক যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে হাইকমিশনে গেলে।    

বিশেষ করে নতুন পাসপোর্ট পেতে অহেতুক সময়ক্ষেপণে হয়রানির শেষ থাকে না। প্রথম সচিব (পাসপোর্ট) মসিউর রহমান এখানে যোগ দেওয়ার পর কাজকর্মের দীর্ঘসূত্রতা ও ঢিলেমি চরমে উঠেছে।
 
প্রবাসীদের অভিযোগ, মসিউর রহমানের যোগদানের আগে দিনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২শ’ পাসপোর্ট দেওয়ারও রেকর্ড রয়েছে। আর এখন তিন থেকে চারশ’ পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। আগে অনুরোধ করলে অফিস সময়ের পরেও কিছু কাজ হতো, এখন বন্ধ হয়ে গেছে সেটিও।

মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাইকমিশনের সদর দরজা থেকেই ভেতরে যাওয়ার টোকেন পেতে লাইন শুরু করতে হয় প্রবাসীদের।

স্বল্প পরিসরের এ জায়গাটুকু থেকে ভেতরে কি হচ্ছে, কিছুই দেখার সুযোগ নেই। ছোট্ট একটি দরজা রয়েছে, যার সামনে হাইকমিশনের ওয়েটিং রুমে যাওয়ার টোকেন দেওয়া হয়।
নরকযন্ত্রণা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে!
ভেতরে একসঙ্গে ৩শ’ জন বসতে পারেন। সে কারণে আগে যারা ভেতরে গেছেন, তাদের বের হওয়া সাপেক্ষে নতুন কাউকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

সকাল ৮টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অনেকে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়েছেন। কয়েকজন আবার দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

লাইন ছেড়ে গ্লাসের ওপারে মুকুলের হোটেলে ঢুকেছেন প্রবাসী বাবুল মিয়া। চার মাস আগে পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দিয়েছেন। মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) এসেছেন পাসপোর্ট নিতে।

বাবুল মিয়া থাকেন মালয়েশিয়ার সীমান্ত শহর জহুর বারুতে। হাইকমিশন থেকে যার দূরত্ব সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার। আগের রাতে বাসে এসেছেন একদিনের ছুটি নিয়ে। পাসপোর্ট নিয়ে দিনে দিনে ফিরতে হবে তাকে।

কিন্তু পাসপোর্ট দূরের কথা, হাইকমিশনে ঢোকার টোকেনও পাননি। গরমে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন এ প্রবাসী। চোখে-মুখে তার রাজ্যের হতাশা ও আতঙ্কের ছাপ।

বাবুল মিয়ার মতো অনেকেরই একই দূরাবস্থা।

দুপুরে মধ্যাহ্ন বিরতির কারণে থমকে আছে লাইন। কেউ কেউ দালালদের সহায়তায় লাইন এড়িয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলেই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন অন্যরা। আর তাতেই  গোলমাল লেগে যাচ্ছে। হাতাহাতিও হচ্ছে হরদম।

হাইকমিশনের কেউ সেখানে না থাকলেও ভবন মালিকের একজন সিকিউরিটি গার্ড চোখ বুজে লাঠিপেটা করলেন কয়েকজনকে।
নরকযন্ত্রণা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে!
বাবুল মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘গরম আর গাদাগাদির কারণে দম নিতে পারছিলাম না। তাই সরে এসেছি। আর একটু পর পরই লাইনে গোলমাল হচ্ছে। এ কারণে ভয়ও লাগছে। আবার ছুটিও শেষ, ফিরতে হবে কর্মস্থলে। না হলে চাকরিচ্যুত হতে পারি। এখন কি করবো, ভাবতে পারছি না’।

কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার প্রবাসী মোমিনুল ইসলাম থাকেন মালাক্কা শহরে। রোববার (১৬ এপ্রিল) রাতে এসে সোমবার (১৭ এপ্রিল) লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তার ভাগ্যে টোকেন জোটেনি। হাইকমিশনের সামনের ফুটওভার ব্রিজে রাত কাটান। সেখানে তার মতো আরও জনাবিশেক প্রবাসী ছিলেন।

মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টায় নতুন পাসপোর্ট তুলতে ফের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন মোমিনুল ইসলাম। এক দালালের মাধ্যমে ব্যাংক ড্রাফট করেছিলেন। কিন্তু দুপুর নাগাদ সিরিয়াল পেলে কাউন্টারে গিয়ে জানতে পারেন, তার ব্যাংক ড্রাফটি ভুয়া। পরে আর ওই দালালের দেখা পাননি।

আবার চলে যান ব্যাংক ড্রাফট করতে। এসে প্রায় তিনশ’ লোকের পেছনে পড়েছেন। কি আছে ভাগ্যে জানেন না।

ঘড়ির কাটায় চলে হাইকমিশন। টোকেন নেন আর যাই নেন। বিকেল ৫টার এক মিনিট পরও কোনো কাজ হবে না।

মোমিনুল ইসলাম জানান, সোমবার তারা অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিলেন। কিন্তু প্রথম সচিব (পাসপোর্ট) মসিউর রহমানের মন গলাতে পারেননি। তিনি সাফ বলে দিয়েছিলেন, ‘আমি সময়ের পর কোনো কাজ করতে পারবো না। কে কতোদূর থেকে এসেছেন, কার কি সমস্যা, সেটি দেখার দায়িত্ব আমার নয়’।

‘যে কারণে প্রায় ৫০ জন প্রবাসী শ্রমিককে ফুটপাতে রাত কাটাতে হয়। কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও সুপারিশ নিয়ে গিয়েছিলেন। তারাও বলেছিলেন যে, প্রবাসীরা অনেক দূর থেকে এসেছেন। আবেদনগুলো জমা নেওয়া হোক। তাদেরকেও সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, সমস্যা দেখার জন্য সরকার আছে আমাকে বলে লাভ হবে না’।

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
এসআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।