লক্ষ্মীপুর: সরকারি মূল্যের চেয়েও খোলা বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় লক্ষ্মীপুরের কৃষকরা খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করছেন না। এছাড়া ধানের পাশাপাশি চালের দাম বেশি হওয়ায় চালকল মালিকরাও গুদামে চাল দিতে আগ্রহী নন।
ফলে চলতি আমন মৌসুমে ধান এবং চাল সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ধান-চাল কেনার নির্ধারিত সময়সীমার এক মাসের বেশি পার হলেও জেলার পাঁচটি উপজেলার দু’টিতে এখনো ধান সংগ্রহ করতে পারেনি। আর জেলার তিন উপজেলায় গত বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৩৯ টন। যদিও গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ ধান-চাল সংগ্রহ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে।
ধান সংগ্রহের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন না হওয়ায় জেলার সদর উপজেলার খাদ্য গুদামে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুই করা হয়নি। তবে গত ১৭ নভেম্বর জাতীয়ভাবে সারাদেশে ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করে মন্ত্রণালয়। আর সংগ্রহের নীতিমালা অনুযায়ী জেলা বা উপজেলা কেন্দ্রীক অনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের কোনো অজুহাত না রেখেই তালিকাভুক্ত কৃষকদের এবং চালকল মালিকদের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহের নির্দেশনা রয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ ধান-চাল সংগ্রহ করারও বিধান রয়েছে নীতিমালায়।
তবে দাম বৃদ্ধিসহ কৃষক ও মিল মালিকদের অনাগ্রহের কারণে নিয়ম এবং নীতিমালা রক্ষা করতে পারছে না খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক এবং কমলনগর উপজেলা খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, নীতিমালা শুধু কাগজে আছে। মাঠপর্যায়ে নীতিমালা অনুযায়ী সংগ্রহ কার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
তারা জানিয়েছেন, গুদামে কৃষকরা ধান নিয়ে না আসায় সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। আর ধানের দাম এখন খোলা বাজারে বেশি থাকায় কৃষকরাও গুদামে ধান বিক্রিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আশাবাদী জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের।
জেলা খাদ্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলার পাঁচটি উপজেলার কৃষকদের কাছ থেকে ৪২৭৮ মেট্রিক টন ধান এবং চালকল মালিকদের কাছ থেকে ৩৮০৫ মেট্রিক টন চাল কিনবে খাদ্যগুদাম।
এর মধ্যে সদর উপজেলা খাদ্যগুদাম ১২০০ মেট্রিক টন ধান এবং ৩৬৯৯ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করবে। রামগতি উপজেলায় ধান ১২১১ মেট্রিক টন, কমলনগর উপজেলায় ধান ১০২৮ মেট্রিক টন এবং চাল ৬২ মেট্রিক টন, রামগঞ্জে ধান ১৬৮ মেট্রিক টন এবং চাল ৪৪ মেট্রিক টন ও রায়পুরে ৬৭১ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে খাদ্য বিভাগ।
তবে গত বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী রামগতিতে ২৪ টন, কমলনগরে ছয় টন এবং সদর উপজেলায় মাত্র নয় টন ধান সংগ্রহ হয়েছে। যদিও জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে এ তিন উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আমন ধানের আবাদ হয়েছে।
এবার সরকারিভাবে ধানের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে কেজিপ্রতি ২৮ টাকা করে মণ ১১৮০ টাকা এবং চাল ৪২ টাকা করে মণ ১৬৮০ টাকা।
কৃষকরা খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি না করার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, আমন মৌসুমের শুরু থেকেই খেলা বাজারে প্রতি মণ শুকনো ধান বিক্রি হচ্ছে ১১২০ থেকে ১১৫০ টাকা করে। আর সরাসরি মাঠে মধ্যেই ব্যাপারীদের কাছে কৃষকরা কাঁচা ধান বিক্রি করতে পারছেন মণ প্রতি এক হাজার থেকে এক হাজার ২০ বা ৫০ টাকা করে। যদিও পুরোপুরি শুকনো প্রতি মণ ধানের সরকারি নির্ধারিত মূল্য ১১২০ টাকা।
অন্যদিকে গুদামে বিক্রি করতে হলে শুধুমাত্র সরকারি তালিকাভুক্ত কৃষকরাই লটারির মাধ্যমে ধান নিয়ে এসে বিক্রি করতে পারবে। গুদামে ধান বিক্রির এমণ প্রক্রিয়াকে জটিল মনে করেন কৃষকরা। তাই ব্যাপারীদের কাছে তাদের উৎপাদিত ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন।
গত কয়েকদিনে মাঠ পর্যায়ের এবং সরকারি তালিকাভুক্ত কয়েকজন কৃষক এবং খাদ্যগুদামে কর্মরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা এসব তথ্য জানা গেছে।
সদর উপজেলার তালিকাভুক্ত কৃষক মোমাজ্জাদ হোসেন মামুন মাঝি, হাছান আলী ও দেলোয়ার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, খোলা বাজারে মূল্য বেশি হওয়ায় তারা বাজারে ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেক ধান ব্যবসায়ী আবার সরাসরি মাঠ থেকেই কাঁচা ধান কিনে নিয়েছেন। সরকারি মূল্যের চেয়ে তারা ভালো দাম পেয়েছেন, তাই এবার খাদ্য গুদামে ধান দেননি তারা।
তাদের মতে, গুদামে ধান বিক্রি করতে হলে পরিবহন এবং শ্রমিক খরচ দিতে হয়। এছাড়া ধানের আর্দ্রতা থাকতে হয় ১৪ শতাংশের মধ্যে।
এদিকে জেলা সদরের ভবানীগঞ্জ, মান্দারী, রায়পুরের মোল্লারহাটসহ বেশ কয়েকটি ধানের বাজার ঘুরে ধান বেচা-কেনার জমজমাট চিত্র দেখা গেছে। গুদামের থেকেও কৃষকরা সেখানে উচ্চ মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারছেন।
সদর উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, ধান সংগ্রহের কার্যক্রম আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করিনি। তবে কৃষকদের মধ্যে লটারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক আনুষ্ঠানিকভাবে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। সে অপেক্ষায় আছি।
জাতীয়ভাবে উদ্বোধন হওয়ার পরও জেলাপর্যায়ে উদ্বোধনের অজুহাতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিসি স্যার, ইউএনও স্যার এবং ডিএফও স্যার চাচ্ছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেই ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করতে।
খোলা বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় কৃষক গুদামে আসছেন না জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, কৃষকরা গুদামে ধান নিয়ে আসছেন না। বাজারে মূল্য কিছুটা বেশি হওয়ায় কৃষকরা সে দিকেই ঝুঁকছেন। সারাদেশেই ধানের মূল্য বাড়তি থাকায় গুদামগুলো ধান সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
চাল সংগ্রহের বিষয়ে একই সংকটের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মিল মালিকরা চুক্তি করেছেন চাল দেওয়ার জন্য। কিন্তু সরকারি দামের চেয়ে খোলা বাজারে বেশি দাম পাওয়ায় অনেক মিল মালিক চাল দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। তবে চুক্তি অনুযায়ী চাল না দিলে তাদের বিরুদ্ধে নিয়ম মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।
কমলনগরের হাজিরহাট খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারেকুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) থেকে সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মাত্র পাঁচ-ছয় টন ধান পেয়েছি। তবে এ এলাকার অনেক কৃষকের ধান এখনো ক্ষেতে। তাই ধান সংগ্রহে দেরি হয়েছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ মো. হুমায়ুন কবির বাংলানিউজকে বলেন, বাজার দরের সঙ্গে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা আশাবাদী।
উল্লেখ্য, চলতি মৌসুমে জেলায় ৮১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। এবার চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৩৭ হাজার ৯২৫ মেট্রিক টন। প্রায় ৮০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে বলে কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২৩
এসআই