বার বার দুঃসময়ে পীড়িত চাষিরা বলছেন, নিয়ম অনুসারে এ সময়টাতেই হাওরজুড়ে স্বপ্নের ফসল বোনার কথা তাদের। অথচ, ফসলের মাঠ প্রস্তুত ও বীজ বোনার সময় পার হতে চললেও হাওর থেকে অকাল বন্যার পানি নামছে না কিছুতেই!
নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখনও জলের উথাল-পাতাল ঢেউ কেটে বিকট শব্দ তুলে ভেসে যাচ্ছে একের পর এক মালবোঝাই কার্গো ও যাত্রীবাহী ট্রলার! আর ফসল বুনতে না পেরে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষকেরা।
এ পরিস্থিতিতে দু’দফার বন্যায় নিঃস্ব কৃষকদের আশঙ্কা, আগামী বোরো মৌসুমেও ঘরে ফসল তোলা সম্ভব না হলে হাজার হাজার হাওরবাসী বাঁচবেন কিভাবে?
এর ওপরে হাওরের কোথাও এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজও। হাওরবাসীর অভিযোগ, সঠিক সময়ে অক্টোবর/নভেম্বর থেকে বাঁধগুলো নির্মাণের কাজে হাত দিয়ে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করা গেলে বাঁধ ও ফসল দু’টিই রক্ষা সম্ভব হয়। কিন্তু অসময়ে কাজে হাত লাগান সংশ্লিষ্টরা, পরে অসম্পূর্ণ থাকে। আর শেষ সময়ে যদি কোনোভাবে কাজ সম্পূর্ণ হয়েও যায়, তখন আর সেই বাঁধে ফসল রক্ষা হয় না। ফলে বন্যায় হাওরের হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে যায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়নি বলেও অভিযোগ স্থানীয় কৃষকসহ জনপ্রতিনিধিদের।
পাউবো যে অর্থ বরাদ্দ করেছে, তা অত্যন্ত নগণ্য বলে বাংলানিউজের কাছে মন্তব্য করেছেন খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সামছুজ্জামান তালুকদার শোয়েব।
তিনি বলেন, উপজেলার কীর্তনখোলা, চৌতারা, জগন্নাথপুর ঢালা, কৃষ্ণপুর, নাওটানা খালসহ আরও কয়েকটি বাঁধ নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন প্রকল্প। ওই প্রকল্পের কাজের জন্য সদর দফতরে ১০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা চাহিদা পাঠিয়েছিল নেত্রকোনা পাউবো। কিন্তু সেখান থেকে চাহিদা এসেছে মাত্র ২ কোটি ৮১ হাজার টাকা! বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে এবং কাজ সম্পন্ন হবে কিভাবে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাঁধ রক্ষায় অর্থ বরাদ্দে পাউবোর টানাপড়েনে কাজ সম্পূর্ণ না হলেও বন্যা আবার ঠিকই হবে। এখন অনেকেই সরকারের বিভিন্ন সহায়তায় অন্তত প্রাণে বেঁচে আছেন। কিন্তু ফের ফসল হারালে শুধু হাওরবাসী কেন সারাদেশে হাহাকার পড়ে যাবে। খাদ্যের অভাবে না খেয়ে মারা যাবেন মানুষ।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু তাহের নিজ দফতরের অপারগতার কথা স্বীকার করে জানান, হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দা উপজেলায় ডুবন্ত ও অস্থায়ী মিলিয়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ আছে ২৭১ কিলোমিটার। এসব মেরামতে প্রধান কার্যালয়ে ১৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল, বিপরীতে পাওয়া গেছে মাত্র ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা!
স্থানীয় কৃষকদের মতে, ওইসব এলাকার ৫০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল রক্ষা এবং বন্যায় তলিয়ে যাওয়া পুরোটাই নির্ভর করে শুধু বাঁধগুলো টিকে থাকা আর না থাকার ওপরে। প্রতি মৌসুমে বন্যার কবলে পড়ে এভাবে ফসল হারিয়ে তারাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। বরং খাদ্য ঘাটতির প্রভাব পড়ছে গোটা দেশে। ফলে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে গিয়ে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিতে পড়ছে এ দেশ।
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. মো. মুশফিকুর রহমান জানান, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজে বরাদ্দ বাড়াতে পাউবোর মহাপরিচালককে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কি হবে না হবে, খুব শিগগিরই জানা যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৭
এএসআর