লালমনিরহাট: বিভিন্ন সবজির ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ট্রাকে ট্রাকে ঢাকাসহ সারাদেশে যাচ্ছে লালমনিরহাটের চাষিদের উৎপাদিত সবজি। আশানুরূপ ফলন হলেও বাজারে দাম কমে যাওয়ায় চাষিরা হতাশ।
জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা লালমনিরহাট জেলার ৫ উপজেলায় সবজির ব্যাপক চাষাবাদ হয়। শীতকালে মাঠজুড়ে থাকে বিভিন্ন জাতের সবজির ক্ষেত। ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, বেগুন, লাউ, শিম, টমেটো, গাজর, করলা, শসা, বরবটি ও আলুসহ নানান জাতের সবজির চাষাবাদ করেন চাষিরা। জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন ট্রাকে ট্রাকে ঢাকা ও বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামসহ সারা দেশে চলে যায় এ জেলার চাষিদের উৎপাদিত সবজি। দিনভর চাষিদের মাঠ থেকে এসব সবজি ক্রয় করে রাতে ট্রাকে ভড়িয়ে পরদিন ভোরে রাজধানীবাসীকে টাটকা সবজি পৌঁছে দেন ব্যবসায়ীরা। সবজিকে ঘিরে মৌসুমী ব্যবসাও শুরু করেন অনেকেই। শীতের চার মাস চলে তাদের সবজি কেনা-বেচার ব্যবসা। চাষিরা জানান, শীতের শুরুতেই বাজারে সবজি পাঠাতে আগাম জাতের সবজি চাষাবাদ করেন জেলার চাষিরা। প্রথম দিকে বেগুনে বাজার দর ভালো থাকায় বেশ মুনাফা পেলেও বর্তমানে বেগুনের বাজরে ধস নেমেছে। এখন প্রতি মণ বেগুন ক্ষেতে বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে ৩শ টাকা দরে।
আলুর আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বেগুনসহ সব সবজির বাজারে দরপতন ঘটছে বড় কমলাবাড়ি গ্রামের চাষি করিম মিয়া ২৭ শতাংশ জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। প্রথম দিকে দাম ভালো থাকলেও এখন বাজারে দরপতন ঘটায় খুব একটা মুনাফা হচ্ছে না তার।
তবে, বিগত বছরের তুলনায় এবার বেগুনেও মুনাফা পাচ্ছেন না চাষিরা। সারাদেশে একযোগে আলুসহ সব সবজি বাজার দখল করায় হঠাৎ করে সবজির বাজারে দরপতন ঘটেছে বলেও জানান চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
এখন ফুলকপি সংগ্রহের শেষ মৌসুম চলছে। ফুলকপি চাষে প্রতি ২৭ শতাংশ জমিতে ৩ হাজার ২/৪শ চারা রোপণ করলেও ফল পাওয়া যায় প্রায় দুই হাজার ৮/৯শ পিস। প্রতি পিস ফুলকপি চাষাবাদে খরচ পড়ে ৬/৭টা পর্যন্ত। এখন চাষিদের ফুলকপি ক্ষেতেই বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ২/৩ টাকা দরে। ফলে মুনাফা তো দূরের কথা উৎপাদন খরচও পাচ্ছেন না চাষিরা। সদর উপজেলার মোগলহাট এলাকার চাষি আমিনুর, সহিদুল ও রহমান বাংলানিউজকে জানান, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে টাকা পয়সা খরচ করে চাষাবাদ করেও মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে না। আগাম জাতের ফুলকপিতে সামান্য কিছু মুনাফা হলেও এখন উৎপাদন খরচও আসছে না। বিগত বছরের তুলনায় এবার বীজের দাম অনেক বেশি। সে হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন খরচও বেড়েছে। উৎপাদন খরচ অনুপাতে সবজির বাজার নিম্নমুখি। ফলে মুনাফা পাচ্ছেন না চাষিরা।
একই এলাকার চাষি জব্বার, মমিনুল ও আব্দুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, ফুলকপি চাষাবাদ করতে বীজ থেকে ক্ষেতে বিক্রি পর্যন্ত খরচ পড়ে প্রতি পিস ৫/৬ টাকা। অথচ বর্তমান ফুলকপির বাজার প্রতি পিস মাত্র ২/৩ টাকা। কয়েক দিন আগেও প্রতি পিস ফুলকপি ৫/৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন দিনদিন বাজার নিম্নমুখি হওয়ায় ফুলকপি ক্ষেতে লোকসান গুনতে হচ্ছে। সময়মত ফুলকপি বিক্রি করতে না পারলে ক্ষেতেই নষ্ট হয়। তাই মুনাফা না হলেও বিক্রি করতে হচ্ছে। সবজি হিমাগার থাকলে এসব সবজি সংরক্ষণ করে ধীরে ধীরে বাজারের চাহিদামত বিক্রি করা সম্ভব হত। তাই সবজি এলাকাখ্যাত এ অঞ্চলে সবজি হিমাগার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান তারা। চাষিদের ফুলকপি ক্ষেতেই প্রতি পিস হিসাবে ক্রয় করে তা ট্রাকবোঝাই করে সারাদেশের পাইকারী বাজারে সরবরাহ করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। অনেক সময় চাষিদের সবজি বাকিতে কেনার পরে ঢাকায় বিক্রি করেই তবে পাওনা পরিশোধ করেন ব্যবসায়ী। বর্তমানে ক্ষেতেই প্রতি পিস ২/৩ টাকায় কিনে তা ক্ষেত থেকে ঢাকা পৌঁছাতে প্রতি পিস পরিবহন খরচ পড়ে ৫ টাকা। সবমিলে প্রতি পিস ফুলকপি ঢাকা পৌঁছতে ৭/৮টাকা মূল্য দাঁড়ায়। ঢাকায় আড়তদারদের শতকরা ১০ টাকা কমিশন দিয়ে এসব সবজি বিক্রি করতে হয়। এর কারণে ক্ষেতে সবজির দাম কম থাকলেও ঢাকায় উচ্চমূল্যে বিক্রি হয় সবজি। সরাসরি সবজি বিক্রির সুযোগ তৈরি হলে শতকরা ১০ টাকা কমে ঢাকাবাসী সবজি পাবেন বলে দাবি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।
সবজি ব্যবসায়ী মজিদুল ইসলাম জানান, ক্ষেতেই ফুলকপি ক্রয় করে তা বিক্রিযোগ্য করে ঢাকায় পৌঁছাতে অতিরিক্ত খরচ পড়ে ৫ টাকা। এরপর ঢাকায় পৌঁছালে আড়তদার তার নিজস্ব শ্রমিক দিয়ে ফুলকপি পাইকারী বিক্রি করেন। বিনিময়ে আড়তদার পাবেন শতকরা ১০ টাকা। সারাদেশে একযোগে আলুসহ সব সবজি বাজারে উঠায় সবজির বাজারে দরপতন ঘটেছে।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শামীম আশরাফ বাংলানিউজকে জানান, ৬ হাজার ৪শ হেক্টর জমিতে সবজি চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলে শতভাগ অর্জন হয়েছে। আগাম উৎপাদিত সবজির বাজারমূল্য ভালো থাকায় কৃষকরা বেশ লাভবান হয়েছেন। তবে, বর্তমান সব সবজি বাজারে আসায় দাম কিছুটা কমে যাওয়ায় খুব একটা মুনাফা করতে পারছেন না চাষিরা।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১
এএটি