ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

বাগেরহাটে লবণাক্ত এলাকায় সৌদি খেজুর চাষে সফলতা

এস.এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৮ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২১
বাগেরহাটে লবণাক্ত এলাকায় সৌদি খেজুর চাষে সফলতা

বাগেরহাট: উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের একটি উপজেলা রামপাল। যেখানের নদী ও খালে সব সময় লবণ পানি থাকে।

যার ফলে এ উপজেলায় চিংড়ি ভালো হলেও কোনো ফল, ফসল তেমন ভালো হয় না। অধিকাংশ মৎস্য ঘেরের পাড় অনাবাদী পড়ে থাকে বছরের পর পর।  

সেই রামপালের সন্ন্যাসী হাজিপাড়ায় সৌদি আরবের খেজুর চাষ করে সারা ফেলেছেন বাগেরহাট জেলা জজ আদালতের আইনজীবী দিহিদার জাকির হোসেন।  

দুই বছরেই ফল এসেছে তার অনেক গাছে। ১৫ একর মৎস্য ঘেরের খামারের কাতিতে (বেড়িবাঁধ) এখন আড়াই হাজারের মত গাছ রয়েছে জাকিরের। লবণ পানির এলাকায় সৌদির খেজুর চাষের সফলতাকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ ও কৃষি ক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে কৃষি বিভাগ। স্থানীয়রা আশায় বুক বাঁধছেন- ঘেরের পাড়ের বেড়ি উঁচু করে লাগাবেন সৌদি খেজুরের চারা।

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার সন্ন্যাসী হাজিপাড়া এলাকায় ২০১৪ সালে পরিকল্পিতভাবে মৎস্য চাষের জন্য খামার করেন আইনজীবী দিহিদার জাকির হোসেন। ১৫ একর জমিতে নয়টি পুকুর খনন করেন। খননকৃত মাটিতে উঁচু হওয়া পুকুরের পাড়ে পেঁপে, বড়ইসহ বিভিন্ন ফলজ গাছ রোপণ করেন। কিন্তু লবণ পানি ও নানা রোগ বালাইয়ে কারণে এসব ফসলে তেমন ভালো করতে পারেননি তিনি।

 

অন্যদিকে, অতিরিক্ত লবণ পানির কারণে ঘেরে গলদা বা কার্প জাতীয় মাছ না হওয়ায় শুধু বাগদা চাষে মনোযোগ দেন তিনি। বছর তিনেক বাগদা চিংড়ির উৎপাদন ভালো হলেও, পরের মৌসুমে ভাইরাসের কারণে বড় ধরনের লোকসানে পড়েন তিনি। ভাবতে থাকেন কি করবেন, এত বড় জমিতে। একপর্যায়ে সৌদির খেজুর চাষের বিষয়টি মাথায় আসে তার। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ২০০ সৌদি খেজুরের চারা এনে রোপণ করেন তিনি। পরে নরসিংদী থেকে আরও ১০০ চারা আনেন এ আইনজীবী। বর্তমানে ৫০টি খেজুর গাছে ফল এসেছে। এক বছরের মধ্যে অন্তত আরও ২০০ গাছে ফল দেওয়া শুরু হবে। খেজুরের পাশাপাশি ভিয়েতনামি নারকেল, কয়েক প্রজাতির আম, আমড়া, মাল্টাসহ বেশ কিছু ফলের চাষ করেন তিনি। এর পাশাপাশি খামারে রয়েছে ৩০টি দেশি গরু। এসব দেখভালের জন্য এখানে রয়েছে শহিদুল ইসলাম, শিবপদ ও লাল মাহমুদ নামের তিন শ্রমিক। যারা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন এখানে।

শ্রমিক শহিদুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালের প্রথম দিকে স্যার সৌদি খেজুরের চারা লাগালেন। বিষয়টি এলাকার মানুষ জানার পরে আমাদের নিয়ে ট্রল করত। স্যার পাগল বলে আমাদের খেপাত। কিন্তু স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে আমাদের এখানে লাগানো প্রতিটি গাছ বেঁচে রয়েছে। আজ গাছে ফল এসেছে। অনেকেই আসে দেখতে। প্রথম দিকে পাগল বললেও এখন সবাই স্যারকে বাহবা দেয়। আমরা সার্বক্ষণিক স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক গাছের গোড়ায় জৈব সার, পানি ও বিভিন্ন প্রকার ওষুধ দিয়ে থাকি।

আইনজীবী দিহিদার জাকির হোসেন বলেন, মাছ এবং অন্যান্য ফল যখন ভালো হয়নি, তখন এক ধরনের হতাশায় পড়েছিলাম। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে রামপাল সৌদি খেজুর বাগান নাম দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু করি। বর্তমানে আজোয়া, মরিয়ম, সুকারি, আম্বার ও বারহি এ পাঁচ জাতের খেজুর রয়েছে আমার বাগানে। ময়মনসিংহ ও নরসিংদী থেকে আনা ৩০০ গাছের পাশাপাশি আরও দুই হাজারের ওপরে চারা লাগিয়েছি। যেগুলোর মধ্যে বিচি থেকে উৎপাদিত চারা ও অপশুট (কলম-খেজুর গাছ থেকে এক ধরনের চারার মত বের হয়, এগুলো থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে নতুন চারা তৈরি করা হয়) রয়েছে। এগুলোতেও ফল আসবে। এছাড়া বিচির তৈরি আরও আড়াই হাজার চারা প্রস্তুত রয়েছে আমার নার্সারিতে। আগামী এক বছরের মধ্যে বাগানের অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ গাছে খেজুর হওয়া শুরু করবে। এ বছরই অনেক গাছে ২৫ কেজি থেকে ৩৫ কেজি পর্যন্ত খেজুর পাব বলে আশা করছি। সব মিলিয়ে আগামী বছরের মধ্যে বাগান থেকে লাভে যেতে পারব।

আপাতত চারার দাম সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে চান না জানিয়ে দিহিদার জাকির হোসেন আরও বলেন, শীত ও বৃষ্টির মৌসুমে পানি দিতে হয় না খেজুর বাগানে। প্রচুর গরম অর্থ্যাৎ মার্চের মাঝামাঝি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে সেচ দিতে হয়। গভীর নলকূপের মাধ্যমে এ পানি উঠানো হয় দুই হর্স পাওয়ার মোটর দিয়ে। এতে মাসিক প্রায় দুই হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল গুণতে হয় তাকে। নৈশ প্রহরী লাল মাহমুদের মাসিক বেতন ১০ হাজার, দুই শ্রমিকের মাসিক বেতন ১২ হাজার করে।

স্থানীয় হাবিবুর রহমান, আব্দুল লতিফ, আব্দুস ছালামসহ কয়েকজন বলেন, প্রথম দিকে দিহিদার ভাইয়ের কাজ দেখে আমরা হতভাক হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, টাকার গরমে যা ইচ্ছে তাই করছেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, তিনি অনেক দূরদর্শী মানুষ। আমরা চিন্তা করছি একটু কায়দা করে নিজেদের ঘেরের পাড়েও লাগাব সৌদির খেজুর।

সৌদির খেজুর চাষের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জাকির হোসেন বলেন, এটি যেহেতু মরুভূমির গাছ, যার ফলে আমাদের এই অঞ্চলে খাপ খাওয়াতে একটু বেগ পেতে হয়। গাছের গোড়ায় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি দিতে হয়, পানি কম হলেও বাঁচবে না, আবার বেশি হলে পচে যাবে। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব। নারকেল ও শুপারি গাছের নতুন রোগ হোয়াইট ফ্লাই ও শূতিমূলের আক্রমণটা বড় ভয় এ খেজুর গাছের। এ জন্য সব সময় খেয়াল রাখতে হয়। প্রয়োজনীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এর সঙ্গে রয়েছে ইঁদুরের জ্বালাতন। খেজুর গাছের শিকড় কেটে দেয়, আবার ফলও কাটে। ইঁদুরের জন্যও আমাদের সতর্ক থাকতে হয়।

নতুন কেউ সৌদির খেজুর চাষ করতে চাইলে তাদের জন্য জাকির হোসেনের পরামর্শ, কলম এবং বিচি দুইভাবেই সৌদির খেজুরের চারা তৈরি হয়। এ বিচির চারার বেশিরভাগ পুরুষ হয়ে যায়। যার ফলে ফল আসে না। তাই নতুন যারা শুরু করবেন, তাদের কলমের (অপশুট) চারা কিনতে হবে।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সৌদির খেজুর মরুভূমির ফসল। আপত দৃষ্টিতে দিহিদার জাকির হোসেন এ খেজুর চাষে সফলতা পেয়েছেন। তবে এ খেজুরের স্বাদ, পুষ্টিগুণ ও উৎপাদনের পরিমাণ ঠিক থাকলে লবণাক্ত পানি অধুষ্যিত এলাকার জন্য এটি একটি দৃষ্টান্ত হবে। তার এ উদ্যোগকে আরও বেশি সফল করার জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২১
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।