ক্যাম্প শব্দটি শুনলে মনের ভেতর যে ছবি ফুটে উঠে তা গম্ভীর এবং আবদ্ধতার। কিন্তু রাজধানীর ক্ষিলক্ষেতের বেঙ্গল সেন্টারে যে আর্ট ক্যাম্প শুরু হয়েছে তা দেখলে যে কারুর ক্যাম্প সম্পর্কে আগের ধারণা বদলে যোতেও পারে।
এটি সত্যি একটা মেলা। তবে গ্রামের বারোয়ারি মেলা নয়; এটি শিল্প আর শিল্পীর মেলা। মেলাটির নাম ‘বেঙ্গল আর্ট ক্যাম্প’। এর শুরু ২৯ জুলাই, শেষ ১ আগস্ট।
বেঙ্গল সেন্টারে প্রবেশ পথে চোখে পড়ে একটা বড় লতানো রাবার গাছ যার গোড়াটা গোল করে বাঁধানো । গাছের নিচে শিল্পীরা বসেছেন রঙ আর তুলির পসরা সাজিয়ে। কেউ আবার বসেছেন সবুজ ঘাসে। সবাই নিমগ্ন হয়ে ছবি আঁকছেন। তাদের প্রত্যেককে চার দিনে কমছে কম দুইটা ছবি আঁকতে হবে। আবার সেসব ছবি নিয়ে আয়োজন করা হবে প্রদর্শনীর।
সেন্টারটির মূল ভবনের নিচতলাটা খুব খোলামেলা। এখানেও শিল্পীরা তাদের নিজেদের কাজ করছেন। পাশে আছে চা-কফির ব্যবস্থ। শিল্পী রফিকুননবী এসেছেন একজন বিদেশিনীকে নিয়ে তিনি ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর অভিভূত হচ্ছেন।
সুপরিসর পুকুরের স্বচ্ছ জলে সবুজ গাছের ছায়া। তার পাড়ে বসে-দাঁড়িয়ে শিল্পীরা ছবি আঁকছেন মন খুলে । শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার দেখছেন নবীণ শিল্পীদের উচ্ছ্বাস ও আঁকা আর দেখছেন প্রকৃতি। বাংলাদেশ ও ভারতের নবীন-প্রবীণ শতাধিক শিল্পীর অংশগ্রহণে এ সৃষ্টিযজ্ঞ সবার জন্যই একটা দেখার মতো ব্যাপার বটে।
‘এসেই খেতে বসেছেন বাড়িতে কি চাল-ডাল কিছু নাই না কী?’ কথাগুলো বলছিলেন ভারতের শিল্পী জয়শ্রী চক্রবর্তী আরেক ভারতীয় শিল্পী লালুপ্রসাদ সাউকে। উত্তরে সাউ বললেন, ‘বাড়ির কর্তামশাই তো এ কথা বলবেনই। ’ উত্তর শেষ হওয়ার আগেই খাবার কক্ষে হাসির রোল পড়ে গেল। দুজন ভারতীয় শিল্পীর মজা করার এই ছোট্ট বিষয় থেকে বোঝা যায় শিল্পীরা এ আয়োজনকে কত আপন মনে করেছেন!
খাবার কক্ষের পাশে প্রবীণ শিল্পীরা আঁকছেন। শিল্পী হাশেম খানকে দেখা গেল অনেক সময় নিয়ে বড় ক্যানভাসকে গুছিয়ে নিচ্ছেন।
দেশের প্রায় অধিকাংশ বরেণ্য-প্রবীণ শিল্পী যেমন আছেন এ ক্যাম্পে, তেমনি আছেন তরুণ ও প্রবাসী শিল্পীরা। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা শ খানেক। আর ভারত থেকেও এ ক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন জনাবিশেক শিল্পী। এর মধ্যে আছেন বিশিষ্ট শিল্পী যোগেন চৌধুরী, গণেশ হালুই, সুনীল দাস, রবীন ম-ল, লালুপ্রসাদ সাউ, দিপালী ভট্টাচার্য, আদিত্য বসাক, ননি বরপুজারী, ছত্রপতি দত্ত, তাপস কোনার, সমির আইচ, ব্রত্ততী মুখার্জী, সমিন্দ্রনাথ মজুমদার।
‘কালি ও কলম’ পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বক্তব্যে বলেন, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকর্ম থেকে আমাদের প্রেরণা নিতে হবে এবং তাকে নানাভাবে উপলব্ধি করে কাজ করতে হবে। বস্তুত এখানকার সমস্ত আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু রবীন্দ্রনাথ।
নবীণ-প্রবীণদের এর এই মিলনমেলা খুব উপভোগ করছেন এমিরিটাস অধ্যাপক শিল্পী যোগেন চৌধুরী। তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাঙালি এক দিনও চলতে পারবে না । ক্যাম্প সম্পর্কে তিনি বলেন, এমন আয়োজন আমার বয়সে আমি দেখি নাই।
এক প্রশ্নের উত্তরে লুভা নাহিদ চৌধুরী জানান, ‘আমাদের কার্যক্রম শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ নয়, কলকাতায় নিয়মিত নানা রকম আয়েজন হয়। আগস্টে কানাডায় একটি প্রদর্শনী আছে। মালয়েশিয়ায় আমাদের কার্যক্রম আছে। আরও জানালেন, আগামী বছর সাভারে আমরা একটি জাদুঘর উদ্বোধন করব, যেখানে এ যাবৎ আমাদের আয়োজিত সব চিত্রকলা, সঙ্গীত এবং প্রকাশনা বাছাইকৃত শিল্পকলা সংরক্ষিত থাকবে। ’
১৪১৮ সনের ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী। এই উপলে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজন করেছে বছরব্যাপী উৎসবের । এই উৎসব শুরু হয়েছে ২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় বেঙ্গল সেন্টারে। এ আর্ট ক্যাম্প উদ্বোধন করেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং এমিরিটাস অধ্যাপক শিল্পী যোগেন চৌধুরী। বেঙ্গল সাংস্কৃতিক উৎসব ও বেঙ্গল গ্যালারির দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয়েছে এ ক্যাম্প । এই আর্ট ক্যাম্পটি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলে উৎসর্গীকৃত।
আর্ট ক্যাম্পে ছবি আঁকার পাশাপাশি ছিল চিত্রকলা সম্পর্কে আলোচনা। এ ইপলক্ষে একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত ৩১ জুলাই সন্ধ্যায়। যেখানে শিল্পী ও সমালোচকরা বাংলা চিত্রকলার ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় উঠে আসে উভয় বাংলার চিত্রকলার অর্জন, গৌরব এবং ইতি ও নেতিবাচক প্রবণতার নানা দিক। আলোচকদের অন্যতম ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, যোগেন চৌধুরী ও আবুল মনসুর।
ক্যাম্প উপলক্ষে প্রতিদিনই ছিল গানের আসর। গান গেয়েছেন শিল্পী মিতা হক, শামা রহমান, বুলবুল ইসলাম, ইফ্ফাত আরা দেওয়ান, মহিউজ্জামান ময়না, লাইসা আহমদ লিসা।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১১৫০, আগস্ট ০১, ২০১০