ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

পূর্ণ বুদ্ধদেবের সন্ধানে | পিয়াস মজিদ

গ্রন্থালোচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৬
পূর্ণ বুদ্ধদেবের সন্ধানে | পিয়াস মজিদ

বুদ্ধদেব বসু খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সমালোচক ছিলেন।

বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি হিসেবে তিনি সমাদৃত। ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর জন্ম নেওয়া এ সাহিত্যিক ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

তার প্রয়াণদিবসে কন্যা দময়ন্তী বসু সিং সম্পাদিত “বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য ‘কবিতা’ থেকে” গ্রন্থের উপর আলোচনা লিখেছেন কবি পিয়াস মজিদ। ২৫৩ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি ২০১০ সালে কলকাতা বইমেলায় বিকল্প প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। নন্দিত এ সাহিত্যিকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে আলোচনাটি বাংলানিউজের পাঠকের জন্য প্রকাশিত হলো।


কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক বুদ্ধদেব বসুর আরেক উজ্জ্বল পরিচয় সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু। তার সম্পাদিত কবিতা পত্রিকা আজ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৬১ কালপর্বে কবিতা শুধু টিকে থাকার জন্যই টিকে থাকেনি, বরং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পাটাতন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আধুনিক বাংলা কবিতা আন্দোলনে বেগ দেওয়ার পাশপাশি কবিতা আধুনিক সমালোচনার রুচিও নির্মাণ করেছে অনেক ক্ষেত্রে আর কবিতা পত্রিকার মহার্ঘ সম্পাদকীয়গুলো একজন বোদ্ধা ও যোদ্ধার মেধা, শ্রম ও লড়াইয়ের নিদর্শন। ধন্যবাদ বুদ্ধদেব বসুর সুযোগ্য কন্যা দময়ন্তী বসু সিংকে। তিনি অগ্রন্থিত গদ্য সিরিজে আমাদের সামনে পেশ করেছেন কবিতা পত্রিকার সম্পাদকীয় ও সমালোচনাকে। এখন পাঠকের জন্য পূর্ণ বুদ্ধদেব বসুর অবয়ব কল্পনা সহজ হবে।  

দু’টি অংশে বিন্যস্ত এ বইয়ের প্রথমাংশে সম্পাদকীয় এবং দ্বিতীয়াংশে রয়েছে সমালোচনা। কবিতার বর্ষ ৬ সংখ্যা ৪ থেকে শুরু করে বর্ষ ২০ সংখ্যা ২ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আলোচ্য বইয়ে। গ্রন্থিত সম্পাদকীয় ভাষ্য থেকে একজন শিল্পী ও কর্মীর উপস্থিতি টের পাই আমরা। দেখা যাচ্ছে, সম্পাদক বিশ্বভারতীর ভবিষ্যৎ বিষয়ে যেমন ভাবিত তেমনি অসুস্থ কবি হেমচন্দ্র বাগচীর সহায়তার জন্য পাঠকের সুদৃষ্টি আকর্ষণে তৎপর। সুকান্তের কবিতার শিল্পমূল্য বিশ্লেষণে যেমন তিনি আগ্রহী, তেমনি ঢাকার রাস্তায় সোমেন চন্দর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদমুখর।

সমাজ-রাজনীতি ইত্যাদি বিযুক্ত নিরঞ্জন সাহিত্যের কথা বললেও বুদ্ধদেব বসু কবিতার সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে একজন সৎ শিল্পীর মতোই তার বিবেককে জাগ্রত রেখেছিলেন। তিরিশি আধুনিক বাংলা কবিতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোহিতের পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যখন অপেক্ষাকৃত ‘প্রাচীন’ হেমচন্দ্র বাগচী, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন প্রমুখ চলে আসেন, তখন সালাম জানাতে হয় বুদ্ধদেব বসুর লেখক চেনার ক্ষমতাকে। তার কাছ থেকে আমাদের সাহিত্য সাময়িকপত্রের সম্পাদকদের ভিন্ন রুচি অধিকারকে স্বীকার করার সহিষ্ণুতা জরুরি শেখার বিষয় বলে মনে করি।

এ বইয়ের ‘সমালোচনা’ অংশটিও বুদ্ধদেব বসুর বিচিত্রগামী মননেরই সাক্ষ্য। এ অংশে চোখ বেলালেই বুঝতে পারা য়ায়, কাব্যগ্রন্থ বা কাব্যসংকলন তার সমালোচনার প্রিয় প্রসঙ্গ। তবে এর পাশাপাশি সংগীত সংকলন, সহজ চিত্রশিক্ষার বই, ইতিহাসের বই, জীবনীগ্রন্থ, স্কুলপাঠ্য পুস্তক, স্মৃতিকথা ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমের বই নিয়ে তিনি কলম ধরেছেন কবিতায়। কবিতার শিল্পমূল্য নিয়ে যেমন তিনি সংবেদী আলোচনা করেন, তেমনি সাহিত্যের ইতিহাস বর্ণনায় কবিদের সম্প্রদায়গত বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার তার কণ্ঠ। চৈত্র ১৩৪৯ সালের বর্ষ ৮ চতুর্থ সংখ্যায় বিশ্বভারতী প্রকাশিত নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামীর বাংলা সাহিত্যের কথা বই নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গিগত সীমাবদ্ধতা শনাক্ত করেন এভাবে, ... “...আলোচ্য গ্রন্থে নজরুল ইসলামের জায়গা হয়েছে ‘মুসলমান কবি’দের পুরোভাগে, যেখানে তাঁর জায়গা হওয়া উচিত ছিলো মোহিতলাল মজুমদার ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের আগে। এতে নজরুল ইসলামকে যে কতখানি ছোটো করা হয়েছে তাও কি ব’লে দিতে হবে? নজরুল ইসলাম কেন ‘মুসলমান কবি’ হবেন- মধুসূদন দত্ত কি ‘খ্রীষ্টান কবি’?” (পৃ. ১৫৮)

বুদ্ধদেব বসুর গ্রন্থ-সমালোচনায় হেমচন্দ্র বাগচী, অজিত দত্ত, মনীশ ঘটক, জগদীশ ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ, অন্নদাশঙ্কর রায়, দীনেশ দাস, প্রজেশকুমার রায়, প্রতিমা ঠাকুর, শিবনারায়ণ রায়, নরেশ গুহ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, হুমায়ুন কবির থেকে শুরু করে ঢাকার ওয়ার্সী বুক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশিদ খান সম্পাদিত নতুন কবিতাও স্থান পেয়েছিল। সমালোচক বুদ্ধদেবের দৃষ্টিপরিসর এ তালিকা থেকে সহজে অনুমেয়। এ বইয়ের প্রাক্কথনে দময়ন্তী বসু সিং জানাচ্ছেন, তার আগ্রহ কবিতা পত্রিকার অবিকৃত গ্রন্থাকারে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করা। আমরা প্রত্যাশায় রইলাম।



বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।