ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ছোট গল্পে মোস্তফা কামাল | মো. শাহাদাত

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৬ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৬
ছোট গল্পে মোস্তফা কামাল | মো. শাহাদাত

সময়ের কালস্রোতে জীবন সমুদ্রের অসংখ্য তরঙ্গের মধ্যে দু’একটি তরঙ্গকে ফুটিয়ে তোলার অভিপ্রায়েই ছোটগল্পের আর্বিভাব। গল্প বলা ও শোনা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি।

সম্ভবত এখানেই নিহিত ছিলো ছোটগল্পের অর্ন্তনিহিত বীজ। যার সূত্রপাত আমরা লক্ষ্য করি ঈশপের গল্প, ফেবল, জাতক, কথাসরিৎসাগর, পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ কিংবা রূপকথার গল্পগুলোতে। তবে আধুনিক ছোটগল্প বলতে যা বোঝায় তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ডিকেন্স, গোগল, পো থেকে শুরু করে মোপাসা, চেখভ, কিংবা রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত্। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আধুনিক ছোটগল্প আসলে কী? এর উত্তরে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ছোটগল্প হচ্ছে প্রতীতিজাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্যকাহিনী যার একতম বক্তব্য কোনো ঘটনা বা পরিবেশ বা কোনো মানসিকতাকে অবলম্বন করে ঐক্য-সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতা লাভকরে’। আমাদের সমসাময়িক কথাশিল্পী মোস্তফা কামালের ছোটগল্পে উল্লিখিত উক্তিরই প্রতিধ্বনি লক্ষ্য করা যায়।     

সমসাময়িক কালের একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ লেখক মোস্তফা কামাল মূলত উপন্যাস লিখেই তার হাত পাকিয়েছেন এবং উপন্যাসের মাধ্যমেই পেয়েছেন লেখক খ্যাতির অভিধা। তবে তার গল্প রচনার প্রয়াস পাঠক সমাজকে একেবারেই হতাশ করেনি। সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি একদিকে যেমন সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশের রুঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন অন্যদিকে, তেমনি মানবজীবন ও মনের বিচিত্র রূপকে প্রত্যক্ষ করেছেন। আর সমসাময়িক কালের এসব অভিজ্ঞতাকে নানা আঙ্গিকে ও অভিনব প্রকরণ কৌশলে তুলে ধরেছেন তার গল্পগুলোতে। অর্থাৎ বলতে পারি প্রত্যক্ষতা ও অভিজ্ঞতা এই দু’টি জিনিসকে সম্বল করে মোস্তফা কামাল এসেছেন ছোটগল্পের জগতে। সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত তার ‘ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের গল্প বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘লিরিক কবিতা যেমন একটি ভাবকে আশ্রয় করে ছোটগল্প তেমনি একটি আখ্যানকে কেন্দ্র করে। তাহার মধ্যেই সে যেনো সম্পূর্ণ হইয়া থাকে। যেসব গল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য কোনো বিশেষ ঘটনার বর্ণনা নহে, সেই সব গল্পেও একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করা হইয়া থাকে’। মোস্তফা কামালের অধিকাংশ গল্পে এই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যাবে। যেমন-
‘রুদ্র, আমাদের রুদ্র’গল্পের আখ্যান গড়ে উঠেছে ২৭তম বি.সি.এস পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এর অন্তরালে বর্ণিত হয়েছে প্রশাসনের অদক্ষতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে রুদ্র নামের এক মেধাবী ছাত্রের প্রাপ্ত চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে ট্র্যাজেডিক পরিণতির শিকার হওয়ার কাহিনি। বস্তুত ইংরেজ সরকার ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নামে যে দুই বিবাদমান রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলে অস্থিতিশীল রাজনীতির বীজ বপন করেছিলো, সেই বীজ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডালপালা বিস্তার করে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গল্পের প্রথম দিকে লেখক এই অস্থিতিশীল রাজনীতির চরিত্র তুলে ধরেছেন। বস্তুত ২০০৬ সালের দিকে চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ২৭তম বি.সি.এস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর পরে সরকার পরিবর্তন হলে পরবর্তী সরকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্রের ধারাবাহিকতায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সেই পরীক্ষার পূনঃমৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করে। আর এই অপরাজনীতির যাতাকলে পিষ্ট হয় রুদ্রের মতো মেধাবী ছাত্ররা। ‘রুদ্র মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়েছে কিন্তু কেন বাদ পড়েছে তা রুদ্র জানে না। ওকে নাকি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়নি’। (পৃ: ৭১) 
    
যে রুদ্র জীবনে কোনোদিন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়নি এবং ২৭তম বি.সি.এস পরীক্ষায় মেধা তালিকায় থেকে ট্যাক্সেশন পেয়েছিলো, সেই রুদ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়-‘পরীক্ষক ছিলেন ইউনিভার্সিটির দুই শিক্ষক। তাদের ধারণা, এই ছেলে ট্যাক্সেশন দিয়েছে ঘুষ খাওয়ার জন্য। এই ছেলের অ্যাম্বিশান খুব হাই। ও দ্রুত বড়লোক হতে চায়। ওকে চাকরিতে নিলে দেশের বারোটা বাজবে’। (পৃ: ৭২) 

এই ধরনের এক ক্ষীণ অজুহাতে এক মেধাবী ছাত্রকে তার প্রাপ্য চাকরি থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে লেখক সুচতুরভাবে দেশের কিছু শিক্ষকের নৈতিক অধঃপতনের চিত্র তুলে ধরেছেন এবং কিছুটা বিদ্রুপ করে বলেছেন, ‘দেশটাকে রক্ষা করতে হলে একটা রাশ টানা দরকার। অন্যথায় দেশকে আর বাঁচানো যাবে না। তাই রুদ্রকে পরীক্ষায় ফেল করিয়েই রাশ টানছেন’। (পৃ: ৭২) এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘কিন্তু রুদ্রকে দেখে তারা কী করে ভাবলেন যে, রুদ্র ঘুষখোর হবে’। (পৃ: ৭২) এভাবেই লেখক সূক্ষ্ম ও সুচতুরভাবে দেশের ঘুনে ধরা সমাজের বাস্তব চিত্র অঙ্কন করেছেন মাত্র কয়েকটি লাইনের মাধ্যমে।           
       
গল্পের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় চরিত্র রুদ্রের যে বিকাশ ও পরিণতি তা অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ট। পাঠক মাত্রই রুদ্রকে নিজের জীবনের সঙ্গে নিজের অজান্তেই মিলিয়ে নেয়। আর তাই রুদ্র আর রুদ্র থাকে না। পরীক্ষকের ধারণার ওপর ভিত্তি করে মেধাবী ছাত্রের জীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বাস্তব প্রতিনিধি হয়ে ওঠে সে। জীবনের চরম হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে সে যখন বিষের পেয়ালা হাতে নেয়, ‘একবার রুদ্র বিষ খাবে বলে বাজার থেকে বিষ কিনে এনেছিল’ (পৃ: ৭১) তখন আমরা আমাদের সেই বন্ধুদের আবিষ্কার করি যারা হলের সিলিং ফ্যানে ফাঁস দিয়ে বা বিষ পানে আত্মহত্যা করেছিলো মেধা থাকা সত্ত্বেও চাকরি না পাওয়ার হতাশার কারণে। এখানে পরীক্ষক নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুইজন শিক্ষক চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে তারাও একেবারে বাস্তব ও জীবন ঘনিষ্টভাবে অঙ্কিত হয়েছে। আর রুদ্রের ভাই নিলয় চরিত্রটি একেবারে গল্পের শেষে এসেও ভাতৃস্নেহে সিক্ত হয়ে ওঠে রক্ত মাংসের মানুষ। ‘রুদ্রের লাশ কাধে নিয়ে শহরময় ছুটে বেড়ালো নিলয়। বিচার চাইলো প্রকৃতির কাছে’। এভাবে মাত্র চারটি চরিত্রের সমাবেশে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিটি চরিত্রকে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন মোস্তফা কামাল।

গল্পটির রস বিচারেও লেখকের শিল্পকুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। এক করুণ রসের মাধ্যমে গল্পটি শুরু করে রুদ্রের ট্র্যাজেডিক পরিণতি, ‘ও রুদ্রকে ভ্যানগাড়িতে রেখে ছুটলো পানির সন্ধানে। পানি নিয়ে নিলয় ফিরে এসে দেখলো রুদ্র আর এই পৃথিবীতে নেই’। (পৃষ্টা; ৭৪)। একই সঙ্গে তার ভাই নিলয়ের বুক ফাটা আর্তনাদ ‘ও আমার মাটি, সবুজ গাছপালা তুমিই বলো, কী অপরাধ ছিল আমার ভাইয়ের! কেন তাকে এভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে মরতে হলো! (পৃ: ৭৪)। এক ট্র্যাজেডিক রসঘন পরিবেশ সৃষ্টি করে।

নাটকীয়তা ছোটগল্পের অন্যতম প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্য। ‘রুদ্র, আমাদের রুদ্র’ গল্পে এই নাটকীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চাকরি থেকে প্রত্যাখ্যাত রুদ্র হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নিলে পুলিশের উপস্থিতি নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে। ‘পুলিশের কাছে ঘুমের বড়িগুলো দিয়ে টিএসসির দিকে হাঁটতে লাগলো। আর ওর মরা হলো না’। (পৃ: ৭১)

আবার কখনও লেখক গল্পের এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে অ্যাবস্যার্ড এর সমাবেশ ঘটিয়ে দেশের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থাকে ধিক্কার জানিয়েছেন এক পাগলের সংলাপের মাধ্যমে। ‘এখানে এসে দেখে একটা পাগলগোছের লোক মাটি খুঁড়ছে আর বলছে, ‘ও মাটি তুমি আমাকে গ্রাস করো । ও মাটি তুমি ফাঁক হও, আমি তোমার মধ্যে ঢুকে যাই। ’ (পৃ: ৭৩) আর সে চিৎকার দিয়ে বলে, ‘ওই মসনদের লোক সকল, তোমরা কান পেতে শোন, তোমরা আমার প্রতি অবিচার করেছো! আমি তোমাদের অভিশাপ দেই। আমি তোমাদের ধ্বংস কামনা করি। ’ (পৃ: ৭৩)। বস্তুত এই অসংলগ্ন সংলাপের মাধ্যমে লেখক ঘুনে ধরা রাজনীতির ধ্বংস কামনা করেছেন।

‘আমলা কাহিনী’ গল্পটি গড়ে উঠেছে সচিবালয়ের আমলাদের দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে। দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নৈতিক অবক্ষয়ের যে বীজ উত্তপ্ত হয়েছিলো তাই যেনো আজ সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করেছে। সরকার প্রশাসনের একেবারে নিম্নস্তর থেকে শুরু করে সর্ব্বোচ্চ মহল পর্যন্ত দূর্নীতি, ঘুষ আর লুটের সংস্কৃতি বাংলার আকাশ বাতাসকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মোস্তফা কামাল সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রশাসনের এই দুর্নীতির নাড়ির খবরের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলেন। আর এই অবস্থার বাস্তব দর্পণ তুলে ধরেছেন তার ‘আমলার কাহিনী’ গল্পে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের দুর্নীতি নিয়েই গল্পের কাহিনি গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী, কর্মকর্তা এবং স্বয়ং মন্ত্রী কীভাবে দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে এবং তাদের দুর্নীতি করার কৌশলই গল্পের মূল পটভূমি। কিন্তু এর অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য আরও ব্যাপক।

গল্পটি পড়তে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’ এর কথা মনে পড়ে যায়। এক অনাথ পরাশ্রিত মুচিরাম কীভাবে সামান্য দলিল লেখকের পেশা থেকে শুধুমাত্র তেলবাজ নীতির কারণে বিশাল জমিদারি পর্যন্ত খরিদ করেছিলো তার কাহিনি লেখক অত্যন্ত রঙ্গব্যঙ্গ ও হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। বস্তুত মুচিরাম ছিলো বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ঘুনে ধরা ঔপনিবেশিক শাসনের এক জ্বলন্ত প্রতিনিধি। তারই দ্বিতীয় সংস্করণ যেনো লক্ষ্য করা যায় ‘আমলা কাহিনী’ গল্পে। আর ইদ্রিস তো মুচিরামের উত্তর পুরুষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শাসন ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে বা রাষ্ট্রের আকারের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু মুচিরামদের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মুহুরি মুচিরামের তোষণনীতিকে বঙ্কিম তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘সাহেব প্রথম আসিয়া মুচিরামের নধর সুচিক্কন শরীরটি দেখিয়া এবং তাহার আভূমিপ্রণত ডাবল সেলাম দেখিয়া নিজের সরল চিত্তে একেবারে সিদ্ধান্ত করিলেন যে আপিসের মধ্যে এই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত লোক’ (ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)। একই অবস্থা আমরা মোস্তফা কামালের ‘আমলা কাহিনী’-তে লক্ষ্য করি। এখানেও সচিবালয়ের কর্মচারী ইদ্রিস আলীর তোষামুদে আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে মন্ত্রী মনে মনে বলেছেন ‘ইদ্রিস আলী তেল মারতে ওস্তাদ। তার মতো লোক মন্ত্রণালয়ে দরকার আছে’। (পৃ: ৯০) মন্ত্রীর নেক নজরে আসার ফয়দা কিন্তু ইদ্রিস আলী মুচিরামের মতো তুলতে ভুলেনি। সামান্য মুহুরি হয়ে মুচিরাম যেমন নিজের অবস্থা রাতারাতি পরিবর্তন করেছেন ‘মোকাদ্দমা বুঝিয়া মুচি দাও মারিতেন। অধিক টাকা পাইলে সব উল্টা লিখিতেন। এইরূপে নানাপ্রকার ফিকির ফন্দিতে মুচিরামের অনেক টাকা উপার্জন করিতে লাগিলেন’। একইভাবে সামান্য বেতনের সরকারি চাকরিজীবী ইদ্রিস আলী ও মন্ত্রীকে খুশি করতে পেরে ভেবেছে ‘আমার কাজ হয়ে গেছে। স্যার পটে গেছেন। এখন শুধু টাকার খেলা চলবে। দুই হাতে টাকা আর টাকা। স্যারের টেন আর ফাইভ পার্সেন্ট আমার’। (পৃষ্টা; ৯৩)।

গল্পের শেষে আমরা দেখি এই তোষামুদে পারদর্শিতা কিংবা ম্যানেজ করার কর্মক্ষমতার গুনে ইদ্রিস আলীও মুচিরামের মতো চাকরির মতো চাকরির সর্ব্বোচ্চ পদে আসীন হতে সক্ষম হয়। চাকরি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে সচিবের চেয়ারে বসে কেবল তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। আর মনে মনে বলেন, ‘আমার চেয়ে আর সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কে আছে?’ (পৃ: ৯৮)

তবে এই কথা সত্য যে, ইদ্রিস আলীর এই নাটকীয় উত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমগ্র প্রশাসনকে বিচার করা যাবে না। সৎ যোগ্য কর্মচারী, কর্মকর্তা বা মন্ত্রী এখনও আছে বলে প্রশাসন টিকে আছে। এসব মানুষ যে জনগণ দ্বারা পুরস্কৃত হচ্ছে না তা নয়। লেখকের গল্প রচনার প্রয়াস তাদের উদ্দেশ্যে নয়। তবে বৃটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশ যে মুচিরামদের তৈরি করে গিয়েছিলো তাদের উত্তর পুরুষ ইদ্রিস আলীরাই যে আজ সগৌরবে বাংলার সরকার ও প্রশাসনে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সমাজ সচেতন লেখক মোস্তফা কামাল অন্তরের দায়বোধ থেকে এই ইদ্রিস আলীদের শুধু নতুন করে পরিচয় করে দিয়েছেন আমাদের সমাজে।

গল্পে আর একটি চিত্তাকর্ষক চরিত্র হলো মন্ত্রী। গল্পে তার কোনো নাম নেই। সে মূলত সেইসব দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রীদের প্রতিনিধি যারা রাজনীতিকে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে নিয়েছে এবং লুটের রাজত্ব কায়েম করেছে। বস্তুত একসময় রাজনীতি ছিলো সেইসব মানুষদের জন্য যারা রাজনীতি করতেন জনকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিতকরে গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। এবং এর পশ্চাতে ব্যক্তিগত ইমেজ বা সুনাম অর্জনই মূল লক্ষ্য হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয়িত সমাজ ব্যবস্থায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী-রাজনীতিকে বেছে নিয়েছেন ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের জন্য। পুঁজি বিনিয়োগ করে নির্বাচন করবে আর জিততে পারলে দুর্নীতির মাধ্যমে তার কয়েকগুণ তুলে নেবে। সহজ হিসাব। মন্ত্রী চরিত্রটি এই ব্যবসায়িক রাজনীতিবিদ শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করছে যা মোস্তফা কামাল স্পষ্ট করেছেন মন্ত্রীরই একটি ছোট্ট সংলাপের মাধ্যমে। ইদ্রিস আলীকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্রী বলেন, ‘পেট ভরে খান। আর মন দিয়ে কাজ করেন। আমি গিভ অ্যান্ড টেকে বিশ্বাসী। দিয়ে থুয়ে খাই। বুঝতে পারছেন! জানেনই তো! এখনকার যুগে নির্বাচন মানেই দশ কোটি টাকা খরচ। পার্টি ফান্ডে পাঁচ আর ভোটারসহ অন্যদের পেছনে পাঁচ কোটি খরচ’। (পৃ: ৯২)।

সচিব চরিত্রটিও ইদ্রিস কিংবা মন্ত্রীর সমগোত্রীয়। সেও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছে। মন্ত্রীর সঙ্গে ইদ্রিস আলীর সরাসরি সখ্য দেখে সেও তাকে প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দিয়েছে। ইদ্রিস আলীর ভাষায়, ‘লোকটা বড়ই খতান্নাক লোক। নিজেকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। ব্রিফকেস পায়নি। তাই হালকা হুমকি দিয়ে গেল’। (পৃ: ৯৪)। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইদ্রিস আলী না হয় স্বল্পশিক্ষিত কিংবা মন্ত্রী না হয় ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্নীতে যুক্ত হয় কিন্তু এতোবড় উচ্চশিক্ষিত সচিব কীভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে? এর উত্তর বোধহয় আমাদের ঘুনেধরা সমাজের কাছে পাওয়া যাবে।

গল্পে মন্ত্রী কিংবা সচিব চরিত্রের কোনো পরিণতি লেখক বর্ণনা করেননি। কিন্তু ইদ্রিস আলীর উত্থান এবং পতনকে লেখক অত্যন্ত সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন। মন্ত্রনালয়ে সামান্য কর্মচারি থেকে জীবন শুরু করে সেই মন্ত্রনলয়ের সচিব পদে উন্নীত হওয়া আর দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া বর্তমান সময়ের বাস্তবতাকেই তুলে ধরে। কিন্তু সবকিছুরই একটা পরিনাম আছে। তাই দেখি গল্পের শেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তার আগমনের কথা শুনে নিজের পরিনাম সম্পর্কে ভাবে, ‘হায় হায় খোদা! আমার সারা জীবনের অর্জন কি এক নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে যাবে’। (পৃ: ৯৮) এভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে চরিত্রগুলো নিজস্ব স্বককীয়তা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থেকেছে। লেখক ছোট্ট একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে চরিত্রগুলোর বিকাশের দিকে নজর রেখে সমাজের ক্ষতগুলোকে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। গল্পটির আখ্যান চরিত্র চিত্রায়ণ কিংবা কাহিনি সংগঠনে মোস্তফা কামালের শৈল্পিক প্রয়াস যথেষ্ট সফলতার দাবি রাখে।  

‘বালিকা বউ’ গল্পের কাহিনি গড়ে উঠেছ বাংলাদেশের একটি অন্যতম সামাজিক সমস্যা বাল্যবিবাহকে কেন্দ্র করে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র চৌদ্দ বছরের কিশোরী রেবেকাকে তার বাবা একরকম জোর করে বিয়ে দিলে বাসর রাতেই সে তার স্বামীকে বুঝিয়ে মামার বাড়িতে চলে যায়। এই সামান্য একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত গল্পটিতে মোস্তফা কামাল বাল্যবিবাহ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসহায়ত্ব এবং তাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের মাধ্যমে সমাজে এক প্রকার বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছেন সমাজের মধ্যে।  

সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে রেবেকা। জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য লেখাপড়াকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে সে। তাই হয়তো জীবনের এই পর্যায়ে এসে কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়নি। কিন্তু বাবা রিয়াজুল হকের একটি সিদ্ধান্ত তার জীবনের সব স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়, ‘এ কথা শোনার পর রেবেকার মাথায় যেন বাজ পড়ে। এসব কি শুনছে! যে মেয়ের পড়াশেনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন; তার আজ লেখাপড়া বন্ধ! রিয়াজুল হকের এক কথায় রেবেকার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে! তাকে নাকি বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে! বিয়ের কি বোঝে সে! তাও আবার বত্রিশ বছরের ছেলের সঙ্গে’। (পৃ: ৮৩)। গল্পটির সঙ্গে ‘হৈমন্তী’ গল্পের কিছুটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু ধর্মে বর্ণিত ‘গৌরি দান’ প্রথার (প্রথা অনুসারে কন্যার বয়স নয় বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তাকে পাত্রস্থ করতে হবে। আর তা না হলে কন্যার পিতাকে ‘রৌরব’ নামক নরকের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। ) এ কারণে সতের বছর হওয়ার পরেও শুধু সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে হৈমন্তীর প্রকৃত বয়স আত্মীয় স্বজনদের কাছে লুকানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিলো অপুর মা। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে হৈমন্তীকে শাসিয়ে বলে, ‘আইবড় মেয়ের বয়স সতের, এটা কি খুব একটা গৌরবের কথা, তাই ঢাক ঢোল পিটিয়া বেড়াইতে হইবে? আমাদের এখানে এসব চলিবেনা, বলিয়া রাখিতেছি’। অর্থাৎ বাংলার সমাজে এক সময় বাল্যবিবাহ যে সামাজিকভাবে আইনসিদ্ধ ছিলো গল্পটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। যদিও এই অবস্থার পরিবর্তন বর্তমান সমাজে এসেছে। এখন গ্রমের মেয়েরা সাইকেল চলিয়ে বিদ্যালয়ে যায়, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়। তার পরেও সেই উনবিংশ শতকীয় মন মানসিকতার পরিবর্তন এখনও পুরোপুরি হয়েছে বলে মনে হয় না। এখনও রেবেকার মতো চৌদ্দ বছরের কিশোরীদের বত্রিশ বছরের যুবকেরা সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে থাকে। রেবেকাকে এতো অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার জন্য পিতা রিয়াজুল হকের এই যুক্তিই প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করেছে। সে নিজের মুখেই বলেছে, ‘ছেলে বিদেশে থাকে। পড়াশুনা কম কিন্তু টাকা পয়সা বেশি। ছেলে এলাকায় অনেক জমিজমা কিনেছে। ধানপান যা পায় তা দিয়ে দুই সিজন চলে যায়। তার ওপর মাস গেলেই বিদেশের টাকা। রেবেকা সারা জীবন পায়ের ওপর পা তুলে খেতে পারবে’। (পৃ: ৮৪)। তাহলে কি টাকাই সব, মনের কোনো মূল্য নেই, মূল্য কি নেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের? যদিও উনিশ শতকীয় হৈমন্তীর সাথে একবিংশ শতকের রেবেকার মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক, পার্থক্য এসেছে সমাজেও। তাই দেখা যায় হৈমন্তী প্রতিবাদ করার পরেও রক্ষণশীল হিন্দু সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্তি নিতে পারেনি। অপুও সুযোগ থাকার পরেও মুক্তি দিতে পারেনি হৈমন্তীকে। তাই মৃত্যুর মাধ্যমেই মুক্তি খুঁজতে হয়েছিলো হৈমন্তীকে। কিন্তু রেবেকার সমাজে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এই সমাজে বাল্যবিবাহ কিংবা যৌতুক প্রথা যেমন আইনগতভাবে অপরাধ তেমনি নারীর শিক্ষার প্রতিও সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। আর তাই রেবেকা শুধুমাত্র তার বাল্যবিয়ের জন্য নীরবে প্রতিবাদ করেনি। তার মায়ের ভাষায়, ‘তুমি শুধু একবার তোমার মেয়ের দিকে তাকাও। ওকে দেখ। ও কতটা অসহায় দেখেছো? ওর চোখের পানি সহ্য করা যায় না। আমিই পারছি না। তুমি কি করে পারছো? (পৃ: ৮৭) বাবার বাধ্য হয়ে বিয়ে করার পরেও বাসর রাতে স্বামীর কাছ থেকে নিজের মুক্তি সে ঠিকই আদায় করে নিতে পেরেছে, ‘প্লিজ আমাকে মুক্তি দিন। আমি মুক্তি চাই। আমার কাছে এই জীবন বড় দুর্বিষহ বলে মনে হয়!’ (পৃ: ৮৯)। এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়- রেবেকার স্বামী নিজামউদ্দিন কিন্তু অপুর মতো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেনি। কিংবা বাবা-মায়ের ভয়ে নিশ্চুপ থাকেনি। সে রেবেকার অনুরোধে সাড়া দিয়ে ঠিকই তাকে মুক্তি দিয়েছে, ‘নিজামউদ্দিন রেবেকাকে অসম্ভব ভালোবাসে। সে কিছুতেই রেবেকাকে হারাতে চায় না। অথচ রেবেকার আকুতি-মিনতি তার মনের ওপর দারুণ এক প্রভাব ফেলে। সে মনে মনে ভাবে রেবেকাকে সে বাপের বাড়ি দিয়ে আসবে। সেখানে রেখে পড়াশোনা করাবে। রেবেকা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে তখন তাকে ফিরিয়ে আনবে’। (পৃ: ৮৯)। অতএব দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পে অপু যতটা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে মোস্তফা কামালের ‘বালিকা বউ’ গল্পে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে নিজামউদ্দিন ততোটাই রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠেছে। রেবেকার পাশাপাশি নিজামউদ্দিন চরিত্রটিও পাঠকের সহানুভীতি আর্কষণ করে। যা অপুর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে পুর্বেই বলেছি ‘হৈমন্তী’ গল্পের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের চেয়ে ‘বালিকা বউ’ গল্পের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক। মোস্তফা কামালের সার্থকতা এখানেই যে তিনি এই পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে গল্পে তুলে ধরতে পেরেছেন।  

যদিও আধুনিক একবিংশতকীয় সমাজ ব্যবস্থা নারীকে অর্ধাঙ্গিনী রূপে বরণ করে নিয়েছে এবং কর্মক্ষেত্রে ও সামাজিক অবস্থার দিক থেকে নারীরা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলছে তবুও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে এখনও বাঙালি সমাজ পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। গল্পে বর্ণিত রিয়াজুল হকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও কথাবর্তা এই পুরুষতান্ত্রিক মন মানসিকতারই পরিচয় বহন করে। তাই দেখা যায়, স্ত্রীর সঙ্গে পরার্মশ না করে মাত্র চৌদ্দ বছরের এক স্কুল পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে একাই ঠিক করে বলেছে, ‘মেয়ে মানুষ পড়ালেখা করে কী হবে! পড়ালেখা করলেও চুলা ঠেলতে হবে, না করলেও ঠেলতে হবে। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। মন্দ কী! এখন সংসার ধর্ম করবে’। (পৃ: ৮৪)। এমনকি মেয়েরও মতামত নেওয়াকেও সে প্রয়োজন মনে করেনি।  

এক্ষেত্রে আছিয়া বেগমের অবস্থা আরও করুণ। যে মেয়েকে সে পেটে ধারণ করেছে সেই মেয়ের বিয়ের বিষয়ে তার মতের কোনো মূল্য নেই। জেনে শুনে ছোট্ট মেয়েটির বিয়ে নিয়ে কেন সে প্রতিবাদ করতে পরেনি এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাই আবদুল্লাকে বলেছে, ‘রাজি না হয়ে উপায় কি বল! বললাম না আমি আপত্তি করলে সংসার ভাঙবে’। (পৃ: ৮৭)। সংসার না ভাঙার সব দায়িত্ব আছিয়ার এখানে রিয়াজুর হকের কোনো দায়িত্ব নেই। এই হলো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। আর তাই এই সংসার ভাঙার ভয় দেখিয়েই হয়তো সে তার স্ত্রীকে শাসন বা চোখ রাঙিয়েই চলেছে। তবে আছিয়া বেগমের প্রতিবাদ করার অক্ষমতার পশ্চাতে আমরা আর একটি কারণ আবিষ্কার করি আর তা হলো, সেও রিয়াজুল হকের মতো পুরুষতান্ত্রিক ভাবাশ্রিত পিতার সংসারে বেড়ে উঠেছে। অর্থাৎ রিয়াজুর হকের মতো আছিয়ার পিতাও এই পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল আদর্শ পোষণ করতো। পুরুষের এই পৌরুষত্ব দেখতে দেখতে বিক্ষুদ্ধ হয়ে এক সময় সে তার ভাইকে বলেছে, ‘ কী করবো বল! আমারও তো এই সংসারে আসার ব্যপারে আপত্তি ছিল। বাবা কি আমার আপত্তি গ্রাহ্য করেছেন? করেন নাই। আসলে পুরুষ জাতি সব এক’। (পৃ: ৮৬)। আছিয়ার এই সংলাপের মধ্য লেখক তার নারীবাদী মানসিকতার পরিচয় স্পষ্ট করেছেন। আর তাই দেখা যায় মোস্তফা কামালের নারীরা পুরুষের পৌরুষত্তের কাছে মাথা নিচু করে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের মৃণাল যেমন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের আঘাত সহ্য করতে না পেরে স্বামী সংসার থেকে বেরিয়ে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো, মৃণালের ভাষায়, ‘তোমাদের গালিকে আর আমি ভয় করিনে আমার সম্মুখে আজ নীল সমুদ্র’। আছিয়া বেগমকেও আমরা একইভাবে প্রতিবাদ করতে দেখি। তবে মৃণালের মতো পালিয়ে গিয়ে চিঠি দিয়ে নীরবে নিভৃতে নয়। বিয়ে বাড়িতে সবার সম্মুখে আছিয়া পাত্রপক্ষকে সরাসরি বলেছে, ‘আজ আপনারা আমার সম্মানিত মেহমান। আপনাদের অপমানিত করার মানসিকতা আমার নেই। আপনাদের অবগতির জন্য আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই, আমার মেয়ের আজ বিয়ে হবে। খুবই আনন্দের কথা। অথচ আমার নাবালিকা মেয়েকে আমি বিয়ে দিতে চাই না। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেবেকার বাবা ওকে বিয়ে দিচ্ছেন’। (পৃ: ৮৮)। শুধু তাই নয় রিয়াজুল হক প্রতিবাদ করলে সে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ‘মেয়েকে কিন্তু আমি গর্ভে ধারণ করেছি; আপনি না’। (পৃ: ৮৮)। অথচ গল্পের শুরুতে আছিয়া বেগমকে যতোই র্নিজীব থাকতে দেখেছি গল্পের শেষে ততোই তাকে জ্বলন্তভাবে ফুটে উঠতে দেখি। তবে সে হঠাৎ করে এমন প্রতিবাদী হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পাবার পথ পেয়েই যে এই অবস্থা হয়েছে তা লেখক পূর্বেই স্পষ্ট করেছেন, ‘আসলে পুরুষ জাতি সব এক’। (পৃ: ৮৬)। আর যে সংসার কিংবা সর্ম্পকের ভয় দেখিয়ে রিয়াজুল হক এতোদিন তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে সেই সংসার বা সর্ম্পকের গন্ডি ছেড়ে আছিয়া বেরিয়ে এসেছে, ‘নাবালিকা মেয়ের বিয়ের প্রতিবাদে আছিয়া বেগম বাপের বাড়ি চলে গেলেন’। (পৃ: ৮৮)। চরিত্রটি গল্পের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে এতোটাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে যে সে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ মর্যাদার দাবি রাখে।

সুমিতা চক্রবর্তী তার ‘ছোট গল্পের বিষয় আশয়’ গ্রন্থের ২৫ পৃষ্ঠায় ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য সর্ম্পকে বলেছেন, ‘ছোট গল্পে থাকবে সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের উদ্ভাস। সমাজের প্রেক্ষিতে, ক্ষমতাবানের অনুশাষনের প্রতিরোধে মানুষ কখনো একা কখনো অনেকে মিলে দাড়াবে। জেগে উঠবে এক সংঘাত’। এই সংঘাতের কারণে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো এতো জীবন্ত। আমাদের তরুণ লেখক মোস্তফা কামালের ‘বালিকা বউ’ গল্পেও আমরা এই সংঘাত রক্ষ্য করি। যেখানে রিয়াজুল হক পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল সমাজের ধারক হিসেবে নাবালিকা কিশোরী মেয়ে রেবেকাকে বিয়ে দিতে তৎপর সেখানে রেবেকা, তার মা আছিয়া বেগম এবং মামা আবদুল্লাকে আমরা নারীবাদী দৃষ্টি নিয়ে বিয়ে ঠেকাতে তৎপর হতে দেখি। আবদুল্লাহ সরাসরি রিয়াজুল হককে হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘দেখেন দুলাভাই! আমি জেনেশুনে এই অন্যায়কে সর্মথন করতে পারি না। আপনি বাড়াবাড়ি করবেন না। তাহলে কিন্তু পুলিশকে খবর দেব’। (পৃ: ৮৫)। আছিয়া বেগমও তার ভাইয়ের এই একক সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে বলেছে, ‘এই দেশে মেয়েরা পোড়া কপাল নিয়ে জন্মায়। সব পুরুষ মানুষই এদেরকে দাসী-বান্দী মনে করে। তুই একা ফাইট দিয়ে কী করবি?’ (পৃ: ৮৬)। যদিও তারা বিয়ে ঠেকাতে পারেনি তার পরেও এই দ্বন্দ্বই যে গল্পকে রসঘন করে তুলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তাছাড়া গল্পের মোড়ে মোড়ে মোস্তফা কামাল অত্যন্ত শিল্পনিপুণভাবে নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। যেমন, গল্পের শুরুতে রিয়াজুল হক যখন রেবেকার বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন তখন হঠাৎ করে এসে আবদুল্লাহ বিয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, ‘রেবেকার মামা আবদুল্লাহ কোথা থেকে যেন হন্ত দন্ত হয়ে বিয়ের আসরে ছুটে এলেন্ চিৎকার দিয়ে বললেন এ বিয়ে হবে না! ঘরভর্তি মানুষ। সবাই তখন বিয়ের আলোচনায় মশগুল! সে মুহূর্তে এ ধরনের কথা কেউ আশা করেননি। (পৃ: ৮৪)। কিংবা আছিয়া বেগমের বিয়ের আসরে অতিথিদের সামনে বিয়ের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানিয়ে বাপের বাড়িতে প্রস্থান করা এবং বাসর রাতে বরকে বুঝিয়ে রেবেকার মামার বাড়িতে প্রস্থান করার মাধ্যমে লেখক গল্পে নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন যা গল্পের কাহিনীকে রসঘন করতে সহায়তা করেছে।

‘ঘাতক’ মোস্তফা কামালের একটি ভিন্নধর্মী গল্প। ক্রোধ যে এক ভয়াবহ ব্যধি, এবং তা যে মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে আকাশ থেকে মাটিতে, মানুষ থেকে অমানুষে, চরম পূজনীয় থেকে ঘৃণ্য, ভাই থেকে ঘাতকে পরিণত করতে পরে- তাই লেখক অত্যন্ত শিল্পনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন গল্পটিতে। গল্পের মূল কাহিনিতে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষিত জমির উদ্দিন ডাক্তারির মতো মহৎ পেশায় নিয়োজিত থেকে সামান্য সম্পত্তির জন্য ক্রোধে বশবর্তী হয়ে ছোটভাই জসিমকে মারাত্মকভাবে যখম করে হাসপাতালে ভর্তি করে। এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে, ‘আমরা অনেক প্রাণপণ চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই বাঁচাতে পারলাম না’। (পৃ: ৬৫)। কিন্তু জসিমের মৃত্যুর চেয়েও জমিরের অনুশোচনা তাকে জীবন্ত করে তুলেছে। গল্পের শেষে জমিরের ফাঁসির আদেশ দেন আদলত। কিন্তু তাতে মোটেও বিচলিত না হয়ে ভাতৃহত্যার অনুশোচনায় দগ্ধীভূত হয়ে যখন বলে, ‘আজ আমি যদি মেজাজটা কন্ট্রোল করতে পারতাম তাহলে আমার এই পরিনতি হতো না! ভাইকে হত্যার জন্য আমার ফাঁসি হবে! এটাই আমার প্রাপ্য’। (পৃ: ৬৮)। তখন পাঠক নিহত জসিমের চেয়ে জমিরের প্রতিই বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। গল্পের শেষে জমিরই হয়ে ওঠে ট্রাজেডির নায়ক আর ক্রোধ নামক পশুটা ভিলেন হয়ে ওঠে। এভাবে লেখক তার অসাধারণ বর্ণনা আর কাহিনি সংগঠনের মাধ্যমে একটি নেতিবাচক চরিত্রকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেন। আঙ্গিক কাহিনি নির্মাণ আর চরিত্র চিত্রায়ণে গল্পটি বাংলা সাহিত্যে একটি ভিন্নস্বাদের মাত্রা দান করে।    
 
গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে ৩০ মে জন্ম নেওয়া এই লেখক একটি নিজস্ব ভাষারীতি দাঁড় করেছেন। তার ভাষারীতি সর্ম্পকে হায়দার আকবর রনো বলেছেন, ‘সন্দেহ নেই খুব ঝরঝরে ভাষা। আমরা একটু শিক্ষিত মানুষেরা কথায় যেসব ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, তা লেখক তার লেখার মধ্যে খুব স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করেছেন। সংলাপের মধ্যে ইংরেজি শব্দ থাকলে এক রকম কথা ছিলো। কিন্ত লেখকের নিজস্ব বয়ানের মধ্যে সেসব ইংরেজি শব্দ আবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছে’। (মোস্তফা কামালের জননী)। শুধু ইংরেজি শব্দ নয় চরিত্রের সামাজিক অবস্থাভেদেও তিনি ভাষা ব্যবহার করেছেন। যেমন, ‘পার্বতীপুর জংশন’ গল্পে এক কুলির মুখে তিনি সেই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করেছেন এভাবে, ‘কি কামোত খোদায় যে হামারগুলাক দুনিয়াত পাঠাইল! আর পাঠাইলু যদি তো আজার ঘরত পাঠাতু! নেকাপড়া শিখি জয়েজ হনুহ্যায়! তাক না! ঠিকা পাইসা না থাকলে এ্যা দুইন্নাত কুনো দাম নাই’। (পৃ: ২০)। বলা যায় এই ভাষার প্রয়োগেই চরিত্রগুলো তাদের সামাজিক অবস্থাভেদে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৬
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।