ভালো আর মন্দ এ দুই বাইনারিতেই জগত বিভক্ত। এ দু’টোর একটিকে যখন আপনি স্বীকার করে নেবেন, তখন সেটা অন্যটির উপস্থিতিকে অনিবার্য করে তোলে।
ভিলেন মানে কেবল নেতিবাচক চরিত্রের দৃশ্যায়ন নয়। ভিলেনের স্বাধীনতা যেমন চ্যালেঞ্জও অনেক বেশি। ভিলেনকে প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙতে হয়। তার ভাষা অন্যদের চেয়ে আলাদা, শরীরী ভঙ্গি আলাদা। তাকে খারাপ হতে হয় এবং সেটা দর্শককে বুঝিয়েও দিতে হয় যে সে খারাপ। যে খারাপের কোন সীমারেখা নেয়। দর্শককে চূড়ান্ত বিরক্ত করে ছাড়াই তার লক্ষ্য। এমনও হয়েছে, পর্দায় ভিলেনের অভিনয় দেখে বাস্তবের দর্শক তার দিকে জুতা ছুঁড়ে মেরেছে। এটাই মূলত ভিলেনের সার্থকতা। বাংলা সিনেমার ভিলেন বিষয়টা বিশ্ব চলচ্চিত্রের মতো কখনও ব্যক্তি চরিত্র হিসেবে সামনে এলেও অনেক সময় সামষ্টিকভাবেও সামনে এসেছে। বলা বাহুল্য, সেটা বেশিরভাগ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নতুবা বাঙালি রাজাকারকে চিহ্নিত করেই সামনে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিগুলো দেখলেই এই ব্যাপারটা বোঝা যায়। আবার এসব ছবিতে বেশিরভাগ সময় রাজাকারের চরিত্রে একজন থাকে আবার কখনও থাকে পাকিস্তানি জেনারেল চরিত্রের কেউ। যারা মূলত ভিলেনীয় আবহটা নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এসব চরিত্রে ব্যক্তির চেয়ে তাদের সামষ্টিক কর্মকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়ে থাকে। যা অন্য ছবিতে সেই শর্তটি পূরণ নাও করতে পারে।
মজার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পুরুষ ভিলেনের পাশাপাশি নারী ভিলেনের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। বিশেষ পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে উস্কে দিতেই তারা খোলস ছেড়ে বাইরে আসেন। সিনেমায় অনেক সময় শেষ পর্যন্ত রিলের বাটনটা থাকে তার হাতে।
বাংলাদেশের প্রথমদিককার ভিলেন বললে সবার আগে আসে রাজু আহমেদ, এম এ সামাদ, গোলাম মোস্তফা, রাণী সরকার প্রমুখের নাম। তারাই মূলত বাংলা সিনেমার আদি ভিলেন। তাদের মধ্যে রাজু আহমেদ অন্যতম। রুপালি পর্দায় যেমন বাস্তবেও ছিলেন তেমন। শরীরী ভাষাকে দারুণভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তিনি। তার সংলাপ প্রক্ষেপণ, তাকানোর ভঙ্গি, হাসি, সবকিছু এতোই নিখুঁত ছিলো যে, তিনি নিঃসন্দেহে তার সময়ের সেরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন ‘জল্লাদের দরবার’ নামে কথিকা তার কারণেই আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। তার উল্লেখযোগ্য ছবি ‘ওরা এগারজন’।
রাণী সরকার বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে খল চরিত্রের আরেক কিংবদন্তি। মিথ এবং গ্রামীণ ভাবধারার ছবিতে রাণী সরকারের তুলনা কেবল তিনিই। এদের ঠিক সমসাময়িক বা কিছুটা পরে ভিলেন হিসেবে পর্দা কাঁপিয়েছেন গোলাম মোস্তফা, রওশন জামিলরা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ নিশ্চিতভাবেই রওশন জামিল অভিনীত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। যেখানে তিনি দজ্জাল বড়আপার ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন। রওশন জামিল অনেকটা রাণী সরকারের উল্টো প্রতিবিম্ব। তবে শহুরে গল্পনির্ভর ছবির মতো তিনি গ্রামীণ পটভূমির গল্পেও সমান সফল। রওশন জামিল এবং গোলাম মোস্তফা দু’জনেরই মূল শক্তি এক্সপ্রেশন। চরিত্রকে চেহারায় ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তারা। যা তাদের চরিত্রকে দর্শকের মাঝে অনেক বেশি জনপ্রিয় করে তোলে। গোলাম মোস্তফার ‘হারানো দিন’ তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা চরিত্র। যেখানে মদ্যপ জমিদারের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এরপরও অনেক সফল খল চরিত্রে অভিনয় করেন গোলাম মোস্তফা।
তাদের পরবর্তী সময়ের খল নায়কদের মধ্যে খলিলুল্লাহ খান, আদিল অন্যতম। খলিল চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন দুই জায়গায় সমান সফল। ‘সংসপ্তক’ নাটকে ‘মিয়ার বেটা’ চরিত্রটি তাকে অনেকদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবে। খলিলের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, তার ভারী কণ্ঠস্বর। যা তার ডায়লগ থ্রোয়িংকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল। ঠিক একই ধারার খল অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান। তবে খল চরিত্রে কমেডি যুক্ত করে তিনি নতুনত্ব এনেছিলেন। যে কারণে এ টি এম শামসুজ্জামানের জনপ্রিয়তাও ছিলো ব্যাপক। পরবর্তী সময়ের খল অভিনেতাদের মধ্যে আদিলের নামও উল্লেখযোগ্য। রাজু আহমেদের মতো আদিলও একসময় বাস্তবের খল নায়কে পরিণত হন। যা তার অভিনয় প্রতিভার ইতি ঘটিয়ে দেয়।
শেষ ৮০ ও ৯০ পরবর্তী সময়ে খল অভিনেতাদের মধ্যে রাজীব অন্যতম। তবে প্রায় সব সিনেমায় একই ধরনের অভিনয়ের কারণে একসময় বেশ ক্লিশে হয়ে ওঠেন তিনি। একই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন আহমেদ শরীফও। এসময় কিছু সাইড ভিলেন ওঠে আসেন। যারা মূল ভিলেনের পাশে থেকে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতেন। জাম্বু, কাবিলা, মিশা সওদাগর কিংবা ডন উল্লেখযোগ্য। এদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে মূল ভিলেনের চরিত্রেও অভিনয় করেন। ডিপজল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, মানুষের দৈনন্দিন গালিগালাজকে তিনি পর্দায় হাজির করেছিলেন সম্পূর্ণ নতুনভাবে। কাজী হায়াতের সঙ্গে ডিপজল জুটির এই ‘অশ্লীল’ গালাগাল মূলত আমাদের ব্যক্তি মানসের রিপ্রেজেন্টেশন। যদিও এ নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে বিস্তর।
তবে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে খল চরিত্রের ‘স্টেরিওটাইপ’ ধারণাটা বদলে দিয়েছেন যিনি তার নাম হুমায়ূন ফরীদি। শহীদুল ইসলাম খোকনের সঙ্গে জুটি গড়ে সিনেমায় নায়ক-ভিলেনের বাইনারি ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। ভিলেন চরিত্রে ফরীদি মানে কখনও কখনও নায়কের চেয়ে অধিক জনপ্রিয় ছিলেন। ফরীদি যতোটা না ভিলেন ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন চরিত্রাভিনেতা। ‘সন্ত্রাস’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’ কিংবা ‘পালাবি কোথায়’ যে চলচ্চিত্রই নেন, ফরীদি সবজায়গায় সাবলীল এবং অভিনব। এখানেই আমরা মূলত লেখার প্রথম অংশে ফিরে যাবো। ভালো-মন্দের বাইনারি অর্থ্যাৎ ভিলেনকে যে মানুষ কেবল গালিই দেয় না, তাকে আপনও মনে করতে পারে ফরীদি তার গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
এখানে আমরা মিসিং লিংক হিসেবে জুড়ে দিতে সাম্প্রতিক সময়ের বলিউডের একটি সিনেমাকে। ‘বাদলাপুর’ নামে সেই ছবিতে ভিলেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী একসময় নায়ক বরুণ ধাওয়ানকে ছাপিয়ে গিয়ে নিজেই নায়ক হয়ে ওঠেন। বলিউডের মেইনস্ট্রিম ছবির ইতিহাসে যা অভিনবই বলা যায়। অর্থাৎ ভালো, ভালো হলেও খারাপ কেবলই খারাপ থাকছে না। দর্শনের দুনিয়ায় সে বাহাস একটু পুরনো হলেও উপমহাদেশের সিনেমাতেও এখন তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০১৬
এসএনএস