স্বদেশ, মাতৃভাষা আর নিজস্ব অনুভূতির নির্জন ঘরে নীরব অবস্থিতি কবি শামসুর রাহমানের (জন্ম: ২৩, অক্টোবর ১৯২৯; মৃত্যু: ১৭ আগস্ট, ২০০৬)। যেন সাবধানী নিরাপত্তাকর্মী কোনো।
রাহমানের কিছু শক্তিশালী কবিতা ভাষা-সংগ্রাম সংগঠনের উত্তেজনা ও তেজকে ধারণ করে আছে। ভাষার জন্য, ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তাকে পরিভ্রমণের সুযোগ করে দেবার জন্য এক অসহায়-অশান্ত কবির হাহাকার:
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের পুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলি শৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁর নেচে নেচে, যেখানে কুসুমকলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সঙ্কেতে।
ভাষা নিয়ে রাজনীতি, মাতৃভাষা-ভাষাব্যবহারকারীদের ওপর নির্বিচারে চালানো নির্মমতা আর একটি ভাষার সমস্ত গৌরব-ঐতিহ্যে আঘাত হানার হিংস্রতা শামসুর রাহমান দেখেছেন কাছ থেকে। প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে উপলব্ধি করেছেন সে বেদনার যাতনা। মানুষের স্বাভাবিকবৃত্তি, মৌলিক অধিকার আর সহজভাবে চলতে থাকা জীবনে আছড়ে-পড়া অনাকাঙ্ক্ষিত অভিঘাত ঘা দিয়েছে কবির কোমল হৃদয়ে; তিনি প্রায়-দিশেহারা হয়েছেন মাতৃভাষার চরম দুর্দশার সময়ে। তার ভাবনার প্রকাশ:
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শো’ বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে-ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে
কত নোংরা হাতের হিংস্রতা দেয়ে আসে।
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস!
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
(বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা)
উনসত্তরের অনভিপ্রেত অবিনাশী ডাকে যখন অগণন মানুষ সমবেত, তখন শামসুর রাহমান ভাবছেন জীবনের তরঙ্গভঙ্গের কাতর-আর্তনাদের বাণীভাষ্য; সিনেমা হলের কর্মচারী, সার্কাসের তরুণী, হাড্ডিসার বিত্তহীন কৃষক, মেঘনার প্রাত্যহিক মাঝি, চটকলের শ্রমিক, উদার মৃৎশিল্পী, করুণ কেরানি, তরুণ শিক্ষার্থী, নবিশী কবি- সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায় তার চৈতন্যলীন আধমড়া-স্বপ্ননক্ষত্রের স্পন্দনে। ফাল্গুনের রোদে তিনি দেখেন ঘরকে বাহির করা জীবনমুখি প্রবণতার নৃত্যচপল আনন্দ। লাঙল-ফসল-পাল-আগুনওম-শিস-শাড়ি-প্রতিবাদ-জলপান প্রভৃতির নিবিড় যাত্রাপথে মাঝে মাঝে যেন ইশারা জাগায়, সহপাঠিনীর চুল, প্রিয়ার রহস্যময় খোঁপা কিংবা হাসপাতালে আরোগ্য-আনত বিষণ্ণ মুখ। মানবিক বাগানে বারবার হায়েনার থাবা কবিকে ‘আনন্দের রৌদ্র আর দুঃখের ছায়ায়’ শিহরিত করে প্রতিক্ষণ। তিনি দু’হাতে সাজান পুনরায় জেগে-ওঠা প্রতিবাদীচেতনার দলিলপত্র:
বুঝি তাই উনিশশো উনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা,
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা। [ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯]
ষাটের দশকে রাজনৈতিক টানাপড়েন, মানুষের প্রাত্যহিক সংগ্রাম-সংঘাত নতুন ভাষায় কথা বলে ওঠে শামসুর রাহমানের কবিতায়। তিনি দু’চোখ মেলে দেখতে থাকেন, আত্মায় অনুভব করতে থাকেন, দ্রুত ঘটতে থাকা ঘটনাবলি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাঙালি জীবনে এক বিশেষ চেতনাবিস্তারকারী ঘটনা। শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারকে প্রতিরোধ করার জন্য আপামর জনতা সেদিন সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। প্রাণ দিয়েছিল উদ্যমী তরুণ আসাদ। তার নামে ঢাকার মোহাম্মদপুরে, রাজপথে, গেইট নির্মাণ আর পথচারীর মুখে আসাদের নাম-উচ্চারণ সাধারণের বোধের অন্তরালে বহন করছে বাঙলি জাতিসত্তার ঐতিহ্যিক অনুভূতির মাহাত্ম্য। তেমনই স্বদেশনিবিড় উপলব্ধির কথামালা সাজিয়ে তোলেন স্বদেশের মাটির-প্রত্যাশার-প্রাপ্তির সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও সাধককবি শামসুর রাহমান:
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চুড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। [আসাদের শার্ট]
রাহমান তার কবিতায় গণমানুষের প্রাত্যহিক-রাজনৈতিক বিক্ষোভ এবং মিছিলের অগ্রবর্তী মানুষের আবেগ-অস্থিতির প্রাবল্য এঁকেছেন। তার প্রজন্মের ভাষা তিনি নির্মাণ করতে পেরেছেন আবেগ আর বাস্তবতার বিরল-মিশ্র অভিনিবেশে। প্রাগ্রসরতা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রভৃতি তার ভাবনাবিশ্বের বিশেষ বিশেষ প্রকোষ্ঠ।
কবি সৈয়দ শামসুল হক কবি শামসুর রাহমানকে ‘স্বাধীনতার কবি’ অভিধায় ভূষিত করতে চান। কেননা, তার কবিতায় জাতির আত্ম-জিজ্ঞাসার ভাষা নির্মিতি লাভ করেছে। রাহমানের কবিধর্ম হলো- মানবতাবিরোধী কর্মযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যোগ্যতা অনুযায়ী মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার। আলোকিত মানবসভ্যতা বিনির্মাণ আর আধুনিকতার প্লাটফরমে শিল্পচর্চার বিষয়টি লালন করেছেন তিনি আমৃত্যু। পরাধীনতার-শোষণের গ্লানিমোচনের যে মানবিক আকাঙ্ক্ষা তিনি বর্ণনা করেছেন, তা একজন কথাকারিগরের আপন-অভিব্যক্তিরই বহির্প্রকাশ মাত্র। স্বাধীনতার জন্য আকুল অপেক্ষা, প্রজন্মপ্রহর আর অর্থনৈতিক স্থিতি-অস্থিতির কালযাপনের ক্লান্তি শামসুর রাহমান অনুভব করেন ‘শূন্য থালা হাতে’ ‘পথের ধারে’ বসে-থাকা ‘হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী’র উপলব্ধির গাঢ়তায়। কবি বাঙালি জাতির মনন-চেতনকে আঁকছেন এভাবে:
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ন কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিক্শাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবী জন্ম হ’তে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতিক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
[তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা]
সেই প্রত্যাশিত স্বাধীনতার উপমান তারই কবিতায় কত-না বিপুল-ব্যাপৃত। ‘রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান’ আর নজরুলের ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা’ সৃজন-ব্যাকুলতায় জনতাকে যেন হাতড়ে ফিরতে হয় স্বাধীনতার স্বাদ। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম, প্রাপ্তি-প্রত্যাশায় নিবিড় প্রতিবাদের ঝড়, বীজ বুনে ফসলের প্রত্যাশায় নীরবে প্রহর গুনতে-থাকা কৃষকের অনাগত প্রসন্ন মুখ কিংবা গ্রাম্য কিশোরীর অবাধ গতিবিধি- সবই যেন কেবল স্বাধীনতারই অন্য অন্য নাম। কৃষিনির্ভর উৎপাদনমুখী বাংলাদেশে কবি দেখতে চান অফুরন্ত শস্যরাজি আর শস্যকর্তকের সাংবাৎসরিক উৎসবঘেরা জীবন। স্বাধীনতার মানে- কবি বুঝতে চান, বোঝাতে চান, শ্রমিক-মজুরের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন, মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন-সফলতা আর শিক্ষা ও প্রগতির নিখাদ সোজা পথ। তিনি লেখেন:
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ। [স্বাধীনতা তুমি]
প্রকৃতির নির্মলতা-স্বাভাবিকতা, পরিবার ও সমাজের নীতিপ্রীতি-ধর্মযাপন, মায়ের আনন্দ, বোনের খুশী, সাফল্যের পথে বন্ধুর এগিয়ে চলা- সবকিছুর ভেতরে লুকিয়ে থাকে ঝিনুকের মোড়কে থাকা মুক্তার মতো সম্ভাবনা। শামসুর রাহমান মায়ের শুকাতে-দেওয়া শাড়ি আর বোনের মেহেদীরাঙা হাতের আহ্বানে দেখতে পান শান্তিনিবিড় মাতৃভূমি। বাবার প্রার্থনারত হাতের তালুতে ঝুলতে থাকা থোকা থোকা স্বপ্ন বুনতে চান তিনি স্বাধীন দেশের উর্বর মাটিতে। আর ঘরে ঘরে নির্মাণ করতে চান অফুরন্ত শান্তির সুবাতাস। তার চিন্তাভাষ্য:
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ে রঙিন কোর্ত,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা। [স্বাধীনতা তুমি]
স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তাই করা নয়; তারও আছে সীমারেখা, রয়েছে মাপকাঠি। প্রাপ্তির স্বস্তি ও আনন্দ প্রকাশে আমরা যেন দিশেহারা হয়ে না পড়ি; সীমানা অতিক্রম না করি সে বিষয়ে কবি শামসর রাহমান আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন। নীড়ের ঠিকানা- তার স্থির অবস্থিতি, অনুভূতির গীতলতা আর অর্জনের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণে যে সহায়তা ও নিশ্চয়তা প্রদান করে, তার মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে কবি যুগিয়েছেন চিন্তাশক্তির খোরাক। কবিতার স্বপ্নময়তা আর রীতিবদ্ধতার ফ্রেমে সাজিয়ে তোলেন কবি স্বাধীনতার স্বাদ:
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা। [স্বাধীনতা তুমি]
ভাষার স্বাধীনতা আর কবিতার মুক্তিই যে মানবজীবনের সকল ব্যাপ্তি-প্রাপ্তির মূল উৎসভূমি- এই চেতনার চিন্তাভাষ্য সাজিয়েছেন তিনি ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায়। কবিতাটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রচিত। কবিতাটিতে তিনি স্বাধীনতাকে নানান চিত্রকল্পে নামাঙ্কিত করতে চেয়েছেন; বীরত্বযুক্ততা, রাজনৈতিক সম্পৃক্তি, গ্রাম্য-অনুষঙ্গ, পাখির গান-ঘর-বাগানের আশ্রয়-আকর্ষণ আর স্বস্তিতে সৃজনলেপনের কবিতাখাতার প্রসঙ্গাদি স্থান পেয়েছে তার কল্পনারাজিতে।
জাতির বিপর্যয়, অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃশাসন, অবরুদ্ধ জীবনের যন্ত্রণা শামসুর রাহমানের বোধ আর দায়গ্রহণের মানসিক শীতল-উর্বর ভূমিতে গড়েছে কবিতাসৃজনের শান্ত পরিসর। তিনি মানুষের কল্যাণ আর সুস্থির অবস্থান ভাবনার কবি; শান্তি আর স্বস্তি নির্মাণের নিবিড় ভাষ্যকার। কবিতাযাত্রায় তার কোনো ক্লান্তি নেই, আছে সুখলাগা-দোললাগা উপলব্ধির আভাস; আর ওই অনুভব কবিতা পাঠকের হৃদয়-দরোজায় পৌঁছে দেবার প্রচেষ্টা-শিহরণ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৬
এমজেএফ/