ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো/পর্ব-৩

মেট্রো ও পিয়ানোবাদন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৭
মেট্রো ও পিয়ানোবাদন ছবি: বাংলানিউজ

মেট্রো ও পিয়ানোবাদন
পর্ব-৩

আমরা চলে আসি মেট্রোর গুমটির কাছে। রট-আয়রণে চমৎকার নকশা করা এনট্রেন্স থেকে ভূগর্ভে নেমে যাওয়া সিঁড়ি ধরে কয়েক ধাপ নামতেই ময়লা হয়ে ওঠা মোজাইকের প্রান্তে দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকা একজন হোমলেস্ মানুষকে দেখে আমার মন বিষণ্ন হয়ে ওঠে।

তার পাশ দিয়ে ধবধবে সাদা লোমের পুডল জাতীয় কুকুরের লিস্ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন একজন আপাতসুখী নারী। ঠিক বুঝতে পারি না প্যারিসের মতো আর্থ-সামাজিকভাবে সচ্ছল একটি নগরে বাস করেও কেন এ মানুষটি মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলেন। আমি তাকে ইউরোর একটি কয়েন দেবো কিনা ভাবছি, দেখি আগাথা উবু হয়ে বসে পড়েছে তার সামনে। ম্যানুয়েল ঠিক বুঝতে পারছে না কি করবে। আগাথা পার্স থেকে বের করে হোমলেস মানুষটির হাতে একটি চকোলেট বার তুলে দিতে দিতে ফরাসি ভাষায় যা বলে তার অনুবাদ হলো,‘হ্যালো হ্যান্ডসাম, তুমি কী আমার হাত থেকে একখানা চকোলেট বার নেবে?’ দাড়িগোঁফের ফাঁকে হাসি ফুটিয়ে গৃহহীন মানুষটি জবাব দেয়,‘ পরের বার যখন এ পথ দিয়ে যাবে.. মাই ডিয়ার সুইটহার্ট, ডোন্ট ফরগেট টু ব্রিং আ সিগার ফর দিস পুওর ম্যান। ’ আগাথা তাকে এক শলা এক্সপেনসিভ সিগারের প্রমিজ করে অতঃপর উঠে পড়ে।

হোমলেসকে দেখে থেমে পড়াটা বোধ করি ম্যানুয়েলের পছন্দ হয়নি। সে আমাদেরকে দ্রুত হাঁটার জন্য পোলাইটলি অনুরোধ জানায়। আরেক ধাপ নামতেই পাতালরেলের এদিকটা ছিমছাম হয়ে ওঠে। সপ্তাহ খানেক হলো আমি প্যারিসে মেট্রোয় চড়ে ওদিক ওদিকে খানিক ঘুরপাক করছি। এ নগরীর পাতালরেলের কিছু কিছু স্টেশন সাজসজ্জার দিক থেকে অত্যন্ত সুদর্শন। বাস্তিল বলে একটি স্টেশনে তো মাটির তলাটা সে আমলের দূর্গের নকশা ও ফরাসি বিপ্লবের সময়কার অভ্যুত্থানের নানাবিধ দ্রব্যসম্ভার দিয়ে সাজানো। গতকাল একবার ল্যুভ মিউজিয়মের দিকে যেতে হয়েছিলো। ট্রেন থামতেই মনে হয়েছিলো চলে এসেছি রীতিমতো যাদুঘরের অন্দরমহলে। এসকেলেটার ধরে আরেক ধাপ নামতেই ভূতলের এ রেল স্থাপনাটিকেও দেখায় দারুণ দৃষ্টিনন্দন।  বাঁকানো সিঁড়ি ধরে আমরা আবার নামি পরবর্তী প্ল্যাটফর্মে। ঘোরানো সিঁড়িপথের দেয়ালে নানা বর্ণে আঁকা বিশাল একটি ম্যুরাল। তাতে মূর্ত হয়ে উঠেছে  শতাব্দীখানেক আগেকার প্যারিস। ওখানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই নিচের লেয়ারের সুনসান পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ রঙের ছিমছাম রেল-কার। কিন্তু ওদিকে সরাসরি যাওয়ার উপায় নেই। আমরা একটি ওভারব্রিজ পাড়ি দিয়ে নামি। টিকিট ঘরের কাছাকাছি এক চিলতে চাতালে দাঁড়িয়ে গিটার বাজিয়ে সুরলহরী ছড়াচ্ছে এক অল্পবয়সী বাদক। চেনা সুরের সংবেদনশীল আওয়াজে মানুষটি ফরাসি ভাষায় গাইতে গাইতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বোধ করি আমরা যে নন-ফ্রেঞ্চ স্পিকার তা বুঝতে পেরে পরিষ্কার ইংরেজিতে গেয়ে ওঠে,‘ ইফ ইউ ডোন্ট থিংক প্যারিস ইজ নট মেড ফর লাভ/ গিভ প্যারিস ওয়ান মোর চান্স.. ..। ’  আমি এক্সাইটেড হয়ে আগাথা ও ম্যানুয়েলকে বলি,‘ বুঝলে হে গানটি আসলে রচনা করেছেন আমেরিকান সং-রাইটার জনাথন রিচম্যান। লিরিকটি হালফিল এত লোকপ্রিয় হয়েছে যে বাজারে তার ফরাসি ও ইতালিয়ান ভার্সন ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। ’

 হোমলেস-মেট্রো এনট্রান্স

আগাথা দাঁড়িয়ে পড়ে সুরলয়ে কাঁধ দোলালে আমরাও থেমে পড়ি। সে গায়কের গিটার কেসে ইউরোর কয়েকখানা নোট রেখে আমার দিকে ফিরে বলে,‘ইউ সিম নো কোয়াইট আ বিট অ্যাবাউট মিউজিক। ’ আমি লজ্জিতভাবে জবাব দিই,‘নট রিয়েলি। ’ সে আমার কাঁধে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে বলে,‘আই নিড টু ফাইন্ড আউট হোয়াট ইউ রিয়েলি নো অ্যাবাউট সংস্। ’ ম্যানুয়েল এতে বোধকরি অধৈর্য হয়, সে হাত বাড়িয়ে আগাথার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,‘হানিসাকোল, উই নিড টু ক্যাচ দ্য ট্রেন। লেটস্ মুভ। ’

রেল-কার দাঁড়িয়ে থাকা প্ল্যাটফর্মের দিকে যেতে যেতে কোথায় লাঞ্চ করা যেতে পারে তা নিয়ে ম্যানুয়েল ও আগাথার কথাবার্তা হয় খানিকটা। ম্যানুয়েল কয়েকটি রেস্তোরাঁর প্রস্তাব করে। প্যারিস নগরের কোথায় কী আছে সে সম্পর্কে আগাথা অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। ম্যানুয়েলের সাজেশন নাকচ করে দিয়ে সে এমন একটি রেস্তোরাঁয় যাওয়ার উদ্যোগ নেয় যার ফরাসি নামের বাংলা অনুবাদ হবে ‘ছাগল ও বাঁধা কপি’র ঠেক। ’ আমরা ভূগর্ভস্থ ট্রেনের কমপার্টমেন্টে উঠে বসি। আগাথার হবি হচ্ছে সময় কাটানোর জন্য কার্টুনের সিরিয়ালে চোখ বোলানো। ম্যানুয়েল আগে থেকে আইফোনে কিছু কার্টুন সেভ করে রেখেছে। আগাথা তাতে চোখ রাখলে সে তার মসৃণ কাঁধ ম্যাসেজ করে দিতে থাকে। কার্টুন দেখতে দেখতে ক্রমশ বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে ওঠা গ্রিক দেশের বিচিত্র নারী একা একা হাসে।  

এক পর্যায়ে সে আইফোনের স্ক্রিন ক্লোজ করে তা ম্যানুয়েলের হাতে ফেরত দিয়ে আমার দিকে গ্রীবা ঘুরিয়ে তাকায়। তারপর হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে আমার কব্জিতে রিস্টব্যান্ডে গাঁথা জেড পাথরের সবুজ চাকলা। আমি তার দিকে ঘুরে তাকালে পাথরটির প্রশংসা করে সে বলে,‘ইউ হ্যাভ আ ভেরি প্রিটি, কুল অ্যান্ড সুদিং স্টোন অন ইয়োর রিস্ট। ’  এ মন্তব্যে প্রীত হয়ে আমি এবার আরো অন্তরঙ্গভাবে তাকাই। তার লো-কাট নেকের গোলাপি ত্বকে রীতিমতো নক্ষত্র হয়ে ঝুলছে নীল রিবনে গাঁথা একটি বড়সড় সান-স্টোন। বলি,‘নেভার সিন সাচ্ আ বিগ চাংক অব আ সান-স্টোন। অরুণ পাথরের এত বড় টুকরা কিন্তু আমি জীবনে প্রথম দেখছি! দিস রক লুকস্ সো চার্মিং আগাথা। ’ পাল্টি দেয়ার মতো প্রতিক্রিয়া জানায় সে,‘ তুমি তো দেখছি অ্যাপ্রিসিয়েট করো সুদর্শন পাথর, দিস ইজ ভেরি ইমপ্রেসিভ। ’ 
 প্যারিস মেট্রো
আগাথার আরো কাছাকাছি হয় ম্যানুয়েল, সে তার কোমর জড়িয়ে ধরে ঊরুতে আলতোভাবে হাত বোলাতে বোলাতে যেন তার শরীরের দখল নিয়ে বলে,‘মাই ফ্রেন্ড ইজ আ কুল গাই, তার কালেকশনে আছে প্রচুর ইন্টারেস্টিং পাথর। আমাকে সে একটি মিস্টিরিয়াস পাথর ধার দিয়েছে। ভাবছি আজকে যখন তোমার কাছাকাছি হবো...। ’ বাক্য শেষ না করে সে কী যেন ভাবে, তারপর আগাথার কানে কানে কিছু বলে। নারীটির চোখমুখ অপ্রত্যাশিত রোমাঞ্চে লাজরক্তিম হয়ে ওঠে। তখনই আমার মোবাইল ডিভাইসে সিয়েরা লেওন থেকে সংবাদটি আসে।  

সিয়েরা লেওনে যেখানে আমি আজকাল স্থায়ীভাবে বসবাস করছি, ওখানে কাজের সূত্রে পরিচয় জোসেফ হুভারের সাথে। মোবাইল ডিভাইসে আসা তাঁর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুসংবাদ আমার মনে ছড়ায় বিপুল বিষণ্নতা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এ ক্রমাগত উন্নয়নের যুগে ভেবেছিলাম বিলাতের ভালো একটি হাসপাতালে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাঁর চলে যাওয়াতে মনে হয় ক্ষতিগ্রস্ত হলো আমার সামাজিক সম্পদের বিরাট একটি অংশ। সিয়েরা লেওনে ইবোলার এ বিপন্ন দিনগুলোতে কেবল মাস কয়েক আগে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অবসরপ্রাপ্ত রূপালি চুলের এ ইংরেজ কূটনীতিক ফিরে এসেছিলেন সিয়েরা লেওনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেবা প্রদানের অভিপ্রায়ে। আটের দশকের মাঝামাঝিতে তিনি ফ্রিটাউনে ব্রিটিশ দূতাবাসে ছিলেন উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক কর্মকর্তা। তারও আগে বোধ করি সাতের দশকের প্রথম দিকে তিনি ভলানটিয়ার ওভারসিজ সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে কাটান বছর দুয়েক। তখন রপ্ত করেন স্থানীয় মেন্ডি গোত্রের ভাষা ও সংস্কৃতি। তাঁর সেবামূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সিয়েরা লেওনের মানুষজন তাঁকে আফ্রিকান কায়দায় অনারারি প্যারামাউন্ট চিফ হিসাবে অভিষিক্ত করে।

 ম্যুরাল-প্যারিস মেট্রো

ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জন্ম হয়েছিলো জোসেফ হুভারের। তাঁর পিতা সিনিওর হুভার ছিলেন আই সি এস অফিসার। যশোহর, সিলেট প্রভৃতি জায়গায় কাজ করেছেন ডিসি হিসাবে। মি. হুভার বাঙলা বলতে পারতেন যৎসামান্য। বালক বয়সে তিনি পড়াশুনা করেছেন দার্জিলিং-এর একটি কনভেন্ট স্কুলে। ভালোবাসতেন মশলাদার ভারতীয় খাবার। আমার কটেজে চিকেন কোরমা বা পালক পনির রান্না হলে রিং পাওয়ামাত্র চলে আসতেন সিঙ্গল মল্ট স্কচের বোতল নিয়ে। ওস্তাদ আলী আকবর খানের সরোদের তিনি ছিলেন মনযোগী শ্রোতা। হেমন্ত কুমার বা পঙ্কজ মল্লিকের গানও তাঁকে অনুপ্রাণিত করতো।

সুস্বাস্থ্যবান এ গল্ফ খেলোয়াড়ের বয়স হয়েছিলো প্রচুর। স্বাভাবিক হালতে তাঁর মৃত্যু হলে আফসোসের কিছু ছিলো না। কিন্তু যেভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে তা মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়। মি. হুভারের দ্বিতীয় পত্নীর মৃত্যু হলে তিনি বিপুল বিত্তের অধিকারী হন। সে সম্পদ দিয়ে তিনি আফ্রিকার গ্রাম উন্নয়নের জন্য চালু করেছিলেন ছোট্ট একটি সেবামূলক ফাউন্ডেশন। সিয়েরা লেওনে তাঁর কোনো অফিস বা কর্মচারি ছিলো না। এ দেশের মানুষজনের সাথে তাঁর সামাজিক যোগাযোগ ছিলো প্রচুর। তা ভরসা করে নিজেই ভাড়া করা পাজেরো গাড়ি নিয়ে চলে যেতেন গ্রামেগঞ্জে। কাবালা জেলার একটি অঞ্চল ইবোলামুক্ত হলেও ওখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ তাবৎ কিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক সময় মি. হুভার কাবালাতে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেছিলেন। ওখানকার পথঘাট তাঁর ভালো করে চেনা। তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন দুটি গ্রামে কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা জাতীয় প্রকল্প চালু করার। সিয়েরা লেওনের রাজধানীর বাইরে ব্যাংকের মারফত ফান্ড সরবরাহ করা বিঘ্নিত হয়ে আছে বেশ কয়েক মাস ধরে। তাই, মি. হুভার দুটি গ্রামের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ক্যারি করছিলেন দশ হাজার ডলারের সমমানের স্থানীয় কারেন্সি।  

চলবে...

যোগাযোগ

বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৭
এসএনএস/জেএম

আগের পর্ব পড়ুন-
** প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো/পর্ব-১/বাস্তিল ডে’র বিভ্রান্ত অভিসার
** প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো/পর্ব-২/বাস্তিল ডে’র বিভ্রান্ত অভিসার​



 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।