ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শামীম রেজার কবিতা: পাথরচিত্রে হৃদয়গাথা

বনানী চক্রবর্তী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০২১
শামীম রেজার কবিতা: পাথরচিত্রে হৃদয়গাথা শামীম রেজা

ও পরাণী দেখেছো কি? মথুরার মাঠে বসে তুমি নির্জন
সাঁকোর শরীর এলিয়ে আমি
কলমি শাবক

সাঁকোর শরীর এলিয়ে কলমি শাবক হয়ে গ্রামবাংলার বুনো গন্ধ নিয়ে নব্বই দশকে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল এক তরুণ কবির, যাঁর ঐতিহ্যে বরিশাল হলেও বরিশাল বলতে যাঁর কথা প্রথমেই মনে পড়ে যায়, হ্যাঁ, আমি কবি জীবনানন্দ দাশের কথা বলছিলাম, তাঁর প্রভাবমুক্ত হয়ে, পূর্বসূরির কিছু শব্দবন্ধ কারুকাজ মননে জারিত করে প্রথম যৌবনের উৎসব প্রাঙ্গণে এসেছিলেন। পূর্বসূরির অন্ধ অনুসরণ থেকে দূরে নিজস্ব কথন ভঙ্গিমায়, শব্দ নির্মাণে, প্রেম, আঘাত, বাস্তবতা, ইতিহাস, পুরাণ, প্রকৃতিকে নিজের মতো করে মাটি জল গাছ লতাপাতা ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, ধর্মদর্শনকে সম্পৃক্ত করে নিয়ে কবিতার নতুন বিশ্ব রচনা করলেন।

সে বিশ্বে কবি জসীমউদ্‌দীন, শামসুর রাহমান, জীবনানন্দ দাশ কিংবা বিনয় মজুমদার উঁকি দিল কখনো মনে হওয়ার আগেই ‘আমরা বেড়েছি স্যাঁতসেঁতে পিছলা আস্তিনের কচুরিপানা জলে’ এই উচ্চারণ আমাদের কবির নিজস্ব ভুবনে নিয়ে যাবে। আমরা হাত ধরে ফেলব ভূমিস্বর্গের কবি শামীম রেজার।

সচেতন গোছানো শব্দ কেটে জুড়ে, বাক্যবন্ধ তুলে এনে জোড়-কলম ঘটিয়ে, কিংবা ছন্দের স্রোতে যাবতীয় দুর্বলতা ভাসিয়ে কেয়ারি করা ফুলের বাগান গড়ে তোলেননি শামীম তাঁর কাব্যভুবনকে, অগণিত কবির অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের ভিড়ে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না তাঁর ‘প্রতিভা সন্তরণ, এমন রাত্তির শেওলি চোখ’।

এ কথা জনান্তিকে বলে রাখি শামীম নব্বই দশকে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, ১৯৯০ থেকে ২০০১-এর অনুভূতিমালা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পাথরচিত্রে নদীকথা’। এরপর একে একে ‘নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে’ (২০০৪), ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ (২০০৬), ‘ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুলে’ (২০০৯), ‘শামীম রেজার কবিতা’ (২০১২), ‘হৃদয়লিপি’ (২০১৪) বা ‘দেশহীন মানুষের দেশ’ (২০১৮) থেকে চর্যালোক তাঁর স্বতন্ত্র যাত্রা অব্যাহত থেকেছে। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।

যদি প্রথম কাব্যগ্রন্থের দিকে তাকাই, তবে দেখব-শুধু স্থানিক সংকট, আত্মিক সংকট নয়, পূর্বাপর কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে আছে যেমন তাঁর কবিতা, সময়ের সংক্রমণও তাঁকে পিছু ছাড়েনি। ইতিহাস পুরাণের অধীত জ্ঞানের স্বাক্ষর নিয়ে বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী পৃথিবীর হতাশা, নিরাশ্বাস, বিজ্ঞানভাবনা, যৌনচেতনা, যন্ত্রের জয়যাত্রা, সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ, নাস্তিকতা, আত্মকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের পলায়ন মনোবৃত্তি, এবং সর্বোপরি বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পেতে টেলিভিশন যুগ পেরিয়ে কম্পিউটার, ইন্টারনেট সবটুকু অভিজ্ঞতা সঙ্গে করে নিয়ে কবিতার সঙ্গে হাঁটা শুরু করেছিলেন কবি শামীম। কিন্তু সে ক্ষেত্রে অন্ধ অনুকরণ বা অনুসরণ নয়, জীবনের অনিবার্যতার বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করে, বাধ্যত পরিত্যক্ত জীবনকে ভোগ করে, শুভকামিতার হাত ধরতে চেয়েছেন। শিকড়ের দিকে ফিরতে চেয়েছেন। হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকার স্বভাবধর্মে, প্রেমধর্মেই এই কলমের ধারা।

শামীমের কবিতা পাঠ করলে, একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়, শামীম কবিতা লিখতে চাননি, সাজানো গোছানো মনভোলানো কবিতা লিখতে চাননি। যা জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন, উপলব্ধি করেছেন সেই ক্ষরণকে কলমে ধারণ করেছেন। সকলের কাছে বিষয়টি জীবন্ত ও স্পষ্ট করে তুলতে যতটুকু প্রকৃতি, ইতিহাস, পুরাণ, মিথ, জগৎ জীবনকে ছুঁতে হয় ঠিক ততটুকুই ছুঁয়েছেন। ভেতরের সংবেদনশীল মন, উদার মন, ক্ষমাশীল মন, প্রেমিক মন উদার আকাশের কাছে যে কথা প্রতিনিয়ত প্রকাশ করে, নিজেকে মিশিয়ে দিতে চায়, ঠিক সেই কথাগুলোই, একান্ত সৎ অনুভূতিগুলোকেই কলমবন্দি করেছেন। তাই তার কবিতায় পৃথিবীর সংকীর্ণতা, দৈন্যতা, ঈর্ষা, হীনতা, নীচতার আলতো ইঙ্গিত দিয়ে তার পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন। ঘৃণা সন্দেহের তীব্রতা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেননি, নিজেও থেকেছেন অমলিন। ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বলা হয় তিনি সমাজের ক্রূর, স্বার্থান্বেষী, শঠ মানুষের ছবি আঁকতে অপারগ। বলা হয় এটা তাঁর সীমাবদ্ধতা। শামীমের ক্ষেত্রে বলতে পারি, বিভূতিভূষণের মতো তিনিও সেই শ্রেণির মানুষ ও সমাজ পরিবেশের ছবিকে আলতো করে স্পর্শ করে পাশ কাটিয়ে যান, পাঠকের কাছে রোম সমাজ নীরোর মতোই লেলিহান আগুনশিখা কবলিত প্রাসাদে বসে বাঁশি বাজান। সত্য ও সুন্দরকে ছুঁয়ে থাকতে চান।

এ কথা আর বলব কী নতুন করে, আমাদের অনুভূতি যেখানে বেদনাকে ছুঁয়ে যায় সম্পূর্ণত, সেখানেই হৃদয়ের বীণার তারে ঝংকার ওঠে। সাত সুরে কোমল ভৈরবী বেজে ওঠে। আমরা আমাদের খুঁজে পাই। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোই বুঝি সব সেরা শিল্পের কারসাজি। তাই, আত্মকথন যখন বেদনার সেই তারে স্পর্শ করে দেয়, যে তার সেই গোপন ব্যথার মতো, সচেতন মন লুকিয়ে রাখে নিভৃতে, গোপনে, কিন্তু হাত বারবার সেখানেই স্পর্শ করে দেখতে চায়, বুঝতে চায় সে আজও আমার আছে কি! এই গোপন ব্যথার মহাকাব্য ক্ষণিক উদ্ভাস কবিতা হয়ে ধরা দেয় কবির কাছে, পাঠকের কাছে। নানাবিধ ব্যথার মণিমালা শামীম উজ্জ্বল রত্ন করে সেভাবেই কণ্ঠে ধারণ করেছেন।

বরিশালের ভূমিপুত্র শামীম রক্তে শিরা উপশিরার মতো নদীকে অনুভব করেছেন। কী নরম পেলব তাদের নাম। কেউ নদ, কেউ নদী। নদীর সুধায় ভিজে ভিজে মাটিও আহ্লাদে আটখানা হয়ে উপহার দিয়েছে অগণিত গাছগাছালি, পাখপাখালি। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা এই ভূমির মতন মানুষেরাও অত্যন্ত কোমলমতী। এই বাংলায় জন্মগ্রহণ করা কবি ও সাহিত্যিকরাই তার প্রমাণ। শামীমও নদী, নারী, প্রকৃতি, পশুপাখি, শিশু সকলের প্রতি প্রেমের চোখে দেখেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থে উঠে এসেছে অতৃপ্ত প্রেমের নকশিকাঁথা। এ যেন আরেক পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের মতো আরেক রূপাইয়ের কাব্যগাথা। এখানে প্রেয়সী সাজু তার অনন্ত কবরে শায়িত নয়, সমাজ, সংসার পরিবেশ প্রতিবেশের জীবন্ত কবরভূমিতে সে হতে পারে ঘোমটা মোড়ানো এক বধূ। পল্লি প্রকৃতি যেন সেই কান্নার সুর বুকে ভরে নদীকে দিয়েছে উপহার। জল স্থল অন্তরীক্ষ প্রেমিকের চোখের জল আর বুকফাটা আর্তনাদ আসমুদ্র হিমাচলে মিশিয়ে দিয়েছে। কবি অনন্ত আকুতিতে প্রিয়তমাকে সম্বোধন করেছেন ‘ও পরাণী’...আমরাও হৃদয়ের ব্যথার তারে সেই ঝংকার অনুভব করেছি—

“ও পরাণী মথুরার মাঠে বসে তুমি নির্জন
এ পাড়ায় আমি কাদা ছানি
                যুবক কুমার”

পটুয়ার মতো, সে কাদার সমস্ত বালি কাঁকর দূরে ঠেলে দিয়ে গড়ে উঠবে অনন্ত প্রেমের প্রতিমা, ‘রাধার মূর্তি’।

ক্রমশ আঁধার হয়, জীবনের ঘোর অমানিশা নামে। চুলের কাজল দেহ বেয়ে মাঝরাত নেমে আসে। ‘ও পাড়ার কুমারীরা চোখ বোজে/অলস আঁধার’/মায়াময় বাঁশরিতে হিমায়িত ঘুম আনে’ অবিচল চেয়ে থাকা, অনিঃশেষ আরতিতে মেতে থাকা এ বিল্বঠাকুরের হৃদয় চিন্তামণি চিন্তা থেকে দূরে যেতে পারে না কখনো। সমাজ কলঙ্ক ভেবে যতই ভাবুক সেই মেয়ে ‘পামরী লেগেছে আমার বীজধানে/সর্পিল সময়’ আজও প্রেম প্রতীক্ষায় ‘শুকনো মালঞ্চলতা চেয়ে আছে বর্ষার আশায়। ’

‘শেষরাতে শাঁখাভাঙা গোঙানিতে বধূ’ ফিরে পেল সামাজিক জীবনের যা কিছু লেনদেন। এ দারুণ সময় আঁধার। সর্পিণী মেঘ। এভাবে গিলছে ফেলে চির আকাক্সিক্ষত চিরচেনা চাঁদের শরীর। এতদিন যা ছিল একান্ত নিজস্ব এক প্রাপনীয় ধন। আজ সে যে দূরে বহুদূরে। বুকফাটা আর্তনাদে দীর্ণ বাতাস বলে সেই কথা। ‘ও পরাণী’ আমি আছি, আছি আজও আমি শুধুই তোমার। ‘কীভাবে ভেসে আছি নদীজলে, অবলা অনঘ। ’

‘সখী আমার অন্যের বধূ’ সেকি আর সহ্য হয়, সহ্য করা যায়! ‘চারিদিকে তার ঘর, কানে বাধে শাঁকধ্বনি। ’ হায় হায় অবিরাম দীর্ঘশ্বাস আকাশ নদীরে ছুঁয়ে যায়।

কবির পরাণী দুঃখ সুখের নক্সীকাঁথার সুচের এ-ফোঁড় ও-ফোঁড়ে রঙিন সুতোর পাকে জড়িয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন বিঁধে যাওয়া যন্ত্রণার ফুলকারি নিয়ে কলসি ভাসানো জলে থইথই কান্না, অভিমান যন্ত্রণার দিনলিপি লিখে যায় সে। আবার অবেলায় অনবধানতায় কলসি ভেসে গেলে কবি সেই পানপাত্রে তৃপ্ত হতে ছুটে যান, বিনিময়ে তৃষ্ণা ও জ্বালা সঙ্গী হয়ে ওঠে। ভালোবেসে নীলকণ্ঠ মহাদেব যেন। কণ্ঠনালিতে তাঁর বিষ। প্রস্তরপুরী নিঃশেষ করে মনের অচিনপুরে পরাণীর বাসা খুঁজে খুঁজে বুককে বিদীর্ণ করেন। হাহাকারে চাতকের মতো কণ্ঠচিরে রক্ত বেয়ে আসে ‘দেখে যাও তুমি হৃদয় আমার মেঘ, ঝড়-গর্জন’—

“ছায়ার মাঝে রোদের দীর্ঘশ্বাস
চোখে আমার জ্বলন্ত উনুন। ” [পরাণী ও বধূসরা নদী]

কবি তাঁর প্রেমিকাকে ছুঁয়ে আবার কখনো ইতিহাস, কখনো পুরাণ আবার কখনো সাধারণ গ্রামবাংলার পল্লিপ্রকৃতির নিস্তরঙ্গ জীবনচর্যাকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করেন। প্রেয়সীর আদরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেন—

“বালক মাঝি কতটা জলে কেটেছো সাঁতার
এক জীবনে কতটাই বা খোঁজ রেখেছো
সান্ধ্যজলের জোয়ার ভাটার” [পালকি ও কৃষ্ণগহ্বর]

সঘন গহন অনুভব কবিকে এই অনুভবে এনে দাঁড় করিয়েছে এক জীবনে জীবনের যা কিছু অপ্রাপনীয়, সবটুকু সাধ মেটানো সম্ভব নয়। মিটে গেলে সান্ধ্য জোয়ারভাটাকে মেপে ফেলতে পারলে তিন থেকে সাড়ে তিন হাত দক্ষিণে চরের শরীরে বরফনদী ঘুমিয়ে পড়ত না, অথৈ শ্রাবণ ভেসে যেত। জীবনের বহু রহস্যের আবরণ উন্মোচিত হয়ে যেত। জানা হয়ে যেত-তিনশ ষাট রসের গৃহ, সাড়ে তিন হাত অনন্ত দ্বীপ, ঝাউ কাউ তিয়েন পাহাড় কিংবা মামদোনগর থেকে কৃষ্ণগহ্বর।

আমরা আদিম মানব হয়ে যে গুহাচিত্রে আমাদের প্রথম প্রক্ষোভ লিপিবদ্ধ করে রাখতে পাথরের গায়ে চিত্রকথা এঁকেছিলাম, মালগার গুহাচিত্রের সেই শিকার কাহিনি, অনূঢ়া সবুজ কোষে সেই প্রথম নিষেক ঘটেছিল ভোরের রোদ্দুরে, সেও তো যেন পদ্মপাতার জল। ভারতসাগরজলে কীভাবে হারায়। এই নিজেকে সমর্পণের, আবেগের আশ্রয় পেতে ধাবমান ভালোবাসা যে ফেরোমন ছড়িয়েছিল সেই তো আমফুল সুবাস। প্রেমিক মন এই অতৃপ্তি এই আফসোস নিত্য করে চলে—

‘বাতাস যতটা চেনে-ততটা তুমি চেনো না মেয়ে’

এই অনন্ত অনন্য চিরকালীন আর্তি ও আশ্রয় আকাঙ্ক্ষায় কবি তাঁর পরাণীকে অভিযোগে দীর্ণ করেন, অসহায়তায় অপাঙ্গে হৃদয় করুণা জলে ভাসে—

“ঘোর দেশের মধুমন্ত নগরে, অনার্য বংশোদ্ভূত
আমি, পূর্বপুরুষের কীর্তি দেখে নির্লজ্জ নৃত্য করি, আমার মনে
পড়ে-যে রাধিকার বাসক শয্যায় কেটেছে নৌকাবিলাস—
কতটা জেনেছি তাকে”—

সত্যিই কি জানা যায়; এক জীবনে! হরিষপুর থেকে আপন গৃহ বা তিতিল শয্যায় মনে হয় এই বুঝি নোঙর করে পেলাম আশ্রয়, আবার কখন নৌকা ভেসে যায় অজানা ভাসানে।

প্রেম সার্থক নিরর্থকতার দোলাচলতায় দুলতে দুলতে ডুবে ভেসে পথ চলে। ধ্বংস হয়। মাসকারার ধ্বংসপ্রাপ্ত গুহা থেকে উদ্ধার হয় দুর্লভ ফসিল। নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মন আত্মপ্রশ্নের মুখোমুখি হয়—

“আমি এক জুনিপোকা
অন্দরমুখী নারীপুচ্ছে আলো জ্বেলে
এতকাল কেটেছি সাঁতার”

অথচ জানা হয়নি কখনো—

“এমন পালকীর কয় জানালা কতটাই বা আদর?”

কবি শামীম রেজা যে অনির্বাণ প্রেমশিখা কবিতায় জ্বালিয়েছেন, যে শিখা আগেও ছিল। সে জ্বালাও কোনো অংশে কম কিছু নয়। জ্যান্ত ও জীবন্ত অনুভূতির মতো তারাও আছে যে পাশাপাশি। ঢেউয়ের মতন, সমান্তরাল পথ করে যেন। যদি একবার সে দিকে তাকাই দেখতে পাব, কবি জয় গোস্বামী তাঁর নিজস্ব কথন ভঙ্গিমায় প্রেমকে ছুঁয়ে ছেনে দেখছেন। অনুভব করছেন। বিরহকে আগুনে আগুনে লেলিহান করে তুলছেন—

“না মেঘ চাই না আমি তোর স্মৃতিভ্রমণ এসে মারুক আমাকে
প্রতিটি নিষিদ্ধ স্বপ্নে। চাই না দূরের ঘাটে আমাকে ভাসিয়ে দিক ওরা
‘সাপে কেটেছিল’ বলে। আমি জানি যে আমাকে কেটেছিল
                        আজো সেই সর্পিণীর দেহ
সৎকার করেনি কেউ। ফেলে গেছে নির্জন শ্মশানে।
তুমি কি জীবিত? বলো তুমি কি জীবিত বলে যতদিন তাকে আমি
                        জাগাতে চেয়েছি ঘুম থেকে
তত সে পাথরে লেগে গড়িয়ে গিয়েছে আরো নিচে
অথচ বনের মধ্যে ফিরে এলে তার শনশন শ্বাস
                        শোনা যায় পাতার ভিতরে। ”

জয়ের কাঙ্ক্ষিত অন্বেষণ, শামীমের কাঙ্ক্ষিতের প্রতি আকাঙ্ক্ষা তীব্র উভয়ত, কিন্তু এই তীব্র জ্বালাকর অনুভূতির যে যার মতন করে ধারণ করেন। জয় তাঁর প্রেয়সীকে নিয়ে ঘুমের খাদে নেমে সূর্যাস্তরাঙা পথ ঘুরে, পাহাড়ঘেরা গাঁয়ে গিয়ে উপস্থিত হতে চান। আবার সে সর্পিণীর বিষে জর্জরিত হতে চান। শরীরে আবার জ্বালবে পাতা। সমস্ত রাত ঘোর অন্ধকার গিরিখাতে নিজের চিতাকাঠকে মশাল জ্বেলে উদযাপন করবেন।

—এ উদযাপন বুঝি সব কবিরই কাঙ্ক্ষিত। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যেমন হুল ফোটায় সেই মৌমাছি। এ অনন্ত বিরহ মিলনের আর্তি দুই কবি, বুঝি সেভাবেই দুজনে স্পর্শ করে থাকেন। শামীমও অনন্ত আগ্রহে আহ্বান করেন—

“হৃদয় আমার চিতায় দগ্ধসদ্যপোড়াকাঠ, চোখ খোলো তুমি
আদি মাতার মেয়ে স্বপ্ন পরাণী; আমার বুকের হাড় তার প্রতিমা অলংকার
শতাব্দীর ক্রান্তিকালে ভ্রষ্ট নদীর নাভিঘ্রাণ থেকে জন্ম এসব প্রিয়ার
চারিদিকে শ্মশান মূর্তি বিষময় সময়
            তবু ভালোবেসে আমি রূপকথা নদী
            কোথায় সেই পল্লীবালা শশিমুখী
            যার কান্নায় জন্মাবে আজ বধূসরা নদী”
                [পরাণী ও বধূসরা নদী]

তাঁর প্রেমিকার কান্নায় শুধু বধূসরা নদী নয়, এই অতৃপ্তি অজানাবসত ক্রমশ মনে মনে নিভৃতে অভিমানের গোপন সুখ ছুঁতে চায়। চোখের কোলে ইরেকটাসের দেহাবশেষ, অদূরে জন্ম-ঢেউয়ের রেখা, স্মৃতি কাব্যে বিরাজ করে। বিরাজ করে কোটি বছরের পুরনো আয়োজন। রেখার আড়ালে জলদাহে বহুকালীন অভিমানে কুরে কুরে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া উইয়ের ঢিবি পুড়ে গেলে ঈর্ষারা হলুদ মেঘ হয়ে গলে পড়ে, ভেতরে নির্মিত নদীর ঘোলাজলে মিশে যায়। সে নদী কোথাও স্পর্শ করে ইছামতিকে। কণ্ঠচিরে অভিমান সরিয়ে তার প্রেয়সীর সাকিন ঠিকানা দিতে ইচ্ছে হয়। ‘পড়শিবাড়ির ঘাটে, আমার ইচ্ছামতি থাকে...। ’ সে মেয়ে নাইয়র শবের আতরজলে মিশে যেতে পারে না। সে আছে, সে আছে। তোরই চোখের পাতায় যে ঘোর নামে সেখানেই আসে চালতাপাতা ভোর। সে আছে তাঁর প্রকৃতিতে, গ্রামবাংলায়। আজন্ম মঙ্গলদাত্রী নিমের ছায়া হয়ে একদিন ভেসে গিয়েছিল কোনো এক খেয়ালী রাতে। তার কণ্ঠেই আমাদের পল্লিবাংলার ছয় ঋতুর স্পষ্ট আনাগোনা, হৃদয়ে ঢেউয়ের মুদ্রা উথালপাথাল নদী। তাকে সেই চিনতে পারে, যে জানে সন্ধান।

‘শবের কায়ায় চিনবে সে জন, যার-আপন মুদ্রা চেনা। ’

নিভৃতচারী প্রেমিকের কথা, হৃদয়ের জ্বালাকর তুষের আগুনের মতো জ্বলে থাকা বিরহের কথা, মিলনাকাঙ্ক্ষার কথা, প্রেয়সী ও প্রকৃতিকে এক করে দেখায় জীবনানন্দ দাশকে বলা যেতে পারে মাইলস্টোন। তিনিও তাঁর আকুতিতে যেভাবে আমাদের কাছে পৌঁছেছেন, সেভাবে আমরা প্রেমকে চিনেছি, প্রকৃতিকে চিনেছি, প্রকৃতিকে চিনতে জীবনানন্দের মতো বরিশালের ভ‚মিপুত্র কবি শামীম রেজাও ‘মেটাফর’ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তাঁর মতো করে। আর একবার ফিরে দেখি। শামীম লিখছেন তাঁর প্রেয়সীর চোখের পাতায় যে ঘোর নামে, সেখানেই আসে ‘চালতাপাতা ভোর’। জীবনানন্দ লেখেন প্রেমকে এভাবে—

যদি সে-পাতার ’পরে-শেষরাতে পৃথিবীর অন্ধকারে শীতে
তোমার ক্ষীরের মতো মৃদু দেহ-ধূসর চিবুক, বাম হাত
চালতা গাছের পাশে খোড়ো ঘরে স্নিগ্ধ হয়ে ঘুমায় নিভৃতে,
তবুও তোমার ঘুম ভেঙে যাবে একদিন চুপে অকস্মাৎ,
তুমি যে কড়ির মালা দিয়েছিলে-সে-হার ফিরায়ে দিয়ে দিতে
যখন কে এক ছায়া এসেছিল ... দরজায় করেনি আঘাত।

আসলে কবি শামীমও গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও সাধারণ পল্লিয়ানাকে দুহাতে মেখে রয়েছেন। তাই তো বলতে পারেন—আমরা যারা বেড়েছি কাঁটালতা ঝোপঝাড় ছুঁয়ে কুঁড়েঘরে তাদের জন্মমৃত্যু আচ্ছন্ন হয়ে আছে ‘সন্ধ্যা আর দিবসের তমসায়। ’ তাদের আলাদা করে দিনের আলোর উজ্জ্বলতা নেই, গহন আঁধারেই ঢেকে রয়েছে জীবন। বহমান নদী টলটলে জলধারা নিয়ে এগিয়ে চলার কথাই তারা তো বলতে চেয়েছে। অথচ কী বিষম দুর্দৈবের ক্ষণ ‘কী তামাশার খেয়ালে প্রভু নদীর জলে শ্যাওলা বানালেন’ বহমানতায় এই স্থবিরতা এনে দেয়া জীবন থমকে দেয়া ঘটনার আঘাত নিদারুণ। বাধ্যত আমরা বেড়েছি স্যাঁতসেঁতে পিছল আস্তিনের কচুরিপানার জলে। এ আস্তিনে আজও লুকিয়ে কী আছে, জানা হয়নি। শীত রাতের ধোঁয়াশা জড়ানো নীরব শিশির বিলীন হয়ে যায় সকালের নরম রোদ্দুরে। বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যায়। কবির সঙ্গে যেন আমাদেরও অনুভূতি আক্রান্ত হয়ে বলে—আমাদের জন্ম আর মৃত্যুর খবর রাখেন শুধু কালোমাটি আর মেঘময়ী বাতাস। তাহলে কি আমরাও কালো হয়ে গেছি! নির্জীব হয়ে গেছি! সন্দেহের বিষবাষ্প ডেকে ডেকে বলে—

‘আমরা যারা সহস্র বছরের সঞ্চিত রাত্রির নিচে গৃহবন্দি নীচ প্রজাতি’ প্রভু এদের মতো করেই কি নিঝুম নদী বানালেন! ‘যারা শত অত্যাচারেও নির্জীব নিঝুম থেকে যাবে, মাথা তুলবে না। নীরবে নিভৃতে কর্মধারাটুকুই বয়ে চলা একমাত্র হয়ে থাকবে আজীবন—রবীন্দ্রনাথের সেই শ্রমজীবী নিরন্ন মানুষগুলোর মতো। ‘ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে,’ ‘শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে ওরা কাজ করে’ এ যেন তারাই—কোনো জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, রাত্রি নেই, দিন নেই, উত্থান নেই, পতন নেই, ধীর স্থির যেন। যেন—

‘খাঁচার শাবক খামখা খামখাই পাখা ঝাপটাই
করুণার জল আবাহনে নিজেকে ছড়াই, হয়তো কারো নাম ধানশাঁই
                    কেউ বিষখালী
                    আবার কেউবা
                    কীর্তনখোলা নদী”

প্রথম পর্বে কবি তাঁর মানসী তাঁর জীবনদেবতাকে ‘পরানী’ সম্বোধনে আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতে বীণার ঝঙ্কার তুলেছেন, হারানোর বেদনা জাগিয়েছেন। দ্বিতীয় পর্বে সে পরানী এসেছে নানা রূপে। কখনো ধ্যানী নদী, কখনো দোলনচাঁপা চোখের সঙ্গিনী, কখনো কৃষাণবালা, কখনো বা সে কাজরী সুরের মেয়ে, রোমান্টিক স্বপ্ন কল্পনায়, প্রেমের পাথারে ভেসে কোনো নামে ডেকেই যেন তৃপ্তি হয়নি তাঁর। সে যেন কখনো বরিশাল গ্রাম, কখনো বরিশালের রূপবতী নদী। আমরাও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘশ্বাসে শ্বাসে, নদীতে ভেসে ভেসে তার পরিক্রমা করে চলেছি, কবির কাব্যভুবনের অঙ্গনে বিচরণ করে।

সর্বোপরি নদী কবি শামীম রেজার এক অপূর্ব দুর্বলতা যেন। নদীমাতৃক বরিশালে জন্মসূত্রে এই থইথই অথৈ নদীর বুকে ভেসে থাকা বুঝি তাঁর ভবিতব্য। তাই চিত্রকল্পের মুনশিয়ানায় জীবনের বহু কথা, বহু ব্যাকুলতাকে নদীনামা করে তুলতে পারেন তিনি। বলতে পারেন ‘আমরা যারা অনন্তের পথে হাঁটছিলাম, হাঁটা নয় ভাবছিলাম, ঈশ্বরী পাটনীর খেয়ায়, দিগন্তের সুমেরু নদী অতিক্রম করবো ভেবে, হঠাৎ পথের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়েছিল কেউ...। ’ সে কে! আমরা সকলেই তাকে দেখতে চেয়েছিলাম, সে কে! কোথায় পাব তারে! অচিরেই মনে হয়, একই জনস্রোত বহন করে চলেছে বহু চেনা অচেনা নদী হয়েই তারা। যেভাবে বরিশালকে, বাংলাদেশকে ঘিরে রয়েছে বহু বহমান ধারা। সকলেই যাবে তার কাক্সিক্ষতের অভিমুখে, সমুদ্রের পথে, নানাভাবে, নানারূপে...শুধু একটিমাত্র ধ্যানী নদী...শুধু একা পৌঁছবে, স্বপ্ন সমুদ্রের মোহনমোহনায়—কিন্তু তাকে কবি চিনতে চেয়েও সঠিকভাবে কি চিনতে পেরেছেন! সে কোন নদী! যাকে হারিয়ে ফেলেছেন পথ চলতে চলতে, নাকি আজ সে অন্যনামা কেউ! এক ব্যথা জাগানো জিজ্ঞাসা ও বিস্ময় নিয়ে শামীম পাঠককে সঙ্গী করে নদীতে ভাসান তার কলার মান্দাস।

পুরাণ, ইতিহাস, সমকালীন বাস্তবতা এবং প্রেম দু’হাতে আলিঙ্গনে বেঁধে রাখেন এই কবি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পাথরচিত্রে নদীকথা’তেই এই প্রতিভার স্বাক্ষর দেখে চমকিত হতে হয়। যেখানে নদীটানা ধনুক ধরনে বেঁকেছে, নদীর সতত বাঁকের কাছে, জীবনের সতত বহমান বাঁকের ইশারায় আমাদের সচকিত করে দিলেন। ধনুকের বাঁক সেই প্রবল পরাক্রমশালী পেশিবহুল পুরুষ রামচন্দ্রের হরধনুর কথা চকিতে স্মরণ করিয়ে দিল। স্মরণ করালো সেই অসহায় নারীর কথা, যে এই হরধনু ভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে ভাঙা কপাল নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েছে। যার রাজার ঘর, শ্রেষ্ঠ রূপবান পুরুষ স্বামী, তাঁকে বনবাস, হরণ প্রভৃতি অনিবার্য ঘটনার পাশাপাশি সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা ও সন্তানসম্ভবা অবস্থায় না জানিয়ে বনের মধ্যে পরিত্যাগ করে আসবার মতো ঘটনার শিকার হতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সমালোচক অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার মজুমদারের একটি উক্তি মনে পড়ে যাচ্ছে—

শিল্প সাহিত্য সৃষ্টির কলা কৌশলের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের গভীর সূক্ষ্ণতন্ত্রী জড়িয়ে থাকে। যাঁরা শিল্প সাহিত্যের মধ্যে অতিকথা বা মিথ খোঁজেন তাঁরা সৃষ্টির মধ্যে সেইসব রহস্যময় উপকরণ অবশ্যই খোঁজেন যেগুলির মধ্যে মানুষের হৃদয়ের সর্বজনীন অদ্ভুত নাট্যস্পন্দনের সন্ধান পান। সেদিক থেকে অতিকথা ভিত্তিক সমালোচনা বা myth criticism শিল্প সাহিত্য সৃষ্টির ঐতিহাসিক ও নন্দনতাত্ত্বিক সমালোচনাকে অতিক্রম করে আদিম মানুষের আদিমতম আচার ও বিশ্বাসের জগতে নিয়ে যায়, আমাদের হৃদয়ের গভীরতম তলদেশটি স্পর্শ করে। ৪

এই মিথের স্পর্শ আমাদের বঙ্গদেশের যে কোনো নারী, যার কোনো ইচ্ছারই মূল্য দেবার দায় সমাজ সংস্কারের নেই, মনে করিয়ে দেয়। এই মেয়েরা শুধুই অবহেলা যন্ত্রণা পায়ে পায়ে জড়িয়ে নিয়ে পা ফেলে, কবির সেই নদীযাত্রায় ধনুক ধরনের নদীর বুকে ভেসে যাওয়া দলের সঙ্গিনীর মতোই। প্রকৃতি যেন উদার শুভ্রতায় ঘোমটা খুলে হাসিমুখে সকলকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছে। ‘রাতের জলের পালকে সময় চোখ খুলে আছে নিরলস’ কিন্তু ‘নিদ্রাতুর বর্ষার ঘ্রাণে’ তাঁদের দলের দোলনচাঁপা ফুলের মতো অসামান্যা মোহময়ী চোখের নারী, ঈর্ষণীয় রূপ নিয়েও ভবিতব্যকে অতিক্রম করতে পারেনি। কোনো এক অজ্ঞাত কিংবা জ্ঞাত কারণে সে আজ শ্রান্ত ক্লান্ত, শরীর ও মনে অবসন্ন, মৃতপ্রায়। হঠাৎ চেতনা হারানোর মতো বাধ্যতা ঘিরেছে তাকে—

তার পরিশ্রান্ত পাণ্ডুর মুখে দ্বিতীয়ার
করুণ আলো স্থির হয়তো সেখানে ছিল তার গৃহস্থালি
একটু সামনে লোর শামুকচর। [‘দোলনচাঁপা চোখের সঙ্গিনী’: পাথরচিত্রে নদীকথা]

যন্ত্রণায় বিষণ্ণতায় অসহায় হয়ে আমরা কবির সঙ্গে সেই দ্বিতীয়ার চাঁদকে শঙ্কিত হয়ে চেয়ে দেখি, সমব্যথী মন ওই নারীটির সঙ্গে সমপ্রাণ হয়ে ওঠে। নীড়ভাঙা কান্না ফুঁপিয়ে ওঠে হৃদয়ের ধারাজলে।

কিন্তু কবির জীবনদর্শন ‘চরৈবেতি’, চলার অপর নাম জীবন, থেমে যাওয়াই মৃত্যু। অতিদূর পান্থনিবাস চারদিকে দুলে ওঠা বেণীজলের অঙ্গন ছুঁয়ে জীবনের আলো স্পর্শ করে জীবনরাত্রির প্রথম প্রহর...পথচলা থামে না। কেউ আসে কেউ যায়। জীবনের এই অনিবার্য আসা যাওয়া মেনে নিতে হয়।

আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি; কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো; আশ্চর্য দর্শন বহু আছে
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনা আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে। ৫

নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতো, ক্ষীণ চন্দ্রকলার মতো কিংবা গ্রহণ হবার ফলে অদর্শনে থাকা চাঁদের মতো সে থাকে, সঙ্গেই থাকে, অদৃশ্যে, অচেতনে। কিন্তু তার জন্য থেমে থাকা তো চলে না। জীবন অনন্ত। ‘অনেক দিন ছিলেম প্রতিবেশী’, ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাস করেছিলেম এই অনুভবটুকু পাথেয় করে কেউ কেউ চলে যায়, চলে যেতে হয়—

আমরা ফেলেছি দূরন্ত দাঁড়, পিছনে পড়ে আছে
পারিজাত বন-অলকার জল, চারিদিকে বইছে শুধু
প্রতিভা সন্তরণ,...

‘Survival for the fittest’ যোগ্যতমের উদ্বর্তন, জীবনযুদ্ধের এ লড়াই, প্রতিভা সন্তরণ মেনে নিয়ে এমন রাত্রি, নোঙরবিহীন শ্যাওলার মতো, সবুজ অস্থায়ী চোখ বন্ধ করে সকাল হবে একদিন। ‘কোন বিধি সিরজিল সোতের শেওলি/এমন ব্যথিত নাই যে ডাকি বন্ধু বলি,’ এ কাতরতা হয়তো স্পর্শ করবে না কোনো চোখ, কোনো শ্লথগতি পদচারণা। সকাল সে রঙিন কিংবা ধূসর যেমনই রং নিয়ে আসুক স্থির হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করার সময় যে নেই। তাঁর যে কাজ রয়ে গেছে বহুবিধ। আকর্ষণ রয়ে গেছে বহুমুখী। বিন্ধ পর্বতের বাধাকে নমিত করে জীবনের পথ যাত্রার পথ সকলের জন্য সুগম করে তুলতে হবে—কালের যাত্রার ধ্বনি কবির কানে বেজেছে। প্রয়োজনে ঋষি অগস্ত্যের মতো চিরতরে অসীমের পথে পাড়ি দিতে হবে। ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি’ যে তারুণ্যের মশাল হাতে নিয়ে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলে গিয়েছিলেন, তারই প্রতিধ্বনি, কানে নিয়ে এক আস্তিক্যচেতনায় সত্য, শিব ও সুন্দরকে স্পর্শ করে পথচলার অঙ্গীকার করেছে তাঁর অন্তরাত্মা।

সত্য, শিব, সুন্দরকে কবি শামীম যেমন তাঁর চেতনায় ধারণ করে আছেন, তেমনি তাঁর সৎ অনুভূতি প্রেমকে উজ্জ্বলতর মহিমায় ভাস্বর করেছে, এর স্বাক্ষর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। কবি এ নিষ্ঠুর পৃথিবী, জীবনের কাঁটাঝোপ ভোগের পথচলায় প্রেয় ও প্রেয়কে দুহাতে জড়িয়ে থেকেছেন। প্রেয় ও প্রেয়র দ্বন্দ্বে বিক্ষত হৃদয় প্রেয়কে গোপন কন্দরে শুক্তির মধ্যে লালন করে প্রেয়কে আশ্রয় করেছেন। অত্যন্ত বৈষ্ণবীয় দর্শনে স্নাত কবি তাঁর প্রেয়সীকে আজন্ম ভূমি ছুঁয়ে থাকা নারীকে বলেছেন, ‘ও কৃষাণবালা’ দুরন্ত উদ্দাম প্রথম যৌবনের পাড়ভাঙা আবেগ নিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল প্রকাশ করেছেন দুর্মর আকুতি নিয়ে। ভাঙনের নদী তিনি, দুইপাড় ভাঙতে ভাঙতে তৃষ্ণা বুকে নিয়ে ঘুরে চলেছেন তাঁর হৃদয়ের মধুরানগর তথা মথুরানগর। মথুরানগর মাথুরের দীর্ঘ বিরহের দ্যোতক হয়ে উঠেছে। প্রেয়র পুরনো ডাকাতিয়া বাঁশির সেই সাহস নিয়েও শেষ পর্যন্ত প্রেয়র বাঁধকে মেনে নিয়েছেন, এর বিরহী চোখের সন্ধান কখনো ফুরোয়নি। স্বপ্নবিভোর হয়ে প্রেমিকা, তার অথৈ জলের সাঁকো, তার বাহুতে বাহু রেখেছেন, সওয়ার হয়েছেন। এ মিলনমেলা অচিরেই ভেঙে গেছে। তারপর শুধু—

নিরুদ্দেশ ঢেউয়ের আঁচড় / দগ্ধ কাঁকড়া হাঁটে
সমস্ত শরীর

জলজ প্রণয় জলের মাঝেও দুরন্ত চিতা জ্বালিয়ে রাখে। কখনো বাঁধভাঙা প্রণয় তৃষ্ণায় গ্রীষ্মের রাতের প্রলয় সাগর ভাঙনের নদী হতে চান। চিরবিরহ-চিরকালীন প্রতীক্ষা কখনো ভাবালুতায় আবিষ্ট করে, প্রেমের দশ দশার উন্মাদগ্রস্ততাও আক্রান্ত করে, স্বপ্ন দেখায়। যেন তাঁর প্রেমিকা আবার তাঁর কাছে ফিরতে পারে। আবার সেইদিনের প্রতীক্ষা হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়—

নাইয়র তুমি কবে গয়না নাওয়ে যাবে অভিসার

কবি আলোক সরকারও তার মানসীর সঙ্গে প্রেমের অভিসারের চিত্র তুলে ধরছেন এইভাবে—

আলস্যরঞ্জিতা তোমার কুঞ্জবনে এই অভিসার
পথ বর্ষণমুখরিত নয়, সর্বসঙ্কুল অরণ্যময়
প্রতিবন্ধকতা দূরস্থিত স্মৃতি,...
শ্যামলিম পথ অর্পিত অভিসার
অনুশাসিত অতীত নয় বাসনা নির্দেশিত ভবিষ্যৎ নয়
অনুষঙ্গরিক্ত এই বর্তমান প্রবহমানতা,
আলস্যরঞ্জিতা তোমার কুঞ্জবনে অনন্তকাল
চৈতন্যবিলুপ্ত আমার যাত্রা, আমার সমগ্রতা। ৬
[‘অভিসার’ : আলোক সরকার]

অতীত অনুশাসন, বাসনা নির্দেশিত ভবিষ্যৎ কোনো কিছুই প্রেমকে বাধা মানাতে পারে না। অহেতুকি, অনুষঙ্গরিক্ত বর্তমান প্রবহমান অভিসারে সব প্রেমিক-প্রেমিকাই ভেসে যেতে চান। শামীমও তার কৃষাণবালার সঙ্গে সেভাবেই হিত অহিত ভুলে অভিসারে গয়না নাওয়ে ভাসতে চেয়েছেন। সত্যি সে দিন কোনোদিন হয়তো আসবে না। ‘গাঙে যে আউলা স্রোত’, তাই শোকশয্যায়ই কাটবে রাত। আশা-নিরাশার দোলাচলতায় দোদুল্যমান হৃদয় এই প্রতিবন্ধকতাও মানতে চায় না বলে উচ্চারণ করে—

চন্দন গন্ধ শরীর ভাঙবে গয়না নাও, নদী আজ
নাইয়র বরণ

কিন্তু ভেতরের প্রেয় সত্তা, সামাজিক সত্তা জানে এ অসম্ভব, এ যে অসম্ভব। কল্পনার জলস্রোত কোথাও এক সন্দেহ চিহ্নকে অতিক্রম করতে পারে না। নাওয়ে ভাসা শরীর এপাড় ওপাড় করতে করতে আকুতি জানায়, অধরা স্বপ্নের দিকে অঙ্গুলি সংকেত করে বলে—

ও কৃষাণবালা... দেখে যাও তুমি,
দুই হাতে গড়ি আমি ভাঙনের নিত্য আয়োজন

এই ভাঙনের নিত্য আয়োজন, নিজেকে নিয়ে নানা সর্বনাশা যন্ত্রণার
মাঝখানে পৌঁছে যেতে চান যে কোনো প্রেমাস্পদ, যে কোনো বিরহী কবি। শামীম যেমন ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন বিরহে, বেদনা, নোবেলজয়ী নরওয়ের কবি Knut Humson শুধু বিক্ষত নয়, মৃত্যুচিন্তায় ডুবে গেছেন। যদিও শামীম Humson-এর মতো মুক্ত যৌনতাবাদী নন, তবুও Humson চেয়েছেন সে মৃত্যুর বর্ণনা শুনে যেন তাঁর প্রেমিকা শিউরে ওঠে। প্রেমিকাকে তিনি কাছে পাননি, তাই, প্রেমের কাছ থেকে চরম শাস্তি পেতে চেয়েছেন। অভিমানে দীর্ণ হৃদয় সে কথা প্রেমিকাকে জানাতে চেয়েছে, এই ভেবে, এ জ্বালা যেন তাকেও সমানভাবে দগ্ধ করে। Humson বলছেন—না প্রিয়তম, ঈশ্বর আমাকে গরম আবরণের মধ্যে বিছানায় শুয়ে নিশ্চিন্ত মৃত্যু দেবে না, আমার বিছানার পাশে কোনো প্রিয়জনও কাঁদবে না। আমি চাই তাঁর কাছে তিনি যেন—

Let me be struck down one day unexpected
and fall in the forest someplace neglected,
where no one can find me will I lay dying. ৭

একান্ত অপাঙ্ক্তেয়র মতো, কিংবা ধরা যাক অরণ্যপুত্রের মতো তিনি পরিত্যক্ত হয়ে গভীর অরণ্যেই মৃত্যুকে বেছে নেবেন—

As a son of the forest who knows it well,
it will not deuy my humble request to dwell
at long last upon some mossy mound.

মৃত্যুর সময় তার সমস্ত শরীর যেন শ্যাওলায় ছেয়ে যায়, এ শ্যাওলা যেন তার প্রেমিকার যোনি আবৃত কেশরাশির মতো। সেভাবেই তিনি তাঁর প্রিয়তমাকে ছুঁয়ে থাকতে পারবেন।

প্রেম যতক্ষণ হৃদয় আচ্ছন্ন করে রাখে, প্রেমাস্পদকে সব মুহূর্তেই ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, এমনকি মৃত্যুতেও সে স্পর্শ যেন বিচ্যুত না হয় এই চিরকালীন আকাক্সক্ষার প্রতিরূপ যেন সব প্রেমকেই ছুঁয়ে থাকে।

যে কোনো সার্থক কবির প্রেম ও প্রকৃতির এই একাত্মতা, এই মিলে যাওয়া বুঝি স্বভাবধর্ম, প্রেমকে প্রকাশ করতে দিশেহারা কবি প্রকৃতিতে আশ্রয় নেন। কালের আঁধার রেণু যখন জীবনকে গ্রাস করে, জীবন হয়ে ওঠে তাঁর গোলকধাঁধার কৃষ্ণকুটীর। কবি শামীমও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর বিশ্বাসের আয়ু ফুরোনো যন্ত্রণায় ক্রমাগত দীর্ঘশ্বাসের নদী বয়ে চলেছে। সে নদীতে সাঁতার দিতে দিতে বিশ্বাসের স্মৃতি পাখি উৎসব রাত হয়ে ওঠে। মাতা মুহুরীর জলের সান্ত্বনা আচ্ছন্ন করে ফেলে। একদিন তার সব ছিল রাধাচূড়ার কিচিরমিচির পাতা, হৃদয়ে উথালপাথাল নদীর ঢেউ। হঠাৎ হৃদয় থেকে নদী নেমে গেলে পায়ের রেখায়, যাবতীয় রহস্যরং কৃষ্ণআঁধার হয়ে যায়—

শিথিল চন্দ্রের রাত ছেনে ছেনে চাঁদকপালি নদী
শিমোয়

ঝিনুক মায়ায় শুক্তির মাঝে মুক্ত আদরে ঘুমিয়ে রয়েছে যেন। আহা নদী! যা ছিল একদিন আমার কিংবা আমাদের একান্ত। একান্ত নিজস্ব ভুবন। চেনা পরিসর। চেনা জনপদ। অধরা মাধুরী। সব আজ পাড় ভেঙে ভেঙে ভাঙনের মহাকাব্য যেন।

আমি কি কীর্তনীয়া নদী কীর্তনখোলা
যিনি প্রতিদিন পায় ভাঙনের হাজারটা সমন

সময় পরিবেশ মুহূর্ত ক্ষণ এ পৃথিবী চিরকাল ঢেলে সাজিয়েছেন। নদীর বুক দিয়ে বয়ে গেছে অবিরত জল, হাওয়ার আবেগে নাওয়েতে লেগেছে তুফান। জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে জন্ম-মৃত্যুর কল্কা হয়ে চলেছে। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি যেন মুদ্রার এপিল ওপিঠ। এইমাত্র পেয়েছি মনে হয়, আবার কখন যেন সুদূরে মিলায়। যা চলে গেছে, হারিয়ে গেছে, অপস্রিয়মাণ সেই মৃত পাঁজরের টানা বাতাসে পালতোলা অভিমানে বুক ফুলিয়ে চলে নাও, কীর্তনীয়া কীর্তনখোলায় উঠে উত্তাল ঢেউ। জীবন নদী ফুলে ফুলে ওঠে, দীর্ঘশ্বাস, হারাবার দীর্ঘনিঃশ্বাস বাতাসে ছড়ায়, এতদিন যা ছিল, যা থাকতে পারত আজীবন কাছে, সেইসব হারাবার জ্বালা, নদীর কান্না, কৃষ্ণপক্ষে চন্দ্রাহত রাধার নৃত্যনাচন মনে হয়। বুকের মাঝেতে আশ্রয় নেয়া অগণিত মাছেদের আত্মত্যাগের কাল তীর্থযাত্রার মতো যদি বা কখনো পবিত্র হয়ে ওঠে, তবুও কোথাও বিচ্ছেদের বিরহের কাজল মেঘের ছায়া নদী আর সইতে পারে না, মুহ্যমান হয়, শান্ত হয়ে চলে। অন্তঃসত্ত্বা জারজ জলের প্রলয় নৃত্য ভেঙে যায় অবলা মৃত্তিকার দুইধার। খাঁখাঁ বুকে ভাঙনের রেণুকণা ভাসে যেন, সাদা থানের মতো, বৈধব্যের চিহ্ন বুকে নিয়ে, হৃদয়ের খাঁজে খাঁজে হারাবার বেদনার স্মৃতি মৃতদের দাঁড় হয়ে হৃদয় গহিন জলে চলে বয়ে। গুণ টানে যেন সেই কতশত কঙ্কালের হাড়। অধরা মাধুরী আর হলো না নিজের করে পাওয়া। সীমার বাঁধনে বুঝি আর তাকে ছুঁয়ে দেখা যাবে না কখনো। এই এ হতাশ্বাস তাকে খোঁজে বারবার যে মানসী হয়তো গ্রামের এক নামহীন অবয়ব যেন। সেই বুঝি অসীমের সঙ্গে ঘর বাঁধে, সীমায় ধরার আগে সীমায়িত হয়ে যায় চাওয়া পাওয়া।

কবি আল মাহমুদও এই সীমায়িত বাধার চলার দিকে দৃষ্টি দিয়ে যাবতীয় বাধার পরিখাকে তুলে ধরেছেন একটি কবিতায়—

আমরা কোথায় যাবো, কতদূর যেতে পারি আর
ওই তো সামনে নদী, ধানক্ষেত, পেছনে পাহাড়।
বাতাসে নুনের গন্ধ, পাখির পাপড়ি উড়ে যায়
দক্ষিণ আকাশ জুড়ে সিক্ত ডানা সহস্র জোড়ায়; ৮
[প্রত্যাবর্তন]

এ যাওয়ার সীমাবদ্ধতা কবিকে যেমন সীমায়িত করেছে, আবার সীমাহীন প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখে দুর্মর আগ্রহে উচ্চারণ করেছেন তিনি—

প্রাণের রঙের মত পরাজিত প্রেমের কেতন
আবার তুলতে চাই পলাতক আমরা ক’জন।

এই স্বপ্ন দেখাই তো কবিকে, প্রেমকে দীর্ঘজীবী করে। থাক না অনন্ত জীবনে, বহমানতায় নানা প্রতিবন্ধকতা। জীবন যেন শিবসা নদী। সে নদীতে যতই থাকুক অবিশ্বাসের আগুন। তার জ্বলন তাপ ও দাপ চিতা চোখের দীর্ঘশ্বাস যতই সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে চাক, কবি সেই ফিনিক্স পাখি, ছাইয়ের মধ্যে আবার নতুন প্রাণের কোরক জাগানোর বিশ্বাস আনতে পারেন।

কবি জানেন শিবসা নদীতে, প্রেমের তরঙ্গে স্নিগ্ধ জলধারা পুড়ে গেছে। জলহীন সমতলে খরায় ফুটিফাটা চারধার। কোনো রস নেই, রং নেই, রূপ নেই। সব নিভে গেছে। পৃথিবীর সব মানুষই যেন ঘুমিয়ে আছে লাশের চোখের ছায়ায়। কোনো চোখের চাহনিই আর বুকে তরঙ্গ তোলে না। চারিদিক শ্মশান ও শবদেহে ছেয়ে গেছে। মৃত্যুপুরী যেন। মায়াবন বিহারিণী আজ ছায়ার মায়ামৃগের চোখে অপস্রিয়মাণ। মায়ামৃগের চোখে দ্রুত হেঁটে হেঁটে জীবনের ভেলা ভাসিয়েছে যে অলক সময়, অবিশ্বাসের আত্মদহনে সেই অনন্তপুরী আজ মরুভূমি, খাঁখাঁ হয়ে গেছে। জীবন যেন বিশ্বাসী সত্তার সঙ্গে নিত্য ‘বৌচি’ খেলে চলেছে। জীবনের নতুন দিনের সূর্য ঘুমের দেশে লাজুক তারাদের সঙ্গে রাত্রি সহবাসে গেছে। সে রাত্রি তাঁর কাছে অমানিশা রাত। রাত সহচরী সেই অনূঢ়া নারী একদিন কালোবরণ, কুচবরণ কুমারের সঙ্গে রূপকথার গল্পের মতোই আঁধার গাছ পেরিয়ে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখত। ভাবত একদিন ঝড় থেমে যাবে। শান্ত পৃথিবী আহ্বান করবে তাদের যুগল মুরতিকে। যেন রাই ও কিশোর। সে আর হলো না।

আজও মাটির বুকের দহন জ্বালায় ব্যথার দিঘিতে বড়শি পেতে পেতে এখনও ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে কোনো শিরি। অপেক্ষা করে চলেছে তার ফরহাদের। ফরহাদ শিরির প্রেম সার্থক হবার স্বপ্ন জ্বলে উঠবে আলেয়ার মাঝে আলোর মতোই। অদৃশ্য নিয়তি ফরহাদ শিরির মিলন ঘটতে দেয়নি—

শিবসা নদী শিবহীন আত্মপূজার জল

এখানে আর কোনো দিন স্রোতজলে ঢেউ খেলবে না। যে বাঁশি ভেঙে গেছে, তার বুকে আর সুর জাগবে না। শুধু প্রতীক্ষা দিন মাস বছর অতিক্রান্ত হবে, স্বপ্নের মরীচিকা বুনে যাবে। যেভাবে স্বপ্ন দেখেছেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, একদিন ফিরে আসার, নিশ্চিত ফিরে আসার—

তোমাকে বলেছিলাম, যত দেরীই হোক,
আবার আমি ফিরে আসব।
ফিরে আসব তল-আঁধারি অশত্থ গাছটাকে বাঁয়ে
রেখে,
ঝালোডাঙার বিল পেরিয়ে,
হলুদ ফুলের মাঠের উপর দিয়ে
আবার ফিরে আসব।
আমি তোমাকে বলেছিলাম। ৯
[তোমকে বলেছিলাম: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী]

কবি ফিরতে চেয়েছেন, নৌকার গলুইয়ে মাথা রেখে নদীর ছলছল জলের শব্দ শুনতে শুনতে যত প্রতিশ্রুতি রেখে যান ফেরা আর হয় না কখনো। আমরা কেউই আর ফিরতে পারি না। এক নদীতে স্নান হয় না কখনো। তবু, এ কথা ভুলি না—

আজও আমার ফেরা হয়নি।
রক্তের সেই আবেগ এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে।
তবু যেন আবছা-আবছা মনে পড়ে,
আমি তোমাকে বলেছিলাম।
[তোমাকে বলেছিলাম]

যে পথে অগণনবার ঘূর্ণমন চক্রমনে অনন্ত আনন্দ, অনাবিল ভালোবাসা, ফুলের মতো, বীজের মতো ছড়িয়ে পড়ত চারিধারে। কলমি শাবকের মতো জলজ ঘ্রাণে লতিয়ে লতিয়ে স্মৃতিমেদুর করে রাখত, এককালে। যার জন্য পাহাড় ঝরনা নদী লঙ্ঘন করার দুর্দমনীয় সাধ জাগত। তার হৃদয়ে জেগে থাকবার কোনো অভিজ্ঞানও হয়তো দেয়া হয়ে ওঠে না। কোনো স্মৃতি অঙ্গুরীয়। শুধু হৃদয়ে রয়ে গেছে যেটুকু ‘তোমার প্রেম জীবনে আমি রাখিয়া এলেম’

এমন আশ্চর্য কিছু স্মৃতিচিহ্ন নেই...
        যা তোমাকে দিতে পারি :
তুমি তো নিজেই স্মৃতি প্রণয় অঙ্গুরী, আমি
কখনো খুলিনা কোনদিন ১০
[এবাডিন মার্কেটে কিউরিও: শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়]

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যসূত্র:
১. কবিতা সংগ্রহ, ‘পাথরচিত্রে নদীকথা’ কাব্যগ্রন্থ, শামীম রেজা, ছৈতন্য, মো. জাহিদুল হক চৌধুরী, কানিজ প্লাজা, জিন্দাবাজার, সিলেট, বাংলাদেশ। প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০১৮।
২. এসেছি সূর্যাস্ত থেকে — জয় গোস্বামী, অসংকলিত কবিতা, কবিতা সংগ্রহ, আনন্দ পাবলিশার্স, ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা-৯, প্রথম প্রকাশ: জুলাই ১৯৯০।
৩. জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ প্রথম খণ্ড রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থ, জীবনানন্দ দাশ, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৪, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ: বৈশাখ ১৩৭৭।
৪. উপন্যাসে জীবন ও শিল্প — উজ্জ্বল মজুমদার, দেবাশীষ ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ৬/২ রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, কলকাতা-৯।
৫. আর যদি নাই আসো — বিনয় মজুমদার।
৬. অর্থহীন অর্থহীনতা কাব্যগ্রন্থ — অভিসার, আলোক সরকার।
৭. My Grave — Knut Humson
৮. প্রত্যাবর্তন — আল মাহমুদ
৯. তোমাকে বলেছিলাম — নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১০. এবাডিন মার্কেটে কিউরিও — শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২১
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।