ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অনুবাদ সাহিত্যে পৃষ্ঠপোষকতা সময়ের দাবি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২
অনুবাদ সাহিত্যে পৃষ্ঠপোষকতা সময়ের দাবি

ঢাকা: আন্তর্জাতিক সাহিত্যমানের দিক থেকে বাংলা সাহিত্য নিঃসন্দেহে আধুনিক ও উন্নত। বর্তমানে দেশের অনুবাদকরা বাংলা সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে কাজও করছেন বেশ ভালো।

তবে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বসাহিত্যে পিছিয়ে থাকছে বাংলা সাহিত্য। এই জায়গাটি থেকে বের হয়ে আসতে সরকার এবং প্রকাশনা সংস্থাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন এখন সময়ের দাবি বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর কাটাবনের পাঠক সমাবেশে অনুষ্ঠিত 'শালুক সাহিত্য সন্ধ্যা'র আলোচনায় উঠে আসে এমন বিষয়। এদিন আলোচনার বিষয় ছিল 'বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ: অন্তরায় ও সম্ভাবনা (দুই)'।

বিকেলে নির্দিষ্ট বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আরণ্যক শামছ। আলোচনা করেন কবি ও অনুবাদক জুয়েল মাজহার, মাহফুজ আল হোসেন, শোয়াইব জিবরান, স্বপন নাথ, মোজাফফর হোসেন এবং কবি কামাল চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন 'শালুক' সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ।

মূল প্রবন্ধে আরণ্যক শামছ বলেন, বাংলা সাহিত্যের ইংরেজিতে অনুবাদ করার মতো ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের দক্ষ অনুবাদকের সংখ্যা খুবই কম। বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে সমান মেধাবী অথবা তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করা এবং এ বিষয়ের ওপর কাজ ও গবেষণা কর্ম চালিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য। যারা আছেন তারা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এবং ভিন্ন ভিন্ন পেশায় কর্মরত আছেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের অনুবাদশিল্পে আগ্রহ নেই বললেই চলে। অনুবাদ শিল্প নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা মূলত একক প্রচেষ্টায়, ব্যক্তিগত প্রেরণায়, নিজস্ব অর্থায়নে ও সাহিত্যকর্মে বিশেষ ভালোবাসার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্টভাবে অনুবাদশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করছে না বললেই চলে।

তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির অনুবাদ বিভাগ বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে ছড়িয়ে দেবে এরকম কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ জগতকে এই আস্থাশীল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অনুবাদকের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে হবে। একাডেমিক স্বীকৃতি দিতে হবে। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের অনুবাদের কাজের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। স্কুল ম্যাগাজিনগুলোতে অনুবাদককে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। তবেই মাতৃভাষার সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে এবং বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ শিল্পকে একটি মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। এছাড়া বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, জাতীয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও স্থানীয় ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে অনুবাদ কাজের গুরুত্ব তুলে ধরে উৎসাহিত করতে হবে।

মোজাফফর হোসেন বলেন, বাংলা সাহিত্যের অনুবাদে একটি বড় ব্যাপার হলো পরিভাষা। তবে আমাদের অনুবাদক যারা আছেন, বাংলা সাহিত্যকে যারা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, তারা পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের থেকে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। আমরা পিছিয়ে আছি শুধু পৃষ্ঠপোষকতায়। বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলো সম্পন্নভাবে মুনাফা কেন্দ্রিক হওয়ায় অনুবাদ কর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসছে না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর দুর্বল অবস্থানের কারণে অনুবাদ কাজে বিনিয়োগের সাহসও তারা পাচ্ছে না। মাত্র দুই একটি বিশেষ প্রকাশনা সংস্থা নিভে যাওয়া মোমবাতির মতো খানিকটা ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। এছাড়া দেশের বাইরের এম্বাসিগুলোও এ বিষয়ে নিশ্চুপ; জানিনা তারা শিল্প সাহিত্য নিয়ে আদৌ ভাবেন কি না। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে যেকোন বাজেটই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তবে আমরা এখন পর্যন্ত সংস্কৃতিতে পুরো বাজেটের একভাগ বরাদ্ধের জন্য আন্দোলন করে যাই। সেখানে অনুবাদ কর্ম হলেও সেগুলো প্রকাশের জায়গাটাও থাকে না।

কবি শোয়াইব জিবরান বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে অনুবাদের বিষয়টি তুলে ধরার ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা বাবা মায়েরা কখনো ভাবিনা আমাদের সন্তান সাহিত্যিক হবে, আমরা ভাবি আমাদের সন্তান চাকরি করবে, ব্যবসা করবে। সেদিক থেকে আমাদের নিজেদের আরো বেশি সচেতনতা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

স্বপন নাথ বলেন, অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের অনেক অপারগতা আছে। প্রতিষ্ঠানের বাইরেও আমরা যারা অনুবাদ করছি, আলোচনায় যে বিষয়টি এসেছে, সেটি হচ্ছে অনুবাদের জন্য যথাযথ বাজেট নেই। তো এখন আমাদের সেই প্রশ্নটা তুলতে হবে। আমরা যদি সুসংহত ভাবে এই প্রসঙ্গটা তুলতে পারি যে, এটির প্রয়োজন আছে, কেন এবং কীভাবে এবং কেন এটি বাস্তবসম্মত, তাহলে নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে। আমাদের যারা অনুবাদক তারা অনেক এগিয়ে গেছে। ছোট প্রকাশনা হোক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে হোক। পেঙ্গুইন বা অক্সফোর্ডের মতো প্রকাশনাগুলো ঝুঁকি নিচ্ছে এবং মুনাফা করছে। এই ঝুঁকিটা নেওয়ার জন্য আমাদের যথেষ্ট সাপোর্ট আছে কিনা এখন সেটি দেখার সময় এসেছে। সেই জায়গাগুলো এখন খতিয়ে দেখে চিহ্নিত করতে হবে।

জুয়েল মাজহার বলেন, অনুবাদ উচিত কর্ম এবং অনুবাদ হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক সাহিত্যমানের দিক থেকে বাংলা সাহিত্য নিঃসন্দেহে আধুনিক ও উন্নত। আজকের পৃথিবীতে বাংলা ভাষার মতো কবিতার ভাষা খুব কমই আছে। শুধুমাত্র অনুবাদ হয়নি বলেই বাংলার সময়োত্তীর্ণ বিখ্যাত সাহিত্যগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের তেমন যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। তবে এখন অনেক ভালো কাজ হচ্ছে। অনুবাদ শিল্প নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা এখন অনেক ভালো করছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যের অনুবাদ যেন হয়, সেটার জন্য একটা প্লাটফর্ম করা প্রয়োজন। একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া প্রয়োজন। এই প্রতিষ্ঠানকে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। শুধুমাত্র প্লাটফর্ম করলেই হবে না, বাইরের যে সাহিত্য সংগঠনগুলো আছে, প্রকাশনা সংস্থাগুলো আছে, এজেন্সি আছে, এদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের একটা অনুবাদ সাহিত্য যদি ভালো হয়, তবে তাকে বাইরের দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টা যেন এর মাধ্যমে হয়; সেদিকে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

মাহফুজ আল-হোসেন বলেন, একটি আধুনিক লিটল ম্যাগাজিন হলো 'শালুক'। এটি কাজ করছে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে। এখন এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা সাহিত্যের বিষয়গুলোকে জনগণের বিষয় হিসেবে তুলে এনে আখ্যায়িত করতে চাই যা আমাদের জন্য প্রয়োজন। আমাদের রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্য সংস্কৃতিরও একটি মিশেল ঘটেছে একাত্তরে। আমরা বলবো মুক্তিযুদ্ধের পরে সেরকম কোন জ্ঞানতাত্ত্বিক আন্দোলন কিন্তু আমাদের এখানে গড়ে ওঠেনি। কেন গড়ে ওঠেনি সেই প্রশ্নটা আমাদেরকে ভাবতে হবে। এখন অনুবাদের ক্ষেত্রে কথা বলতে গিয়ে কথা আসছে দুই ভাষাতেই দক্ষতা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে। সেই বিষয়টি এখন উত্থাপিত হচ্ছে আর সেই উত্থাপনের যে লেয়ার, সেটি তৈরি করছে 'শালুক'। যখনই 'শালুক' আলোচনা শুরু করলো, তখন অনেকেই এর সঙ্গে এসে যুক্ত হচ্ছেন। আমি মনে করি এই আলোচনার মধ্য দিয়েই একটি পাবলিক এজেন্ডা তৈরি হচ্ছে।

কবি কামাল চৌধুরী বলেন, অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা আছে। বিশেষ করে যে কোন সংস্কৃতিকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে বড় লেখক আছে কিন্তু আমরা বাইরের দেশে তাদের সেভাবে উপস্থাপন করতে পারছি না। আলোচনায় এসেছে সরকার কেন ভূমিকা রাখছে না। বাংলা একাডেমি এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করছে। আর শুধু সরকার কেন, সরকারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেউ এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনুবাদ সাহিত্যের ওপর আলাদা প্রকাশনা প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি বুক শপও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই জায়গাগুলো থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে এবং অনুবাদ শিল্পের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

আলোচনা শেষে কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আয়োজন। এসময় স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি জাফর সাদেক, আদিত্য নজরুল, শারমিন ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, রিশতিয়াক আহমেদ, পারভেজ আহসান, কবির হোসেন, মামুন অপু, বকুল আশরাফ, শাহ্ কামাল, মনীষা সরকার, আমির হামজা, শেলী সেনগুপ্ত, আরণ্যক শামছ। কবি শহীদ কাদরীর 'সঙ্গতি' কবিতা ও এর অনুবাদ পাঠ করেন কবি জুয়েল মাজহার।

উল্লেখ্য, শালুকের নিয়মিত এ সাহিত্য সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২০১৯ এর এপ্রিল মাস থেকে। প্রতিমাসে নিয়মিত একটি করে সাহিত্য সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়। এ সাহিত্যায়োজনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিবারই একটি করে মূল বিষয় থাকে এবং সে বিষয়ক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট একজন। এরপর মূল বিষয়ের ওপর আলোচনা করেন নির্ধারিত আলোচকগণ। থাকে দর্শক সারি থেকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ। এছাড়া থাকে নির্বাচিত কবিদের কবিতা পাঠ, বই আলোচনা, আবৃত্তি প্রভৃতি।

বাংলাদেশ সময়: ২৩০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২
এইচএমএস/এনএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।