ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ ভাদ্র ১৪৩২, ১৯ আগস্ট ২০২৫, ২৪ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

সড়ক নিরাপত্তা আইনে কমবে দুর্ঘটনা, রক্ষা পাবে জান-মাল

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:০২, আগস্ট ১৭, ২০২৫
সড়ক নিরাপত্তা আইনে কমবে দুর্ঘটনা, রক্ষা পাবে জান-মাল

ঢাকা: সড়ক দুর্ঘটনা বা রোড ক্রাশ, বিশ্বজুড়ে এক নীরব মহামারিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ১৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন সড়ক দুর্ঘটনায়, আরও ২০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছেন।



বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন) তথ্য বলছে, সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে সব বয়সী মানুষের মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। এটি এমন এক অসংক্রামক রোগ, যা আসলে প্রতিরোধযোগ্য। অর্থাৎ সঠিক আইন, কার্যকর প্রয়োগ, উন্নত অবকাঠামো ও জনগণের সচেতনতা থাকলে এই মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার বড় অংশই ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, মোট দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশ ঘটে এই দেশগুলোতে, যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। উন্নত দেশগুলোতে কঠোর আইন, প্রযুক্তিভিত্তিক নজরদারি, উচ্চমানের যানবাহন এবং নিরাপত্তাবান্ধব সড়ক ব্যবস্থাপনা থাকায় দুর্ঘটনা অনেক কম। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির চিত্র প্রায় একই, যা এ অঞ্চলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার বাস্তব চিত্র
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা দীর্ঘদিনের একটি জটিল ও ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়কে প্রাণ হারান। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, এ সংখ্যা বছরে ২৩ হাজারেরও বেশি।

সরকারি হিসেবে ২০২২ সালে বাংলাদেশে ৫ হাজার ২০০টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬৩৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬৪৮ জন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিসংখ্যান প্রকৃত অবস্থার চেয়ে কম, কারণ গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক দুর্ঘটনা রেকর্ড হয় না।

বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। সে বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ৯২৭টি, নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ২৯৪ জন, আহত হয়েছেন ১২ হাজার ১৯ জন। নিহতদের মধ্যে ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৬১৩ জন, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৭৭ শতাংশ। শুধু মানবসম্পদের ক্ষতির অর্থমূল্যই দাঁড়ায় ২১ হাজার ৮৮৬ কোটি ৩২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। এই হিসাবেও যানবাহন ও সম্পত্তির ক্ষতির মূল্য ধরা হয়নি। বাস্তবিক অর্থে ক্ষতির পরিমাণ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১.৫ শতাংশেরও বেশি হতে পারে।

আইন ও বিধিমালার যাত্রা
বাংলাদেশে সড়ক সংক্রান্ত প্রথম আইন প্রণীত হয় ১৯৮৩ সালে- ‘মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স’ নামে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে কার্যকর হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’। এরপর ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর এ আইনের আওতায় জারি হয় ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’।

যদিও আইন ও বিধিমালা প্রণীত হয়েছে, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমানোর ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। নতুন আইনে মোট ১২৬টি ধারা রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র দুটি ধারা (৪৪ ও ৪৯) সরাসরি সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করে। ৬২ ধারায় দুর্ঘটনায় আহতকে সহযোগিতা করার কথা বলা হলেও উদ্ধারকারী ব্যক্তির জন্য আইনি সুরক্ষা কতটা নিশ্চিত হবে, তা স্পষ্ট নয়।

সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি
সড়ক পরিবহন বিধিমালায় মোট ১৬৭টি বিধি রয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তা বিষয়ক বিধানগুলো বেশ সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-

• ১২৫ নম্বর বিধিতে গতিসীমা নির্ধারণের কথা বলা হলেও তা মনিটরিং ও প্রয়োগের পদ্ধতি উল্লেখ নেই।

• ১৩৬(৫) বিধিতে সিটবেল্ট ব্যবহারের কথা বলা হলেও, এর মান, উপকরণ বা শিশুদের জন্য সুরক্ষিত আসনের বিষয়টি অনুপস্থিত।

• ১৩৬(২) বিধিতে হেলমেটের গুণগত মান নির্ধারণের কথা বলা হলেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের উল্লেখ নেই।

• ১৪১ বিধিতে রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা নির্ধারণের কথা থাকলেও তা মাপার পদ্ধতি বা অন্যান্য নেশাদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।

• ১৪২ বিধিতে দুর্ঘটনা-পরবর্তী আর্থিক সহায়তার কথা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

এই সীমাবদ্ধতাগুলো দেখায় যে, বর্তমান আইন মূলত পরিবহন নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রিক, কিন্তু সড়ক নিরাপত্তার সব দিক অন্তর্ভুক্ত নয়।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যতা
জাতিসংঘের ‘সেকেন্ড ডিক্যাড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০২১-২০৩০’ সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাঁচটি মূল স্তম্ভ নির্ধারণ করেছে-নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী কার্যকর ব্যবস্থা।

বাংলাদেশের বর্তমান আইন ও বিধিমালা এ কাঠামোর সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উন্নত দেশগুলোর মতো কঠোর গতিসীমা পর্যবেক্ষণ, প্রযুক্তি-নির্ভর মনিটরিং, আন্তর্জাতিক মানের সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী জরুরি সেবা এখনো বাংলাদেশে যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান আইন নিরাপত্তার দিক থেকে পর্যাপ্ত নয়। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরীর মতে, বর্তমান আইন পরিবহন সংক্রান্ত; নিরাপত্তার বিষয়টি স্পষ্টভাবে নেই। স্পিড লিমিট, হেলমেটের মান, সবার জন্য সিটবেল্ট-এসব বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা থাকা উচিত।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজের মতে, আইনটি আগের চেয়ে ভালো, তবে আরও উন্নয়নের সুযোগ আছে। চালকের কর্মঘণ্টা ও বেতন কাঠামো শ্রম আইনের আওতায় আনা দরকার, দুর্ঘটনার দায় নির্ধারণে স্পষ্ট নীতিমালা জরুরি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) রোড সেফটি শাখার সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল নোমান জানান, একটি রোড সেফটি অ্যাক্ট প্রণয়নের কাজ চলছে, যার খসড়া প্রস্তুত এবং বর্তমানে রিভিউ চলছে। আশা করা হচ্ছে, এটি কার্যকর হলে সড়ক নিরাপত্তা জোরদার হবে।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা শুধু জান-মালের ক্ষতিই করছে না, বরং অর্থনীতিকেও পঙ্গু করে দিচ্ছে। প্রতিদিনের দুর্ঘটনা মানুষের পরিবার ধ্বংস করছে, কর্মক্ষম জনশক্তি হ্রাস করছে এবং উন্নয়নের গতি শ্লথ করছে। তাই এখনই প্রয়োজন একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, যুগোপযোগী সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন, যা কঠোরভাবে প্রয়োগ হবে। পাশাপাশি সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপদ যানবাহন নিশ্চিতকরণ, চালক ও যাত্রীদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিভিত্তিক নজরদারি এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। যত দ্রুত এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হবে, তত দ্রুত সড়ক দুর্ঘটনার মিছিল থামবে। সড়ক যেন আর মৃত্যুর ফাঁদ না হয়ে ওঠে-এটাই এখন সময়ের দাবি।

আরকেআর/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।