ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩২, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

যে পর্যায়ে আছে শেখ হাসিনার বিচার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১৭, অক্টোবর ৬, ২০২৫
যে পর্যায়ে আছে শেখ হাসিনার বিচার পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিচার একেবারে শেষ পর্যায়ে। তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা ও যুক্তিতর্ক শেষ হলে এ মামলায় রায়ের তারিখ ঘোষিত হতে পারে।

প্রসিকিউশন বলছে ‘অল্প সময়ের মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষ হবে’।

মূলত যুক্তিতর্ক শেষে আদালত রায় ঘোষণার জন্য মামলাটি অপেক্ষমাণ রাখবেন। এরপর আদালত রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করবেন।

জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে করা এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপ-পরিচালক মো. আলমগীর। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর গত ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।

গত ১০ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে গণঅভ্যুত্থানকালে পুলিশপ্রধান (আইজিপি) পদে থাকা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসেবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।

এরপর ৩ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে বিচার শুরু হয়। প্রথম সাক্ষ্য দেন যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত খোকন চন্দ্র বর্মন। জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন খোকন চন্দ্র বর্মণ। গুলির আঘাতে তার মুখের একটি বড় অংশ হাড়সহ নষ্ট হয়ে যায়। খোকন চন্দ্র বর্মণের ওপরের ঠোঁট, মাড়ি, নাক, তালু—এগুলোর এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

আঘাতের ধরন গুরুতর এবং আহত খোকনের মুখ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া হওয়ায় তার চিকিৎসার ব্যাপারে বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ করা হলে তাদের অপারগতা দেখা যায়। এর প্রেক্ষিতে দীর্ঘ চেষ্টার পর একপর্যায়ে এই বিষয়ে দক্ষ রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর ইউনিভার্সিটি ক্লিনিক অব লোমোনোসোভ হাসপাতাল খোকনের মুখ পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জটি নিতে সম্মত হয়। পরে চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। প্রথম পর্বের চিকিৎসা শেষে ৭ মে তিনি দেশে ফেরেন।

খোকনে পর পর্যায়ক্রমে ৫৩ সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। যার মধ্যে রয়েছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শীর্ষ সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। আর সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর।

এ বিষয়ে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা ৯২টি ডকুমেন্টারি এভিডেন্স সংগ্রহ করেছেন। ৩৭টি বস্তু প্রদর্শনী (সিডি, ডিভিডি, পেনড্রাইভ) জব্দ করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছেন। এসবসহ প্রায় ১৪ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। ৪১টি জেলায় ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। প্রায় ৫০ জেলায় লেথাল উয়েপন ব্যবহার করা হয়েছে। এই তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৩(২), ৪(১), ৪(২) এবং ৪(৩) ধারায় অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা এই মামলা চিফ প্রসিকিউটর বরাবর দাখিল করেছেন- এটা বলে জবানবন্দি সমাপ্ত করেছেন।

‘২১টি ভিডিও এবং চারটি ফোনালাপ প্রদর্শন করা হয়েছে। যেটা লাইভের মাধ্যমে গোটা পৃথিবী দেখেছে। ’ 

‘প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে মনে করি এই ৫৪টি সাক্ষীর জবানবন্দির মাধ্যমে প্রসিকিউশন এই আসামিদের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ এনেছিল তার প্রত্যেকটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন’, যোগ করেন প্রসকিউটর গাজী এম এইচ তামীম।

মামলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, এখন তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা সমাপ্ত হবে। তারপর যুক্তিতর্কে যাবে। যুক্তিতর্ক দুই পক্ষের শেষ হওয়ার পরে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখা হবে। এরপর আদালত নির্ধারণ করবেন ওনারা কবে রায় দেবেন। আমরা মনে করছি অল্প সময়ের মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষ হবে।   

সোমবার (৬ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, জাতির যে প্রত্যাশা ছিল যে এই নিকৃষ্টতম হত্যাকারীদের, গণহত্যাকারীদের, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার এই বাংলাদেশে যাতে হয়, সেটা হওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সঠিক পথে আছে। আশা করছি মানুষের প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে এ বিচার কাজ সম্পন্ন হবে।

পলাতক আসামিদের পক্ষের রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, যেহেতু আমি মোটামুটি সব সাক্ষীকে জেরা করেছি। ভালোভাবে জেরা করেছি, ভালো ভালো পয়েন্ট আনতে পেরেছি। ফৌজদারি মামলায় একটা জিনিস স্বীকৃত, সেটা হলো হাজার কথা যদি আসামির বিরুদ্ধেও যায়, আর একটি কথাও যদি আসামির পক্ষে যায় এবং সেটা যদি যৌক্তিক হয় এবং আদালত যদি মনে করেন এই বিষয়টি যুক্তির নিরিখে বিচার করা যায় তাহলে একটি পয়েন্টেও আসামিকে খালাস দেওয়া যায়। অতএব আমি বলছি না আমার আসামি খালাস এটা নিশ্চিত, তবে পাবে না এ কথাও নিশ্চিত না।   

এ মামলায় মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করেন। গুলি করে দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।

দ্বিতীয় অভিযোগ, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।

শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪-দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ চলে যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগ, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। চতুর্থ অভিযোগ, রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

পঞ্চম অভিযোগ, শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়ও অভিযুক্ত করা হয়েছে।

ইএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।