ঢাকা, বুধবার, ৬ কার্তিক ১৪৩২, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

পিআর দাবি থেকে জামায়াত কি সরে আসছে?

তানভীর আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:১৬, অক্টোবর ২১, ২০২৫
পিআর দাবি থেকে জামায়াত কি সরে আসছে?

আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির দাবি জানিয়ে আসছিল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের পর সেই দাবি থেকে দলটি সরে আসছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জামায়াতে ইসলামীর তথাকথিত পিআর আন্দোলন ‘একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা’ বলে মন্তব্য করে রোববার এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক একটি পোস্ট দেন। এরপর নতুন করে আলোচনায় এসেছে, জামায়াত কি পিআর চায়, না কি নির্বাচন পেছানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত?

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় অংশ নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে পিআর পদ্ধতির দাবিতে অনড় ছিল জামায়াতে ইসলামী। টেবিলে আলোচনা চলতে থাকলেও এই দাবিতে জনমত গঠনের জন্য মাঠে নানা কর্মসূচিও পালন করে দলটি। সে কারণে তাদের সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়।

আগামী সংসদ নির্বাচনে এই দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কয়েকটি সমমনা দলের সঙ্গে যৌথভাবে তিন দফা কর্মসূচি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে জামায়াত। রোববার আবারও একই দাবিতে যৌথভাবে চতুর্থ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে ৮টি সমমনা রাজনৈতিক দল। তবে এই দাবিগুলোর মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও ওই আদেশের ওপর আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে গণভোট আয়োজন করার দাবিই প্রধান।

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের আগে বিভিন্ন সময় জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং গণভোটের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে—সেই নির্দেশনা না থাকলে সনদে স্বাক্ষর করবে না দলটি। এগুলো উল্লেখ না থাকলেও শেষ পর্যন্ত জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছে জামায়াত। আর এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা বিশ্লেষণ, তাহলে জামায়াতে ইসলামী কি পিআর পদ্ধতির দাবি থেকে সরে আসছে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সম্প্রতি জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর গ্রহণ এবং আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনকেই অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক মনে করছে জামায়াতে ইসলামী। এ কারণে পিআর পদ্ধতির দাবি থেকে কিছুটা সরে আসছে দলটি।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে তিনদিনের যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা ৮টি রাজনৈতিক দল। প্রথম দিনের কর্মসূচির অংশ হিসাবে রাজধানীতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।

রোববার (১৯ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে ২০ অক্টোবর রাজধানীতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল এবং ২৫ অক্টোবর সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি রয়েছে। এরপর ২৭ অক্টোবর সব জেলা শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি পালন করবে দলগুলো। আগামী ২৭ অক্টোবরের মধ্যে দাবি না মানলে দেশব্যাপী বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে। এই ৮ দল হলো—বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি।

তাদের উত্থাপিত ৫ দফা দাবি হলো—
১. জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও উক্ত আদেশের ওপর আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যেই গণভোট আয়োজন করা।
২. আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয় কক্ষে/উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করা।
৩. অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সকলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা।
৪. ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা।
৫. স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।

পিআর নিয়ে যা বলেছেন নাহিদ ইসলাম
জামায়াতে ইসলামীর তথাকথিত পিআর আন্দোলন ‘একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম।

রোববার ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, আন্দোলনটি ইচ্ছাকৃতভাবে চালিত হয়েছিল ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়া ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করতে এবং গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ও সংবিধান পুনর্গঠন সংক্রান্ত জাতীয় সংলাপকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য।

নাহিদ বলেন, নির্বাচনী আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার মৌলিক সংস্কার দাবিটিকে প্রথমে একটি সাংবিধানিক সুরক্ষা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এই ধরনের মৌলিক সংস্কারকে ঘিরে একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা ও ব্যাপক জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা।

কিন্তু জামায়াত ও তার মিত্ররা এই গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডাটিকে হাইজ্যাক করে ফেলে। তারা এটিকে একটি নিছক ‘জনসংযোগ ইস্যুতে’ পরিণত করে এবং তাদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য কখনই প্রকৃত সংস্কার ছিল না, বরং ছিল রাজনৈতিক কারসাজি।  

নাহিদ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে সংস্কারের জন্য তাদের হঠাৎ এবং আকস্মিক অনুমোদন কোনো সরল সম্মতি ছিল না, বরং ছিল একটি কৌশলগত অনুপ্রবেশ। এটি ছিল সংস্কারবাদের ছদ্মবেশে এক ধরনের রাজনৈতিক নাশকতা।

জামায়াতের পিআর দাবি প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেছেন, জামায়াত মূলত নিজেদের নির্বাচনী সুবিধা আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। তাদের এই অবস্থান দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে যে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, এটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের যে দাবি জামায়াতে ইসলামী করে আসছিল, তারচেয়ে বেশি সুবিধাজনক মনে করছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। এ কারণে হয়তো দলটি সেই দাবি থেকে কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম দাবি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন।

সেই দাবিতে জামায়াত এখনো অনড় রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সমালোচনা করে যে বক্তব্য আসছে, তা বিভ্রান্তিকর।

টিএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।