ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

পানিতেই জীবন, পানিতেই মরণ!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৬ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৬
পানিতেই জীবন, পানিতেই মরণ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পাথরঘাটা (বরগুনা থেকে): ‘মোগো বাঁচতে অইলে (হলে) পানির লগেই (সঙ্গেই) যুদ্ধ হরতে (করতে) অইবে’- মাত্র উনিশ বছরের রিপনের উপলব্ধি এটি।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্কারী সিডরে পরিবারের ছয়জনকে একসঙ্গে হারিয়েছে।

সাগরে-নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে ডাকাতের (জলদস্যু) হাতে অপহৃত হয়ে ট্রলার-জাল, ধান-চালসহ মাছ ধরার রসদ খুইয়েছে রিপনের বড় ভাই মো. জালাল (২৫)। তাকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে সহায়-সম্পদ বিক্রি করতে হয়েছে এই অসহায়-দরিদ্র পরিবারটিকে। আর নিয়ত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগর,  বিষখালী-বলেশ্বর নদী বা বেশ কয়েকটি খালে ডুবে মরার ভয়-আতঙ্ক তো আছেই।

তারপরও বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের পদ্মা গ্রামের রিপন-জালালদের নৌকা-ট্রলার আর জাল নিয়ে পানিতে নামতেই হয়। সিডরের মরণ ছোবলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এই গ্রামটির নামের সঙ্গেই ভাঙন শব্দটিই যোগ হয়ে গেছে। স্থানীয়রা উপকূলীয় এ গ্রামকে এখন ‘পদ্মা ভাঙন’ বা শুধু ভাঙন বলেই ডাকছেন।

পাথরঘাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও জেলেসহ উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সংকল্প ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘পদ্মা গ্রামেরই পশ্চিম দিকে বলেশ্বরের পাড় ঘেঁষে সুন্দরবনের সীমানা শুরু। অদূরে রয়েছে বঙ্গোপসাগর-বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বরের মোহনা। এসব নদী-সাগর আর মাছ বিশেষ করে ইলিশ মাছ নির্ভর শুধু পদ্মাই নয়, পুরো পাথরঘাটা উপজেলার সব গ্রাম-জনপদের মানুষের জীবন-জীবিকা। উপকূলের এ উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষের বেঁচে থাকা এমনকি মৃত্যুও পানিকেই কেন্দ্র করে’।

তিনি বলেন, ‘সিডরে ৩৪৯ জন মানুষ মারা গেছেন পাথরঘাটায়, এখনও নিখোঁজ মাছ ধরতে সাগরে নামা ৪৬ জন জেলে। তারা মারা গেছেন কি-না তা নিশ্চিত না হওয়া ওই জেলে বাবাদের ৮৮ জন শিশু সন্তানের জীবন থমকে গেছে নানা জটিলতায়। উপজেলার ২টি পোল্ডারের ১১৭ কিলোমিটারের মধ্যে ৫৮ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। তারপর থেকে হাজার হাজার মানুষ এখনো অসহায় ও সহায়-সম্বলহীনভাবে দিন কাটাচ্ছেন, বাস করছেন ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধে’!

রোববার (২৬ জুন) সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এলাকার চরলাঠিমারার জিনতলায়, পদ্মা, তাফালবাড়িয়া, কালমেঘা, কাকচিড়া, কাঁঠালতলীর পড়িঘাটা, বিষখালীর তীরবর্তী ও দক্ষিণ চরদুয়ানীর বেড়িবাঁধের ওপরে ও পাশে কোনোমতে ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন অনেক মানুষ।

শহিদুল ইসলাম খালেদ বলেন,‘পাথরঘাটার আশি শতাংশ মানুষই শূন্যভোগী (বিনিয়োগ করতে না পারা হতদরিদ্র) জেলে সম্প্রদায়ের। তবে শতভাগ মানুষে্রই অর্থনীতির চাকা ঘোরে ইলিশ আর পানির জোরে’।

তাইতো পদ্মার রিপন-জালাল দুই ভাই আর তাদের পুরো পরিবার, মাছধরা নৌকার মাঝি (সরদার) দেলোয়ার (৪০), জাল বাওয়া (বাগি) কালছার (১২), ট্রলার ও মাছ ব্যবসায়ী আব্বাস (২৫), সিডরে পরিবারের ১৩ জনকে একসঙ্গে হারানো রহমান খাঁ (২৭), ৭ জনকে হারানো রহিম মুন্সী (৩৩) এবং ৬ জনকে হারানো জাহাঙ্গীর (২৮) সবারই একই ভাষ্য- ‘মোগো বাপ-দাদায় পানির কাম হরছে। মোরাও হিখছি একটাই কাম, এই কামই জানি। ভাতের অভাবে-টাকার অভাবে নদী-সাগরে নামতেই অইবো। না অইলে বাঁচমু কেমনে?’

বাংলাদেশ সময়: ১১০৪ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৬
এএসআর/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।