ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

‘টেয়া দিতে ন হাইরলে ঘরের বউও লই যাইগো!’

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০১ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৬
‘টেয়া দিতে ন হাইরলে ঘরের বউও লই যাইগো!’

সুবর্ণচর, নোয়াখালী থেকে: ঋণ-দাদনের অভিশাপে প্রতিনিয়ত দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হচ্ছেন উপকূলের জেলেরা। তাদের জীবন যেন ঋণের গণ্ডিতেই আবদ্ধ।

তবে এ দু’য়ের মধ্যে এনজিওর ঋণের চেয়ে দাদনকেই অপেক্ষাকৃত ‘ভালো’ মনে করছেন জেলেরা।

নদীতে মাছ থাকলে জেলেদের সুদিন, বাকি সময় চরম দুর্দিন। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই সুযোগ কাজে লাগায় কিছু সুদখোর মহাজন আর অতিরিক্ত মুনাফাখোর এনজিও।

নোয়াখালীর বিভিন্ন চর এলাকায় ঘুরে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঋণের চেয়ে দাদনই অপেক্ষাকৃত ভালো। যদিও দুটোই তাদের জন্য কষ্টকর, কিন্তু দাদনে সুবিধা হলো যেদিন মাছ ধরা পড়ে না সেদিন ব্যাপারিকে টাকাও দিতে হয় না।

অন্যদিকে, এনজিওগুলো সামান্য এদিক-সেদিক হতে দেয় না, নির্ধারিত দিন ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে ঘরের আসবাসপত্র পর্যন্ত নিয়ে যায়।

এনজিওর নির্মমতার কথা তুলে ধরে সুবর্ণচর উপজেলার চর বায়জীদ সাবাব বাজার এলাকার জেলে রফিক বাংলানিউজকে বলেন, ‘টেয়া (টাকা) দিতে ন হাইরলে (না পারলে) ঘরের বউও লই যাইগো এনজিওরা। ”

দাদনও এক প্রকার ঋণ। মাছ ধরার মৌসুম এলে এলাকার বিত্তশালী মহাজনরা মাছ ধরার জালসহ যাবতীয় উপকরণ নিয়ে নদীর একটি এলাকা দখল করেন। স্থানীয় জেলেরা ওই এলাকার মধ্যে মহাজনের উপকরণ ব্যবহার করে মাছ ধরেন। পুরো মৌসুম জুড়ে যত মাছই তারা ধরুক না কেন, সবই জমা দিতে হয় মহাজনের কাছে। ওই মাছ ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করার স্বাধীনতা জেলেদের থাকে না। আবার সেই মাছের ১০ শতাংশ মহাজনকে ভাগ দিতে হয়।

অন্যদিকে মহাজনের এলাকার বাইরে মাছ ধরতে হলে নিজেদেরই নতুন করে নৌকা, জালসহ সব উপকরণ কিনতে হয়। এজন্য অনেকেই এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নেন। এসব এলাকায় ব্র্যাক, আশা, ইসলামী ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি, সাগরিকা, প্রিজমসহ আরও কিছু এনজিও ঋণ দিয়ে থাকে।

জেলেরা জানান, সেবা ও দিন বদলানোর ব্রত নিয়ে ঋণ দেওয়া শুরু করলেও, অর্থ আদায়ের সময় তাদের আসল চেহারা চেনা যায়। সাবলম্বী হওয়া তো দ‍ূরের কথা, এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের বোঝা সইতে না পেরে দিন দিন দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়ে পড়তে হচ্ছে তাদের।

সাবাব চৌধুরী ঘাটের জেলেনেতা মীর্জা জাহের মিয়া বলেন, জুন মাসের শুরুতে বর্ষা ও জোয়ারের পানি দেখে আশায় বুক বাঁধে জেলেরা। বাঁচা-মরার লড়াইয়ের মাধ্যমে জালের ফাঁকে মাছ আটকালেও ভাগ্যের ফাঁক দিয়ে সেই অর্থ চলে যায় এনজিও কিংবা মহাজনের মোকামে।

জেলে জাব্বার মিয়া জানান, ইলিশ মৌসুমে সুদে-আসলে এ ঋণ পরিশোধ না করলে নৌকার দাঁড় টানার বদলে টানতে হয় জেলের ঘানি। অনেক জেলে এনজিও’র চড়া সুদের ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার কেউ পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘কাম করি আন্ডা (আমরা), টেয়াগুন (টাকাগুলো) যায় এনজিওর হ্যাডে (তাদের পেটে)।

সুবর্ণচরের বিস্তৃর্ণ এলাকার জেলেরা বলেন, যদি সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে কম সুদে ঋনের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে এ দুঃখ কিছুটা হলেও লাঘব হতো।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশীদ জানান, যুব উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে জেলেদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। জেলেরা প্রশিক্ষণ নিলে ঋণও দেওয়া হয়। অধিকাংশ জেলে এসব বিষয়ে সচেতন না হওয়ায় তারা উচ্চ সুদে এনজিও এবং মহাজনদের কাছ থেকে অধিক সুধে ঋণ নেয়।

উপজেলা মৎস কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, জেলেদের জন্য বছরের একটি অংশে প্রণোদনার ব্যবস্থা রয়েছে। বেশকিছু জেলে এ সুবিধা পান। জেলেরা যদি প্রশিক্ষিত হয়ে গ্রুপ হয়ে কাজ করতে চায় তাহলে তাদেরকেও ঋণ দেওয়ার কর্মসূচি রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৬ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৬
জেপি/এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।