নাফীসের জন্মদিনে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার মা একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। যেখানে তিনি নাফীসের বেড়ে উঠা থেকে শুরু করে তার জীবনের বিভিন্ন দিক স্মৃতিচারণ করেছেন।
বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য সেই চিঠিটি তুলে ধরা হলো,
আবীর , তুমি আমার অনেক আদরের বড় সন্তান। আমি আমেরিকার এরিযোনায়। তুমি বাংলাদেশে। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে মনের সবটুকু কথা তোমার কাছে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। প্রযুক্তির কল্যাণে যতটুকু কথা হয় তাতে কোনো প্রাণ নেই। নেই শারিরীক উপস্থিতি। কতদিন তোমাকে দেখিনা, আবীর (নাফীসের ডাক নাম) বলে ডাকতে পারিনা। হাত বুলিয়ে তোমার মাথার কাটা জায়গাটা ছুঁতে পারিনা। আমার এই আকুলতা, আমার বুকের ভিতরের কান্নার শব্দ কি শুনতে পাও? তুমিও তো বাবা হয়েছো, তুমিও তোমার ছেলেকে খাইয়ে দাও, ঘুম পাড়াও তখন কি তোমার আমার কথা মনে পড়ে? আমিও তোমাকে এমনি করেই বুকে আগলে রেখে বড় করেছি। অসুখ হলে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। তুমি দুষ্টুমি করলে তোমাকে শাসন করে আমিই কি কম ব্যথা পেয়েছি?
আজ তোমার জন্মদিন। অনেক অনেক দো'আ আদর তোমার জন্য। আর উপহার হিসেবে পাঠালাম তোমাকে নিয়ে আমার সামান্য স্মৃতিচারণ। এইতো সেদিনের কথা। ঢাকা CMH এর ৬ নম্বর কেবিনে শুয়ে তীব্র যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম মা হওয়া এত কষ্টের? কই এতদিন তো আমাকে কেউ বলেনি। মা, খালা, চাচী, ভাবী বোনরা। কেউ না। আচ্ছা আমার মা, আমার শ্বাশুরীও কি আমার মতই কষ্ট করেছেন? নাকি আমারই বেশি কষ্ট হচ্ছে? সেদিন ছিল বুধবার, ১লা মে ১৯৮৫। দুপুর ১টা। আমার জীবনের স্মরনীয় দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম। লেবার রুমেই ডাক্তার আমায় সুসংবাদটি দিয়েছিলেন। আপনার একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে। সাথে সাথেই মাথার উল্টো দিকের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ১টা ১৮ মিনিট। প্রথম "মা" হওয়ার অনুভূতি কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সন্তানের কথা শুনে সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা, ব্যথা নিমিষেই দূর হয়ে গেল। আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার পেয়ে মনটা দারুন এক প্রশান্তিতে ভরে গেল। সে এক অদ্ভুত ভাল লাগা। সাদা বিছানায় শুয়ে আছি। কেউ একজন বাচ্চাকে দেখালেন। নরম তুলতুলে ছোট্ট একটা পুতুল। মাথা ভর্তি কাল ঘন চুল। ছোট্ট নরম হাত, ছোট্ট ছোট্ট পা। গুল্লু গাল্লু একটা বেবী। গায়ের রংটাও ফর্সা। ভাগ্যিস আমার মতো হয়নি। অবাক নয়নে শুধু দেখছিলাম।
এটা আমার বাচ্চা ? আমি ওর "মা "? ও আমাকে "মা "বলে ডাকবে ? যেন বিশ্বাসই হচ্ছিলনা। বারবার শুধু ওকেই দেখতে ইচ্ছে করছিল। ততক্ষণে আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা, হৈচৈ আর হাসির শব্দে ৬ নম্বর কেবিন মুখরিত। কত পাউন্ড হয়েছে, কার মতো চেহারা, কার মতো চোখ, ঠোঁট টা কেমন? ইত্যাদি ইত্যাদি। রীতিমত গবেষণা।
ওর নামটা জন্মের অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। একটু শঙ্কায় ছিলাম ওর আব্বা রাজী হবেন তো। এই একটা জায়গায় উনি নমনীয় হলেন। ছেলের ডাক নাম রাখা হলো "আবীর "। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হলো। শুরু হলো আমার জীবনের নুতন আর এক অধ্যায়। ওর বয়সের দিন গুণি, মাস গুণি। সবকিছুই ভাল লাগে। ওর হাসি, ওর মুখের শব্দ, তাকানো। আবীরকে ঘিরেই তখন আমার সমস্ত পৃথিবী। মাস ঘুরে বছর। বেশ বড় করেই জন্মদিন পালন করা হলো। পরিবারের প্রথম সন্তান বলে কথা। প্রথম সন্তানকে নিয়ে বাবা মায়ের কত স্বপ্ন ,কত আশা। একটু একটু করে বেড়ে ওঠা। আধো আধো মুখে ওর কথা। কি মিষ্টি লাগতো। প্রথম কিছু অস্পষ্ট শব্দ। কিছু শব্দ মিলে বাক্য। সেই বাক্যগুলো বার বার শুনতে ইচ্ছে করতো। কই একটি বারও তো বিরক্ত লাগেনি? চার বছর পুরো না হতেই স্কুলে ভর্তি করালাম। ওর প্রথম স্কুল "বান্দরবান শিশু বিতান কেজি স্কুল"। শুনেছি পরবর্তিতে স্কুলটির নাম বদল করা হয়েছে। মেজর সাহেবের চাকুরির সুবাদে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত আবীরকে কয়েকটা স্কুলে পড়তে হয়েছিল। যথাক্রমে ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল, দাউদ পাবলিক স্কুল, ঢাকার রাইফেল পাবলিক স্কুল এবং সেন্ট যোসেফ হাই স্কুল। এস এস সি পর্যন্ত সেন্ট যোসেফই।
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজেও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। ভাইবা দেয়ার আগেই আমাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ভর্তি করে দিতে হয়েছিল ওর পছন্দ সেন্ট যোসেফ হাই স্কুলে। খুব ছোট বয়স থেকেই ক্রিকেট খেলতে ভালবাসতো। তাই ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করাবার চিন্তা বাধ্য হয়েই মাথা থেকে সরিয়ে ফেলেছিলাম। বড় সন্তানকে চোখের আড়াল করতে চাইনি আমিও। ছাত্র হিসেবে বেশ মেধাবী ছিল। কিন্তু ওর পছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছিলাম। চাইলেই ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারী পড়াবার জন্য জোর করতে পারতাম। জোর করিনি। আমি চেয়েছিলাম আমার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় থেকে বিবিএ, এমবিএ করুক। বিবিএ, এমবিএ পাশ করে চাকুরি করার মতো যথেষ্ট মেধা আমার ছেলের ছিল। কিন্তু আমিও ওর মতো চেয়েছিলাম লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলুক।
একটু একটু করে আমিও স্বপ্ন দেখছিলাম আমার ছেলে একদিন লাল সবুজ জার্সি গায়ে দিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। এখনো জানিনা আমার সিদ্ধান্ত সেদিন ভুল ছিল কিনা। কিসের আশায় দশ বছরের আবীরকে নিয়ে সেদিন ছুটেছিলাম ঢাকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠ থেকে শুরু করে বিকেএসপির মাঠ পর্যন্ত। দুপুরের ভাত খেয়ে সবাই যখন বিশ্রাম নেয় কিংবা কোচিং এ দৌড়ায় আমি তখন আবাহনী মাঠের বেঞ্চিতে বসে নেটে ছেলের ব্যাটিং প্রাকটিস দেখে মুগ্ধ হই। আমাকে কি এক নেশায় পেয়ে বসেছিল। ঈদে নুতন কাপড় না কিনে কিনতাম ব্যাট, বল, প্যাড, গ্লাভস। ওরাও খুশী হয়ে যেত। পড়ালেখা এবং ক্রিকেট সমানতালে চালিয়ে নিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল আবীরের সাথে আমাকেও। তখনতো জানতাম না এই ক্রিকেটকেই একদিন পেশা হিসেবে বেছে নেবে। শয়নে, স্বপনে, ঘুমে, জাগরণে তখন শধুই ক্রিকেট। অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলে খেলে স্বপ্ন পুরণের স্তর গুলো একটু একটু করে অতিক্রম করছিল।
প্রথম বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৫ দলে চান্স পাওয়ার আগে আমার ছেলের কি টেনশন। কি উত্তেজনা। আম্মা আমি চান্স পাবো তো? ছেলে কে শান্ত করবার জন্য নিজেই মনে মনে নির্বাচক হয়ে ভাবতে থাকি, ১৫ জনের দলে স্পেসালিস্ট ব্যাটসম্যান, পেসার, স্পিনার, অলরাউন্ডার, বাঁহাতি ডানহাতির কম্বিনেশন, কিপার এই সমীকরণ করলে আবীর তো দলে থাকার কথা। ছেলের মাথায় পরম মমতায় হাত রেখে বলি, তুমি দলে থাকবে ইনশাআল্লাহ। সহজ সরল ছেলে আমার খুশি হয়ে বলে, সত্যি আম্মা ? আমিও মাথা নেড়ে বলি, সত্যি।
বড় সন্তানের সাথে মায়ের বয়সের ব্যবধান থাকে সবচাইতে কম। সম্পর্কটা হয় বন্ধুর। সব কিছু শেয়ার করতাম। এস এস সি পরীক্ষা, নটরডেম কলেজে ভর্তি, এইচ এস সি পাশ করবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ ভর্তি সব কঠিন সময়ে সাহস যুগিয়েছি। উৎসাহ দিয়েছি। ২০০৫ সালে জাতীয় দলে খেলা, পরের বছরেই টেস্ট দলে খেলা। ২০০৭ সালে, ২০১১ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট এ অংশগ্রহণ সব ছবির মতো ভাসছে। মা হিসেবে আমি কতটুকু করতে পেরেছি জানিনা। আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। দেখতে দেখতে কেমন করে এতগুলো বছর চলে গেলো? আজ আবীরের ৩৩ বছর পূর্ণ হলো। ও এক পুত্র সন্তানের জনক। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানাচ্ছি। আজ প্রাণ ভরে দো'আ করছি। তুমি দীর্ঘায়ু হও। তুমি সুখে থাকো, শান্তিতে থাকো। নির্ভাবনায় থাকো। তোমার সন্তানকে নিয়েও সমস্ত আশা আকাংখা পূর্ন হোক।
আম্মু। এরিযোনা থেকে। ০১/০৫/২০১৮।
জাতীয় দলের হয়ে নাফীস এখন পর্যন্ত ২৪টি টেস্ট, ৭৫টি ওয়ানডে ও একটি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। যেখানে সব মিলিয়ে ৫টি সেঞ্চুরি সহ মোট সাড়ে তিন হাজারের মতো রান করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, ০১ মে, ২০১৮
এমএমএস