আমাদের দেশের ডাক্তারি পরিভাষায় 'স্পোর্টস মেডিসিন' শব্দের সঙ্গে হতো অনেক ক্রীড়াবিদের পরিচয় নেই। যদি থেকেও থাকে তাহলে হয়তো ধারণা নেই এই বিষয়টি নিয়ে কারা বা 'কে' কাজ করে।
গুটিকয়েক ক্রীড়াবিদের হয়তো জানা আছে এই বিষয়টি নিয়ে। এই স্পোর্টস মেডিসিনের ধারণা সর্বপ্রথম আসে ১৯২২ সালে। সুইজারল্যান্ডে গঠিত স্পোর্টস মেডিসিন সোসাইটি। এরপর তাদের পথে হাঁটে জার্মানি (১৯২৪), ফ্রান্স (১৯২৯) ও ইতালিতে (১৯২৯)।
১৯৫৮ সালে স্পোর্টস মেডিসিনটা বিশেষ গুরুত্বের সাথে ইতালিতে বিবেচনা করা হয়। 'ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অব মেডিকেল স্পেশালিস্ট' স্পোর্টস মেডিসিনের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেন। পরবর্তীতে 'ইউরোপিয়ান ফেডারেশন অব স্পোর্টস মেডিসিন অ্যাসোসিয়েশন' গঠনের মাধম্যে স্পোর্টস মেডিসিনের একটা লক্ষ্য ঠিক করা হয়।
স্পোর্টস মেডিসিন বর্তমান আধুনিক বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে 'স্পোর্টস এন্ড এক্সারসাইজ মেডিসিন' (এসইএম) নামে। সারা বিশ্বের ৩০টির মতো দেশে চিকিৎসাখাত হিসেবে বিশেষ ভাবে এসইএম চালু রয়েছে।
বিশ্বে এই স্পোর্টস এন্ড এক্সারসাইজ মেডিসিন প্রসারিত হলেও বাংলাদেশে এর প্রসার এখনো ঠিক মতো হয়নি। তবে ঠিক মতো বললেও ভুল হবে বাংলাদেশে এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করার মতো কেউই নেই। দেশের একমাত্র স্পোর্টস এন্ড এক্সারসাইজ মেডিসিন স্পেশালিস্ট হচ্ছেন ডাক্তার দেবাশীষ চৌধুরী। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ডাক্তারি পেশার এই বিশেষ দিক নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন বিসিবির এই প্রধান চিকিৎসক। এসইএম কিভাবে কাজ করে, দেশে কি জন্য এই পেশা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, কি কি বাধা রয়েছে সবই জানিয়েছেন তিনি।
এসইএম স্পেশালিস্ট ডাক্তাররা কিভাবে কাজ করে বা কী নিয়ে কাজ করে এই প্রসঙ্গে দেবাশীষ চৌধুরী বলেন, 'স্পোর্টস মেডিসিনের কাজটা হচ্ছে একজন স্পোর্টস পারসন নিয়ে। আসলে এটা কোনো ইনজুরির ব্যাপার না। স্পোর্টস মেডিসিন ডিল করে এক নম্বর হচ্ছে ইনজুরি, দুই নম্বর হচ্ছে ফিটনেস, তিন নম্বর হচ্ছে পুষ্টি, চার নম্বর ডোপিং। স্পোর্টস মেডিসিন যে শুধু প্রফেশনাল স্পোর্টস পারসনদের জন্য সেটা না। আমি, আপনি যে কারোও এই সমস্যা হতে পারে, আমি খেলাধুলা করি আমারও হতে পারে। এটা যেমন প্রফেশনাল স্পোর্টস পারসনদের জন্য দরকার তেমনি যারা বিনোদনের জন্য খেলাধুলা করে তাদের জন্যও দরকার। এজন্য এটাকে এখন নাম দেওয়া হয়েছে স্পোর্টস এন্ড এক্সারসাইজ মেডিসিন। এখানে স্পোর্টস সংক্রান্ত যত সমস্যা হয় সবকিছু নিয়েই ডিল করে। '
আমাদের দেশে কিভাবে এই চিকিৎসা করানো হয় বা সারা বিশ্বে কিভাবে এর চিকিৎসা করে সেই প্রসঙ্গে অভিজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, 'আমাদের বাংলাদেশের স্পোর্টস ইনজুরির ট্রিটমেন্ট সবসময়ই অর্থোপেডিক্সিয়ানরা করছে। সারা পৃথিবীতে একটা সময় ছিল যে অর্থোপেডিক্স ডাক্তাররা স্পোর্টস ইনজুরি দেখতো। কিন্তু আস্তে আস্তে গত ২০-২৫ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে যে আসলে এটা অর্থোপেডিক্স ডাক্তারদের বিষয় না, এটা একটা আলাদা বিষয়। এজন্য বিশ-পঁচিশ বছর আগে থেকে সারা পৃথিবীতে স্পোর্টস মেডিসিনে পোস্ট গ্রাজুয়েশন লেখাপড়া শুরু হয়। '
আমাদের দেশের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করলে স্পোর্টস এন্ড এক্সারসাইজ মেডিসিন এখনো কোনো প্রতিষ্ঠিত রূপ নিতে পারেনি। কারণ এমবিবিএস শেষ করে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে হলে দেশের বাইরে থেকে অনেক টাকা খরচ করে পড়তে হবে। তাই দেশে চাকরির কোনো ক্ষেত্র না থাকলে কেউই এই বিষয়ে পড়ার আগ্রহ পাবে না।
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে প্রথম কথা হচ্ছে একজন স্পোর্টস মেডিসিন স্পেশালিস্ট কোথায় চাকরি করবে। তার তো চাকরি লাগবে, বাংলাদেশে তো কোনো চাকরি নেই স্পোর্টস মেডিসিনে। একটা মানুষ যে পড়তে যাবে বিদেশে, পড়ে দেশে কোথায় জয়েন করবে। আমি যখন পড়ে বাংলাদেশে এসেছি ২০০০ সালে, তখন কিন্তু বাংলাদেশে কোথাও চাকরি ছিল না স্পোর্টস পারসনের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি নিয়েছিলাম তবুও সেটা পার্মানেন্ট চাকরি ছিল না। আগে তো সরকারকে চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে ফুলটাইম চাকরি করার কোনো সুযোগ নেই। '
দেশের এই অভিজ্ঞ চিকিৎসক মনে করেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে পেশাদারিত্ব না আসলে স্পোর্টস এন্ড এক্সারসাইজ মেডিসিন কখনো সামনে এগোবে না, দাড়াতে পারবে না। দেশের ৫৩টা ফেডারেশনের মধ্যে কোনো ফেডারেশনই ক্রীড়াবিদদের জন্য উন্নত চিকিৎসার কথা চিন্তা করে না। যার ফলে বিশ্ব ক্রীড়া মঞ্চে বাংলাদেশের বলার মতো কনো সাফল্য নেই। পেশাদারিত্বের অভাবেই দেশে এই স্পোর্টস এন্ড এক্সারসাইজ মেডিসিন পেশাটার কোনো অগ্রগতি নেই।
দেশের এই অভিজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, 'দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব না আসলে ডাক্তারদের এই পেশা কখনো উন্নত হবে না। যেমন ক্রিকেটে কিছুটা পেশাদারিত্ব আছে বলে ওরা বুঝতে পেরেছে যে, হ্যাঁ এখানে একজন ডাক্তার লাগবে, এখানে একজন ফিজিও লাগবে, এখানে ট্রেনার লাগবে। কিন্তু অন্যান্য ফেডারেশনগুলো তো এখনো প্রফেশনাল হয়নি। ওরা বুঝতে পারে না যে এখানে কোনো ডাক্তার লাগবে। কোনো ফেডারেশনই কিন্তু পার্মানেন্ট ডাক্তার নেই। দরকার হলে মাঝে মাঝে পার্টটাইম ফিজিও নেয়। ফুটবল হকি দুই-একটা ফেডারেশন এমনটি করে। আমাদের বাংলাদেশে এতোগুলো ফেডারেশন আছে, অথচ কারও এগুলো নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নাই। তাহলে আগে ওদের তো শিক্ষিত হতে হবে, প্রফেশনাল হতে হবে। '
তবে ধীরে ধীরে এসইএম নিয়ে মনোভাবে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসছে। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই সরকার চাইলে এই পেশার প্রতি দৃষ্টি দিতে পারে। দেশে স্পোর্টস এন্ড এক্সারসাইজ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের জন্য চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।
তিনি বলেন, 'এখন আস্তে আস্তে এটা পরিবর্তন হয়েছে। বিকেএসপিতে একটা পোস্ট তৈরি হয়েছে। ওখানে ডাক্তার চাকরি করে। ক্রিকেট বোর্ডের দুইজন চাকরি করেন। এখন আমি করি আমার সঙ্গে আর একজন চাকরি করে। সারা বাংলাদেশে মাত্র তিনজন ডাক্তার ফুলটাইম প্রফেশনালি কাজ করে। কিন্তু এখানে ফুলটাইম কেউ কাজ করে না। কাজেই উৎসাহ দিতে গেলে আগে চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, না হলে মানুষ উৎসাহ পাবে কেন। '
দেশে ভালো অ্যাথলেট তৈরি করতে হলে স্পোর্টস এন্ড এক্সারসাইজ স্পেশালিস্ট ডাক্তার প্রয়োজন এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই উৎসাহ পেলে দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এমটাই মনে করেন দেশের সেরা এই স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২০
আরএআর/এমএমএস