বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন সবে হাঁটতে শুরু করেছে, সেসময় চট্টগ্রামের এক তরুণ ক্রিকেটার দলে এলেন। ছোটখাটো গড়নের এই ক্রিকেটার এসেই ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিলেন।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতীয় স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলার জন্য তাদের তারকা ব্যাটসম্যানকে টানা প্রতি বছরই অনুরোধ জানাতে থাকেন। দলের স্বার্থে তিনি থেকেও যান।
স্কুল প্রাঙ্গণে ব্যাটিং করার সময় প্রায়ই কোনো না কোনো জানালার কাঁচ ভাঙতেন তিনি। কেউ কিছু মনে করত না, কারণ ব্যাটসম্যানটির নাম যে আফতাব আহমেদ, চট্টগ্রামের উঠতি তারকা।
২০০২ সালে আফতাবের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। এরপর খেলেন দুটি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। ১৯ বছর বয়স হওয়ার আগেই সিনিয়র পর্যায়ে খেলতে শুরু করেন তিনি। ২০০৪ সাল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা শুরু করেন। জাতীয় দলের হয়ে নিয়মিত খেলে ২০১০ সালে অবসর নেন।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তার দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সমালোচনা সইতে হয়েছে। তবে হার মানার ছেলে ছিলেন না এই তরুণ। ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ঢুকলেও তার স্লো মিডিয়াম পেস প্রায়ই কার্যকর সাব্যস্ত হতো।
নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের মাত্র তৃতীয় ম্যাচেই বল হাতে নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সফরকারী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৪৬ রানের মামুলি সংগ্রহ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলের জন্য এই রান করা খুবই সহজ কাজ। ১ উইকেট হারিয়ে ৭৬ রানও তুলে ফেলেছিল তারা। কিন্তু বল হাতে চমক নিয়ে হাজির আফতাব। গ্যালারীভর্তি নিশ্চুপ দর্শকদের হুট করেই জাগিয়ে তুলে একাই পাঁচ উইকেট তুলে নিলেন তিনি। বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে বোলার হিসেবে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি এটি। ১৩৩ রান তুলতেই ৭ উইকেট নেই কিউইদের! এরপর থেকে প্রায় প্রতি ম্যাচেই ১০ ওভার বল করতেন তিনি।
আফতাবের ব্যাটিং ছিল উদযাপনের মতো। তার আগ্রাসী ব্যাটিং বাংলাদেশের দর্শকদের চোখের শান্তির কারণ হয়েছিল। তার আগ্রাসী স্ট্রোকে অনেক বড় বড় বোলারদের নাকের জল-চোখের জল এক হয়ে যেত। সাধারণত ফ্রন্ট ফুটে ভর করে শট খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। তবে ব্যাক ফুটেও সমান ব্যালেন্স ধরে রাখতে পারতেন। হুক, পুল, ড্রাইভ, কাট এবং লফট-তার স্ট্রোকের ভাণ্ডার ছিল অনেক সমৃদ্ধ। সত্যি বলতে কি, তার ব্যাটিং ছিল সত্যিকারের বিনোদন।
আফতাব অবস্থা বুঝে নিজের ব্যাটিংয়ে পরিবর্তন আনতে পারতেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরের ক্রিকেটে তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়ে বাংলাদেশকে কয়েকটি ঐতিহাসিক জয় এনে দিয়েছিলেন। তার ব্যাটিং ছিল সাহস আর আত্মবিশ্বাসের দুর্দান্ত মিশেল। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা তিন ফিল্ডারদের একজন তিনি। ২০০৪ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৫০টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার স্ট্রাইক রেট ছিল সেরা তিনের মধ্যে।
তার প্রথম ফিফটি আসে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের ম্যাচে। একমাস পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের অলিখিত ফাইনাল ম্যাচে তিনি আর মোহাম্মদ রফিকের দারুন পারফরম্যান্সে জয় পায় বাংলাদেশ। যেই ইংল্যান্ডে সব ব্যাটসম্যানই ভুগতে থাকে, সেই ইংলিশদের মাঠেই টেস্ট ম্যাচে বলপ্রতি রান তুলে ৮২ রানের ইনিংস খেলেন। দুই সপ্তাহ পর, এক ছক্কা আর এক সিঙ্গেল নিয়ে কার্ডিফে অজিদের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক জয়সূচক রান আসে তার ব্যাট থেকেই।
কিন্তু এমন অসাধারণ এক ক্যারিয়ারের শেষটা হয় বেশ দুঃখের। ভারতের নিষিদ্ধ টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) যোগ দিয়ে বিসিবি কর্তৃক দশ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞার শিকার হন আফতাব। তবে এক বছর পরেই তিনি আইসিএল ত্যাগ করেন। এরপর জাতীয় দলে ফেরার পথ তৈরি হলেও তার আত্মবিশ্বাস ততদিনে শেষ হওয়ার পথে। সর্বশেষ ২০১০ সালে তাকে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দেখা যায়। ২০১১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলেও যখন সুযোগ হয়নি তিনি বুঝে যান তার সময়ে এসে গেছে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টেনে দেন।
মাত্র ২৯ বছর বয়সে সম্ভাব্য দারুণ একটা ক্যারিয়ারের ইতি টানেন আফতাব। আজ এই অপূর্ণ প্রতিভার ৩৫তম জন্মদিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২০
এমএইচএম