ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘করোনা নাই, তাই মাস্ক পরি না’

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৬ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২৪
‘করোনা নাই, তাই মাস্ক পরি না’ ...

চট্টগ্রাম: ‘মাস্ক পরি না, আমার গরম লাগে, এখন করোনা নাই’-বলছিলেন টেরিবাজারের একজন দোকানদার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে প্রতিদিন শতাধিক ক্রেতার মুখোমুখি হতে হয় তাকে।

তার মতো অনেকের ধারণা, শুধু করোনার জন্যই এসেছে মাস্ক!

আবার যাদের প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতায় মাস্ক পরতে হচ্ছে, তারাও কখনও থুতনিতে আটকে রেখে, টেবিলের পাশে ঝুলিয়ে রেখে কিংবা পকেটে পুরে দায় সারছেন।  

এভাবেই করোনাসহ নানান রোগের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের চলাফেরা সর্বত্র।

পথচারী, মুদি দোকানদার, হোটেল-রেস্টুরেন্ট কর্মচারী, গণপরিবহনের চালক, সহকারী ও সুপারভাইজারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অসচেতনতার কারণে রোগাক্রান্ত হচ্ছে, রোগ ছড়াচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কাশির চেয়ে হাঁচি সজোরে বের হয়। হাঁচির বেগ ঘণ্টায় নব্বই থেকে একশ মাইল হয়, কাশি ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫০ মাইল বেগে ছুটে। একবার কাশি দিলে তিন থেকে পাঁচ হাজার ড্রপলেটস (যা বাতাসের উপাদান এবং জলীয়বাষ্প দিয়ে গঠিত) বের হয়ে আসে। আর একবার হাঁচি দিলে যে বাতাস বের হয়, তাতে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ বেশি ড্রপলেটস থাকতে পারে। মাস্ক পরলে জীবাণু বহনকারী ড্রপলেটস থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়।  

চিকিৎসকরাও বলছেন, ধুলা-বালির মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। বায়ুবাহিত এসব রোগের মধ্যে সর্দি জ্বর, হাম, বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হাঁপানি ও ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগ অন্যতম। এ ধরনের রোগে আক্রান্তদের কফ, থুথু, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে জীবাণু ছড়ায়। যক্ষ্মা রোগের জীবাণুও একইভাবে ছড়ায়। সুস্থ কেউ এসব রোগীর আশেপাশে থাকলে শ্বাস নেওয়ার সময় বাতাসের সঙ্গে ওই রোগের জীবাণু সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। তবে সঠিক নিয়মে মাস্ক পরলে এসব জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

হাজারী লেইনে করোনাকালে মাস্ক বিক্রি হয়েছে প্রচুর। এখানকার ওষুধ ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার শুরুতে মাস্ক বিক্রি যতটা ছিল তা চার ভাগের একভাগে নেমে এসেছে। মানুষ এখন আর মাস্ক পরে না, তাই কেউ কিনে না। বিক্রিও তেমন হয় না। পাশাপাশি কমে গেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ করোনা সুরক্ষা সরঞ্জামাদির বেচাকেনা।

গত দেড় বছর পথের ধারে মাস্ক বিক্রি করেছেন মো. সাহাবউদ্দীন। ঠাট্টার সুরে বললেন, ‘করোনা শেষ তাই মাস্কের ব্যবহারও শেষ’। আগে ৪-৫ হাজার টাকার সামগ্রী বিক্রি হলেও এখন এক হাজারও হয় না। অনেকে বাধ্য হয়ে মাস্ক পরে। অফিসে ঢোকার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা থাকলে মাস্ক ব্যবহার করে। কেউ সামাজিকতা রক্ষা করতে মাস্ক পরে। সচেতনতার জন্য মাস্ক পরে না। পুরুষের তুলনায় মহিলারাই এখন বেশি মাস্ক কিনে এবং ব্যবহার করে।

ডিসি হিল এলাকায় আড্ডারত কয়েকজন স্কুল শিক্ষার্থী জানালো, করোনার সময় মাস্ক ছাড়া বের হলে পুলিশ-আর্মি ধরতো। এখন কেউ ধরে না। মাস্কের চাইতে টিস্যু ব্যবহার করা সহজ!

যারা ভাবছেন, করোনা নাই- তাদের ধারণা ভুল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৯ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, গত ২৪ ঘন্টায় ১১ জনের করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব সনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামে সর্বশেষ অন্তত ১০ জন রোগী পাওয়া গেছে। ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ। মহানগর ও বিভিন্ন উপজেলায় মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৩৭১ জনের।  

দেশে করোনার সংক্রমণের পর থেকেই সরকারি ও বেসরকারিভাবে মাস্ক পরার বিষয়ে নানা সচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংক্রমণ কমে আসায় এসব উদ্যোগে ভাটা পড়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট স্বীকার করেছে, কোথাও স্বাস্থ্যবিধি নাই। শহর কিংবা গ্রামে কেউ মাস্ক পরছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দেশিত ১৫ দফার মধ্যে রেস্টুরেন্ট, গণপরিবহনের জন্য যেসব নির্দেশনা ছিল সেগুলোর বালাই নেই।

করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মাস্ক পরার অভ্যাস নিয়ে দেশে গবেষণাও হয়েছে। গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া অধ্যাপক আহমেদ মুশফিক মোবারক জানান, ২০২০ সালে জরিপ করে এপ্রিলে জানতে পারি, ৯৫ শতাংশ মানুষ বলছে- তারা মাস্ক ব্যবহার করছে। এই তথ্য যাচাইয়ের পর মাস্ক ব্যবহারের হার নেমে আসে ৮০ শতাংশে। এরপর দেশের গ্রাম, বাজার ও রাস্তার ১ হাজার ৮০০ স্থানে পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ৩০ শতাংশের মতো মানুষ মাস্ক ব্যবহার করে।  নিবিড় পর্যবেক্ষণ কৌশল ব্যবহার করে নিশ্চিত হওয়া যায়, আসলে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহারের হার মাত্র ১২ থেকে ১৩ শতাংশের মতো।

করোনা সংক্রমণের আগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরি করতো। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য কাপড়ের মাস্কও তৈরি করতো কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, প্রাণ-আরএফএল, জেএমআই, মিনিস্টারের মতো বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। গেটওয়েল দৈনিক ১৫ হাজার মাস্ক তৈরি করতো। মিনিস্টার গ্রুপ ‘সেইফ লাইফ’ নামে আগে দৈনিক ৫০ হাজার পিস মাস্ক উৎপাদন করতো। প্রায় এক দশক ধরে ফেস মাস্ক উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড সার্জিক্যাল ফেস মাস্কের পাশাপাশি কেএন-৯৫ মাস্ক উৎপাদন করে। এখন তারা কোনমতে উৎপাদন টিকিয়ে রেখেছে। চাহিদা আছে শুধু চিকিৎসাকেন্দ্রে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গাইনোকোলজিস্ট ডা. সোমা চৌধুরী বলেন, যে কোনো রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে হলে মাস্ক সঠিক নিয়মে পরা জরুরি। মাস্ক দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে। থুতনিতে নামিয়ে রাখলে সংক্রমণ ঠেকানো যায় না। এছাড়া ব্যবহার করা মাস্ক হাতে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পকেটেও রাখা যাবে না। ব্যবহার করা মাস্ক স্পর্শ করলে কিংবা একবার পকেটে আবার মুখে রাখলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মাস্ক পরতে হবে না- এমন কোনো নির্দেশনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আসেনি। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বিষয়টি দেখবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২৪
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।