ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩২, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চাহিদা আছে মানব কঙ্কালের 

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২৫
চাহিদা আছে মানব কঙ্কালের  ...

চট্টগ্রাম: লোহাগাড়ার পদুয়া তেওয়ারীখিল এলাকায় গত ২৩ মার্চ দুপুরে কবরের মাটি খোঁড়া অবস্থায় দেখতে পান স্থানীয়রা। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া তাহেরা বেগমের (৫৫) মরদেহ সেই কবর থেকে চুরির চেষ্টা করেছিল চোর চক্র।

শেরপুর থেকে ঢাকাগামী বাসে ২০ এপ্রিল তল্লাশি চালিয়ে ট্রাভেল ব্যাগে পাওয়া যায় তিনটি মাথার খুলি, মানবদেহের বড় হাড় ২৮টি, বিভিন্ন অংশের হাড়ের ৫০টি টুকরা ও একটি মেরুদণ্ডের হাড়। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা এ সময় পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।

মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ এর ১০ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মানব কঙ্কাল কেনা-বেচা অবৈধ। গত বছরের ৩০ এপ্রিল কবরস্থান থেকে মরদেহ ও কঙ্কাল চুরির বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এবং সর্বজনীন মরদেহ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করার নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।  

মেডিক্যাল কলেজে ১ম ও ২য় বর্ষে অ্যানাটমি বিষয়ে পড়াশোনায় মানব কঙ্কাল ব্যবহার করতে হয় বাধ্যতামূলক। নার্সিং এবং হোমিওপ্যাথি কলেজের শিক্ষার্থীদেরও প্রয়োজন হয় কঙ্কাল। এই চাহিদা পূরণ করে কঙ্কাল চোর চক্র। চক্রের সদস্যরা কবর থেকে মরদেহ তুলে রাসায়নিক দিয়ে কঙ্কাল তৈরি করে। পরে কয়েক হাত ঘুরে আসে শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের হাতে।  

চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি ৯টি মেডিক্যাল কলেজে প্রতিবছর ভর্তি হন ৯ শতাধিক শিক্ষার্থী। তারা কঙ্কাল সংগ্রহ করেন সিনিয়র শিক্ষার্থী, মেডিক্যাল কলেজের ৩য়-৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী, ‘বাংলাদেশ বোনস মার্কেট উইথ ইক্যুইপমেন্টস’, ‘স্কেলেটন ফর মেডিক্যাল স্টুডেন্টস’ সহ নানান নামের ফেসবুক গ্রুপ থেকে।  

নগরের আন্দরকিল্লায় বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়াম মেডিক্যাল বুক সেন্টার ও জেনুইন লাইব্রেরিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা সরাসরি মানব কঙ্কাল বিক্রি করেন না। তবে চাহিদা থাকলে ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়।

সেই সূত্র ধরে পাওয়া যায় এক বিক্রেতার সন্ধান। তিনি বাংলানিউজকে জানান, দুই ধরনের কঙ্কাল বিক্রি করা হয় শিক্ষার্থীদের কাছে। ২০৬টি অস্থির পুরো সেট সাদা কঙ্কাল ২৯ হাজার এবং লাল কঙ্কাল ৩০ হাজার টাকায় পাওয়া যাবে। লাল-পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির কঙ্কাল হওয়ায় সেটির চাহিদা বেশি।

ইউএসটিসি’র আইএএইচএস, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজ, সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজ, মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ ও চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া বেশ ক’জন এমবিবিএস শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাওয়া হয়- মানব কঙ্কাল সংগ্রহের উৎস সম্পর্কে। তারা প্রায় অভিন্ন সুরে বলেছেন, সিনিয়রদের কাছ থেকে এবং ক্যাম্পাসের দেয়ালে সাঁটানো বিজ্ঞাপন দেখে অ্যানাটমি বিভাগের কর্মচারীদের কাছ থেকে কঙ্কাল কিনেছেন। পুরনো কঙ্কাল ১০-১৫ হাজার, নতুন কঙ্কাল ২০-২২ হাজারের মধ্যে কেনা যায়।

সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের সাবেক এক শিক্ষক জানান, কঙ্কাল বেচাকেনায় সরকারি কোনও বিধি-নিষেধ না থাকায় শিক্ষার্থীরা যে যেভাবে পারে কঙ্কাল সংগ্রহ করে। নিয়মানুযায়ী মৃত্যুর আগে কেউ দেহ দান করলে মর্গে প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে কঙ্কাল বের করা হয়। এছাড়া হাসপাতালে আসা বেওয়ারিশ মরদেহের কোনও ওয়ারিশ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পাওয়া না গেলে ছবি তুলে রেখে তা ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হয়।

সার্জারি বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক ডা. সুরেশ কুমার তুলসান বলেন, ‘আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন এক সেট মানব কঙ্কালের দাম ছিল মাত্র কয়েকশ’ টাকা। মানব কঙ্কাল বেচাকেনার বৈধ নীতিমালার অভাব, মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দাম এখন আকাশছোঁয়া’।

তিনি বলেন, চিকিৎসা শিক্ষাসহ অন্যান্য যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা গবেষণাগারে মানব কঙ্কাল সংরক্ষিত আছে কিংবা ব্যবহৃত হচ্ছে সেসব কঙ্কালের উৎস সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই। কার কাছ থেকে কেনা হয়েছে, নেই তার রশিদও। এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত।

হিউম্যান অ্যানাটমির শিক্ষক ডা. সঞ্জয় কুমার বলেন, দেশে আমদানি করা আর্টিফিশিয়াল কঙ্কাল মানব কঙ্কালের মডেল হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। এগুলোর গঠন, আকৃতি ও ওজন বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানব কঙ্কালে যেখানে একটা গর্ত আছে, তার পাশে একটা নার্ভ চলে গেছে, একটা গ্রুপ আছে। কিন্তু আর্টিফিশিয়ালে বিষয়টা দেখা যায় না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিক্যাল শিক্ষা বিষয়ক এক কর্মকর্তা জানান, মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কঙ্কাল ব্যবহার-সরবরাহ পদ্ধতি নিয়ে নীতিমালা তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সিমুলেশন ল্যাব তৈরি বিষয়ক দুটি প্রস্তাব নিয়ে কাজ চলছে। এই ল্যাবে কৃত্রিম মরদেহ থাকে, যেটা ডি-সেকশন বা আলাদা করলে মানুষের দেহে যে ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে ঠিক সে ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই থাকবে। ল্যাবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মরদেহ কাটা-ছেঁড়া সহ নানান অভিজ্ঞতা নিতে পারবে।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) নতুন অ্যাকাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ১ হাজার বর্গফুট জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে প্রফেসর ডা. মনসুর খলিল স্মৃতি বোনস লাইব্রেরি। ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এটি উদ্বোধন হয়। মানবদেহের ১৫টি কঙ্কাল রয়েছে এখানে। এর মধ্যে ৬টি এসেছে অ্যানাটমি বিভাগ থেকে, ৭টি পাওয়া গেছে অনুদান হিসেবে এবং ছাত্রসংসদ থেকে দেওয়া হয়েছে ২ সেট। দেয়ালজুড়ে থাকা স্টিল ও কাঠের ফ্রেমেও আছে কিছু হাড়। একটি বাক্সের মধ্যে আছে মানবদেহের পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল। অ্যানাটমির বই আছে প্রায় দেড় শতাধিক।

চমেক এমবিবিএস ১ম ও ২য় বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বাইরে থেকে এক সেট কঙ্কাল কিনতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। বোনস লাইব্রেরি হওয়ার পর পড়ালেখার সুযোগ বেড়েছে। আইটেম (নির্দিষ্ট বিষয়ের পরীক্ষা) দেওয়ার আগে এখান থেকে নির্দিষ্ট হাড় বাসায় নিয়ে পড়ারও ব্যবস্থা আছে।  

জানা গেছে, ২০১১ সালে ২৩টি বেওয়ারিশ মরদেহ পায় চমেক অ্যানাটমি বিভাগ। ২০১৮ সালে মরদেহের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৭টি। গত ৬ বছরে এসেছে ২০-২৫টি। এর মধ্যে ২২টি অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজকে দেওয়া হয়েছে।  

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জসিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ভিসেরা (ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, লিভার, প্যানক্রিয়াস, অন্ত্র, কিডনি ইত্যাদি) প্রয়োজন হলে হাসপাতাল পরিচালকের কাছে আবেদন করা হয়। এরপর ফরেনসিক বিভাগ মর্গে থাকা বেওয়ারিশ মরদেহ সরবরাহ করে। এছাড়া কঙ্কাল নিয়ে পড়াশোনার জন্য বোনস লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের সহায়ক হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২৫
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।