চট্টগ্রাম: কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর একাত্তরে স্বজন হারানো শহীদ জায়া বেগম মুশতারি শফিকে লাল-সবুজের পতাকা জড়িয়ে সম্মাননা জানিয়েছে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগ। এসময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উঠলে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন মুশতারি শফি।
শুক্রবার বিকেলে নগরীর এনায়েত বাজারে মুশতারি শফির বাসভবনে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগের সংগঠকরা তাকে সম্মাননা জানান। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মানবতা বিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের সূচনালগ্নে সংগঠনটি এ কর্মসূচী পালন করেছে।
চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে নিয়ে বেগম মুশতারি শফিকে সম্মাননা জানানোর পাশাপাশি সংগঠনটি তাকে ফুল দিয়েও সংবর্ধিত করেছে। এরপর সমবেত সবাই মিষ্টি মুখ করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জায়া বেগম মুশতারি শফির স্বামী, ভাই ও ভগ্নিপতি নিহত হন। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনে প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি।
সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে শহীদ জায়া বেগম মুশতারি শফি বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের কারণেই ৪২ বছর পর হলেও একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ৩০ লাখ শহীদের আত্মা ও শহীদের পরিবার আজ শান্তি পেল। জীবদ্দশায় বিচারাধীন বাকি যুদ্ধাপরাধীদের সাজাও কার্যকর দেখে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন শহীদ জায়া। ’
সম্মাননার জবাবে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে শহীদ জায়া বেগম মুশতারি শফি বলেন, ‘একটা দীর্ঘশ্বাস যেন আজ বুক থেকে নেমে গেল। হয় না হয় না করেও ৪২ বছর পর অন্তত একজন রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর করা হল। যদি গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনে সোচ্চার না হত তবে হয়ত এটা সম্ভব হত না। ’
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালনের বিষয় উল্লেখ করে মুশতারী শফী বলেন, ‘এত অপরাধ করেও তারা ক্ষমতায় গেল। আমাদের সামনে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করল। ভাবতেই খারাপ লাগে আমরা তাদের অধীনে ছিলাম। ’
শহীদ জায়া বলেন, ‘বেঁচে থাকতে একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর দেখে যেতে পারলাম এটাই পরম পাওয়া। আশা করি সব রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর হবে। হয়ত আমি দেখে যেতে পারব না। তবু শহীদের আত্মার আজ মুক্তি পাওয়া শুরু হল। সব রাজাকারের ফাঁসি হলে সব শহীদের আত্মা মুক্তি পাবে। ’
শহীদ জায়া বলেন, ‘এ সম্মাননা শুধু আমার জন্য নয়। এটা ৩০ লক্ষ শহীদ ও স্বজন হারানোদের জন্য সম্মাননা। ’
অনুষ্ঠানে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগের আহ্বায়ক শরীফ চৌহান চট্টগ্রামের গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে ওঠার নেপথ্যের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারিত ছিল। সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হবে ধরে নিয়ে তরুণ উদ্যোগ জাতীয় পতাকা দিয়ে শহীদ জায়াকে সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ সাজা না দিয়ে যাবজ্জীবন দন্ড দেয়ায় আমরা হতাশ হয়। ’
তিনি শহীদ জায়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সেদিন আপনাকে সম্মাননা জানানোর জন্য তৈরি করা সেই পতাকা নিয়েই আমরা চট্টগ্রাম প্রেসকাব প্রাঙ্গনে জমায়েত হয়। শুরু হয় গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। আজ সেই পতাকা আমরা আজ আপনার হাতে তুলে দিলাম। ’
শরীফ চৌহান বলেন, ‘আপনারা আমাদের হাতে আন্দোলনের যে পতাকা তুলে দিয়েছেন সেই পতাকাকে আমরা সমুন্নত রাখব। সকল যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তরুণরা রাজপথে থেকে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে। ’
সম্মাননা অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ও উদীচীর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ডা. চন্দন দাশ, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগের উপদেষ্টা প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুনীল ধর, প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি ও সংস্কৃতিকর্মী রাশেদ হাসান, শিক্ষক সালমা জাহান মিলি, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগের চার যুগ্ম আহ্বায়ক শ্যামল ধর, এস এম ইউসুফ সোহেল, প্রীতম দাশ ও প্রিন্স রুবেল, তরুণ উদ্যোগের সদস্য অরুণ মল্লিক, সুব্রত বড়ুয়া পিন্টু, শৈবাল পাড়িয়াল এবং প্রবীর দাশ প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৬, ডিসেম্বর ১৩,২০১৩
আরডিজি/টিসি