ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জুন ২০২৪, ১৮ জিলহজ ১৪৪৫

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

নজরুলতীর্থ চুরুলিয়ার পথে

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৯ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৫
নজরুলতীর্থ চুরুলিয়ার পথে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: কাঁটাতারের বেড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে রাষ্ট্রের সীমানা। কিন্তু ভাষাকে ভাগ করতে পারেনি।

যেমন ভাগ করতে পারেনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধি দানকারী দুই অমর সাহিত্যিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামকে।

আমার এ চুরুলিয়া যাত্রার উদ্দেশ্যও তাই- কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্বন্ধে যা জানি তা নয়, তার অজানা অধ্যায়ের সন্ধান।
   
২৫ বৈশাখের আগে রবি ঠাকুরের হারিয়ে যাওয়া বাড়ির সন্ধানে কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। ভাবতে অবাক লাগে কলকাতায় কবি গুরুর কিছু বাড়ির ঠিকানা কর্পূরের মতো উধাও হয়ে গেছে। আর যেগুলোর খোঁজ পাওয়া গেছে বর্তমানে তার কোনোটা পুলিশের দপ্তর কিংবা হোটেল। যা আগের প্রতিবেদনে লিখেছিলাম।

আমার এবারের যাত্রা কবি নজরুলতীর্থ চুরুলিয়ায়। পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন দুখু মিয়াখ্যাত বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

এ যাত্রায় সহযোগিতা পেলাম কলকাতায় বাংলাদেশের উপ-হাই কমিশনের প্রেসসচিব মুফাকখরুল ইকবাল ও কবি নজরুলের দৌহিত্র সুবর্ণ কাজীর। দিক নির্দেশনা দিয়ে সুবর্ণ কাজী আর ইকবাল ভাইয়ের ভরসা, ‘সমস্যা হলে ফোন দিও’। আমার যাত্রাকালে ইকবাল ভাই ছিলেন আসামে আর সুবর্ণদা বাংলাদেশে।

কলকাতা থেকে আসানসোলগামী বাসে চড়ে বসলাম। ঘণ্টা পাঁচেকের পথ। কলকাতা থেকে প্রায় ২শ’ ১৫ কিলোমিটার দূরে অজয় নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত গ্রাম চুরুলিয়া। ভারতের কয়লা শিল্পের রাজধানী বলে খ্যাত আসানসোল থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ বাসে চড়ে আপনাকে আসতে হবে চুরুলিয়ায়।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এ যাত্রায় আবেগ বাদ দিয়ে আমি চেষ্টা করেছি বাস্তবতাকে পর্যবেক্ষণ করতে। আর এ পর্যবেক্ষণের প্রতিটি বাঁকে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল অবাক করা নানান সব ঘটনা। যা শুরুর হয়েছিল আসানসোলগামী বাসে আমার পাশের সিটের তরুণ যাত্রীকে দিয়ে। ছেলেটা ম্যানেজমেন্টের ছাত্র।
 
পেশায় সাংবাদিক জানার পর তিনি ধরেই নিলেন আমি আসানসোল যাচ্ছি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মিটিং কভার করতে (ওই দিনই মোদী-মমতা আসানসোল সফরে গিয়েছিলেন)।
তার কথার প্রতিউত্তরে বললাম, না, নজরুল ইসলামের বাড়ি দেখতে যাবো।
এবার শুরু অবাক হওয়ার পালা।
-ইনি কে?
-কাজী নজরুল ইসলাম।
ভাবলাম আমারই হয়তো ভুল। কবির পুরো নামটা বলা উচিত ছিল। কিন্তু না, ম্যানেজমেন্টের ছাত্রটি আবারও জানতে চাইলেন-
কাজী নজরুল ইসলাম? কে ইনি?
এতোটুকু বাড়িয়ে বলছি না। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হলো ভুল শুনছি নাতো? সামলে নিয়ে বললাম
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনেন?
-হ্যাঁ, চিনবো না কেন! ওনার বাড়ি শান্তি নিকেতনে। নজরুল ইসলাম কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়?
অবাক চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আছেন এক ভদ্রলোক। আপনি তাকে চিনবেন না ভাই। সত্যি কথা বলতে কী, এতোটাই হতাশ হয়েছিলাম যে, চেনানোর ইচ্ছাটুকুও আমার মধ্যে থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল।

ভাবলাম, এ ছেলেটি কাজী নজরুল ইসলামকে চিনবেই বা কেন! ম্যানেজমেন্ট পাঠক্রমে তো নজরুল ইসলামের কবিতা নেই। আর ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করলে তাকে জানার সুযোগও নেই। আর ঘরে ঘরে সাহিত্য চর্চার চলতো বলতে গেলে উঠেই যাচ্ছে। এ না জানার অক্ষমতায় কার দোষ - রাষ্ট্রের? সমাজের? পরিবারের? না সময়ের?

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতারা ভাষণে কথায় কথায় রবীন্দ্র-নজরুলের বুলি আওড়ান। কলকাতার উপকণ্ঠে একটা নজরুল তীর্থ বানিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু সেখানেই কি দায়িত্ব শেষ?

আসানসোলে এসে পরের চমক। কিভাবে যেতে হয়, আগেই বলে দিয়েছিলেন সুবর্ণ কাজী। কলকাতা মুফাকখরুল ইকবাল ভাইও ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন। তাও কিছুটা আগ্রহের খাতিরে বাসস্ট্যান্ডে প্রাইভেট কোচিং ফেরত চার ছাত্র, তিন দোকানদার ও দু’জন পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম। তারা সাবলীলভাবে জানালেন, তারা কবি নজরুল ইসলামের নাম শুনেছেন। কিন্তু বাড়ি কোথায়, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।

তবে বাসের কুলি ছেলেটি এর ব্যতিক্রম। সে কাজী নজরুল ইসলামের বাড়ি যাওয়ার পথ সম্বন্ধে একটা দিকনির্দেশনা দিয়ে দিলো। আসানসোল থেকে নজরুলের ভিটা ‘কাজী পাড়া’ যেতে বাসে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। বেহাল পথে বাসের প্রবল ঝাঁকুনি সহ্য করে অবশেষে আমরা নামলাম সেই গ্রামে, যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলাসাহিত্যের বিস্ময় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

বাসের বর্ণনা না দিলেই নয়। এটা ঠিক বাস নয়, মনে হচ্ছিল মালগাড়ি। যেভাবে মালগাড়িতে মালপত্র তোলা হয়, সেভাবেই মানুষের গাদাগাদি। এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষ সাঁওতাল এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের। তাদের আসানসোল যাতায়াতের একমাত্র পরিবহন এই বাস। ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের পথ মনে হচ্ছিল, একশ’ বিশ ঘণ্টা।

অবশেষে পৌঁছালাম চুরুলিয়ার কাজী পাড়ায়। চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রার গরমের মধ্যেই মন কাড়ল প্রাকৃতিক দৃশ্য। দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা মাঠ, খোলা আকাশ, খেজুর গাছ আর দূরের পাহাড়।

দুপুরে ধুলা ওঠা গ্রামের পথের ধারে এক নির্জন খোলা দোকানের ভেতরে ঝিমুতে থাকা দোকানির কাছে জানতে চাইলাম, নজরুলের ভিটা ঠিক কোনো দিকে। বিরক্ত দোকানির ইশারায় দেখিয়ে দেওয়া পথে কয়েক পা ফেলতেই দেখলাম, একটি ভাস্কর্যহীন বেদী। বেদীর গায়ে একটি বোর্ডে ঝোলানো কবি নজরুলের ভিটার পথনির্দেশক। বেদীতে কবির ভাস্কর্য স্থাপন করার পরিকল্পনা আছে, সেটা পরে জানা গেল।

অবশেষে গিয়ে দাঁড়ালাম ইতিহাসের মুখোমুখি। সাদামাটা দোতলা একটা বাড়ি। বাড়িটিতে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট। এ বাড়িতেই গড়ে উঠেছে নজরুল একাডেমি। এখানে আছে নজরুল মিউজিয়াম। পাশেই নজরুল বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়েই পড়াশুনা করেছিলেন নজরুল। তখন এটি ছিল মক্তব। আর আছে সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা নজরুল পাঠাগার।

একটু দূরে সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে নজরুল কলেজ। নজরুল একাডেমিতে প্রতিবছরই কবির জন্মদিনকে কেন্দ্র করে সপ্তাহব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়।

জানিয়ে রাখা ভালো, এখানে কোনো হোটেল বা থাকার ব্যবস্থা নেই। আর সন্ধ্যা ৬টা বাজতেই আসানসোল থেকে কলকাতার উদ্দেশে ছেড়ে যায় শেষ বাস। বাস ধরতে না পারলে আছে লোকাল ট্রেন। কিন্তু তাতে লাগবে দীর্ঘ সময়।

এ স্মৃতিতীর্থে কবির বাড়ি, মিউজিয়াম, পাঠাগার, প্রমীলা কাজীর সমাধি ক্ষেত্র -অনেক কিছুই দেখার আছে। আগামী প্রতিবেদনগুলোতে সেসব শোনানো যাবে। সঙ্গে থাকবে কাজী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটানো সময়ের গল্প। সে পর্যন্ত পাঠক আপনাকে অপেক্ষায় রাখলাম।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩২ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৫
আরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।