কলকাতা: আশির দশকের শেষ সময় কলকাতার পার্ক স্ট্রিট এলাকার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক-এর সামনে বাম শ্রমিক সংগঠনের তরফে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য পশ্চিমবঙ্গে কম্পিউটারকে প্রবেশ করতে না দেওয়া।
কিন্তু নব্বই-এর দশকের গোড়া থেকেই বদলে যেতে থাকে শহর কলকাতার চেহারা। কখনো যে কলকাতাকে বলা হয়েছে মিছিল নগরী সেই কলকাতা আজ বদলে গেছে অনেকটাই। সভ্যতার অপ্রতিরোধ্য গতিতে যে অঞ্চলটিতে এক সময় কম্পিউটার প্রবেশের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছিল সেই পার্ক স্ট্রিট এখন ওয়াই-ফাই জোন।
আশির দশক পেরিয়ে নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত যানজট ছিল কলকাতার অঙ্গ। দীর্ঘ যান বাহনের সারিতে অপেক্ষা করতে হত নিত্য যাত্রী থেকে রোগী নিয়ে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সকেও। শহরের মধ্যের পরিবহন আর শহরের বাইরে থেকে আসা মাল বোঝাই গাড়ির ভিড়ে হাঁসফাঁস করত কলকাতা। উড়াল পুল বলতে ব্রবোন রোডের উড়াল পুল সহ ছিল হাতে গোনা গুটিকতক উড়াল পুল। সময়ের সাথে সাথে বাড়ে শহরের রাস্তার পরিমাণ।
ভারতের মেট্রো শহর গুলির মধ্যে সবথেকে কম পরিমাণ রাস্তার শহর কলকাতার যান চলাচলকে সহজ করতে তৈরি হয়েছে একের পর এক উড়াল পুল। যেটা বদলে দিয়ে যান জট যুক্ত শহরের চেহারাটা। তৈরি হয়েছে যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত সিগন্যাল ব্যবস্থা। আর এর ফলে সাধারণ দিনে যানজটের সমস্যা খুব একটা চোখে পড়ে না।
শহরকে কেন্দ্র করে সীমান্ত বরাবর তৈরি হয়েছে ইস্টার্ন মেট্রো পলিটন বাইপাস। যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ গতিতে কলকাতার একদম দক্ষিণ থেকে খুব সহজেই চলে যাওয়া যায় বিমান বন্দরে। পাতাল রেল তো আছেই, সেখানে যুক্ত হচ্ছে বৃহত্তর কলকাতার অংশ।
কলকাতার এক সময়ের ঐতিহ্য দোতলা বাস আর নেই। কিন্তু এসেছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সরকারি এবং বেসরকারি বাস। বাড়িতে বসেই স্মার্ট ফোনের সাহায্যে চব্বিশ ঘণ্টা এখন দরজার সামনে ডেকে নেওয়া যায় ট্যক্সি। এসেছে উবের, ওলার মতো রেডিও ট্যাক্সি।
তবুও আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেঁচে আছে ট্রাম। আজও কলকাতার কিছু অঞ্চলে দেখা যায় হাতে টানা রিক্সা। প্রতিটি রাস্তায় এখন বসেছে পানীয় জলের কল তাই দেখা যায় না কলকাতার বাড়ি বাড়ি জল দিয়ে আসা ভিস্তিওয়ালাদের।
কলকাতায় হয়েছে বেশ কিছু পাঁচতারা হোটেল, রেস্তরাঁ তবে তার সঙ্গে সমান ভাবে পাল্লা দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণের চায়ের দোকানগুলি। আক্ষেপ আছে, আছে সম্ভাবনাও। একদিকে যেমন সন্ধেবেলায় রকে বসে পাড়া ছেলেদের আড্ডা প্রায় নেই। দৈবাৎ ছুটির দিন ঘণ্টা খানেকের রুটিন মেপে পাড়ার মোড়ে আসেন কেউকেউ। তবে সম্ভাবনার আলো জ্বলেছে সল্টলেকের তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্রে। সেখানে চাকরি করছেন কলকাতার লক্ষ লক্ষ তরুণ।
শিল্প ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ চিরকালই দুয়োরানী হয়ে থেকেছে। স্বাধীনতার পর লাইসেন্স রাজ, তারপর জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনে মুখ ফিরিয়ে ছিল শিল্পপতিরা। তবে ছবিটা বদলাচ্ছে। সিঙ্গুর থেকে টাটা গোষ্ঠীর বিদায়, শালবনি থেকে জিন্দাল গোষ্ঠীর কারখানা গোটানোর কালো দাগ মুছে পশ্চিমবঙ্গে আগ্রহ দেখাচ্ছেন দেশ বিদেশের শিল্পপতিরা।
কিন্তু রাজনীতির টানাপড়েনে শিল্প হোক বা পরিকাঠামোর উন্নয়ন বারেবারে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে কলকাতায়। রং বদল হয়েছে শহরের কিন্তু সত্যিকারের উন্নয়নমূলক প্রচেষ্টা হয়েছে কি? বহুদিন বাদে শহরে ফেরা মানুষদের চোখে অনেকটাই বদলে গেছে কলকাতা। কথাটা সত্যি কিন্তু এর জন্য কৃতিত্ব দাবি করা রাজনীতির কারবারিদের কতটা কৃতিত্ব আছে? এই প্রশ্ন উঠে আসবেই। কলকাতা বদলেছে ইতিহাসের নিয়মে রাজনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে নয়।
কলকাতাকে লন্ডন আর দার্জিলিংকে সুইজারল্যান্ড বানাবেন বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিত্নু পলিমাটির কলকাতা আর টেমসের তীরে লন্ডনের ভৌগলিক পার্থক্য আল্পস আর হিমালয়ের গঠনগত পার্থক্যের মতই স্পষ্ট।
যে কলকাতা এক সময় কম্পিউটারকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল,ভুল শুধরে সেই কলকাতায় আজ তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে শুধু দেশের নয় বিদেশের কোম্পানিগুলিও তাদের ব্যবসা শুরু করেছে। শুধু চাকরি নয় কলকাতার তরুণরা আজ ব্যবসামুখী। বেকারের সংখ্যা কমেছে অনেক আর তার জন্যই সত্তর আশির দশকের আড্ডায় ভরে থাকা পাড়ার মোড়গুলো আজ ফাঁকা।
ময়দানের ফুটবলে আজও মেতে ওঠে কলকাতা যেমন মেতে ওঠে আইপিএল ক্রিকেটে। ফাঁকা জায়গা কমেছে শহরে, কমেছে বনাঞ্চল, বেড়েছে আকাশচুম্বী অট্টালিকা ঠিক তেমন ভাবেই গোটা শহর ঘিরে সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন উদ্যান।
বেড়েছে কলকাতার পরিসরও। যুক্ত হয়েছে সল্টলেক, নিউটাউন, রাজারহাট অঞ্চল। কলকাতা বাড়বে তার সঙ্গে বাড়বে না তার সংস্কৃতির পরিসর। নন্দন, রবীন্দ্র সদন, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও বেশ কয়েকটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। কলকাতার পুরানো সিনেমা হলগুলির সাথে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু মাল্টিপ্লেক্স। নতুন করে সেজেছে গিরিশ ঘোষের অভিনয়ের স্মৃতি বিজড়িত স্টার থিয়েটার।
হাতিবাগান, গড়িয়াহাট , নিউ মার্কেটের সঙ্গে জুড়েছে বেশ কিছু শপিং মল। কিন্তু দরদাম করে কেনা ধর্মতলার ফুটপাতে ভিড় কমেনি একটুও। বদলায়নি কলকাতার বিপ্লবী চরিত্রও। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনে উত্তাল কলকাতা, নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া কম্যুনিস্ট পার্টির আঁতুড় ঘর কলকাতা আজ সামিল লড়াই প্রতিবাদে। তাই একদিকে যেমন কলকাতা গর্জে ওঠে প্যালেস্টাইনের উপর হামলার প্রতিবাদে অন্যদিকে সোচ্চার প্রতিবাদ জানায় টুইন টাওয়ার ধ্বংস বিরুদ্ধে। এই কলকাতাই সবার আগে গলা মেলায় শাহবাগ আন্দোলনের সাথে আবার নেপালের ভূমিকম্পে ত্রাণ সংগ্রহ করতে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে পথে নামে এই কলকাতাই।
হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই শহরের পুরানো গাছগুলির মতোই। আধুনিক কলকাতায় বদলে গেছে শহরের চেহারা থেকে জীবনের গতি। কিন্তু বদলায়নি কলকাতার হৃদয়, কলকাতার মনন। তাই অনেক বদলে গেলেও কবির ভাষায় বলাই যায় “কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই”
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৫ ,২০১৫
আরআই