কলকাতা: শহরের চরিত্র বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে কলকাতার শরৎকাল। আর শরৎ মানেই শারদীয় দুর্গোৎসব।
একদিকে ভোররাতের ফোটা শিউলি ফুল সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়তে থাকে গাছের তলায়। অন্যদিকে চণ্ডীপাঠের চিরাচরিত সুরে পিতৃতর্পণের উদ্দেশ্যে গঙ্গার ঘাটে জমা হন সনাতন ধর্মের মানুষরা।
সেকালের কলকাতার মহালয়া শুরু হতো আকাশবাণী কলকাতায় ভোরবেলা বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠের সুরে। আজও আকাশবাণী কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে সে ঐতিহ্য বজায় রেখে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ বাজিয়ে শোনানো হয়।
তবে আকাশবাণীর চণ্ডীপাঠের সঙ্গে এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সবক’টি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হয় মহালয়ার নাট্যরূপ। তাতে কোথাও দেবী দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করেন কোনো টেলিভিশন অভিনেত্রী বা টলিউডের নায়িকা।
তবে এ ধারার শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে দূরদর্শনের হাত ধরে।
এবারের মহালয়ায় সোমবার (১২ অক্টোবর) একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করেছেন কোয়েল মল্লিক। অন্য একটি চ্যানেলে অতি পরিচিত মেগা সিরিয়ালের নায়িকা পায়েল দে। কলকাতা দূরদর্শনে শুরুর দিকে দুর্গার রূপে দেখা দিয়েছিলেন হেমা মালিনীসহ মুম্বাইয়ের নায়িকারা। সে ধারা বজায় রেখে মহালয়ায় দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেবশ্রী রায়সহ টলিউডের নায়িকারা।
দেবীপক্ষের শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই এ দিনে এক সময় পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরে শিউলি ফুলের বোটা থেকে রং বের করে কাপড় রাঙানো হোতো। আর ছিল ছিল শিউলি পাতা বেটে মধু দিয়ে খাওয়া। মনে করা হতো, এটি নাকি ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক। এসব পাট অনেক দিন আগেই চুকে গেছে।
তবে দু‘টি অভ্যাস এখনও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু বাঙালি টিকিয়ে রেখেছেন। তার প্রথমটি হোল তর্পণ এবং পরেরটি হলো মহালয়ার দিনটিতে অন্তত সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিছানা পরিত্যাগ করে মহালয়া শোনা। ‘শোনা’ শব্দটি যদিও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ, কলকাতার ক’জন মানুষের ঘরে রেডিও আছে সে কথা হয়তো হাতে গুণে বলা যাবে।
তাই ভরসা মোবাইল ফোন অথবা টেলিভিশন। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলতে গেলে শহর কলকাতায় সকালে উঠে মহালয়া শোনার অভ্যাস আছে, এমন মানুষের সংখ্যাও কমে আসছে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে এখনও সকালে মহালয়া শোনার কিছুটা প্রচলন আছে।
বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোর পাড়ায় পাড়ায় এদিনেই আসতো প্রতিমা। আজ সে ছবিটাও বদলে গেছে। ‘থিম’ পূজার ফলে কলকাতার বেশিরভাগ পূজামণ্ডপে প্রতিমা চলে আসে বেশ কিছুটা আগে। আর অনেক জায়গায় তো এখন মণ্ডপের ভেতরেই প্রতিমা বানানো হয়।
মহালয়ার আরও একটা দিক আজকাল প্রায় দেখাই যায় না। এদিনে পাড়ায় পাড়ায় ছোটরা তাদের অভিনীত নাটক পরিবেশন করতো। বড়দের অভিনয় করা নাটকে দেখানো হতো পূজার কোনো একটা দিন। কিন্তু ছোটদের জন্য মঞ্চ বরাদ্দ থাকতো মহালয়ার দিনটিতে। সে চর্চা আজ আর নেই বললেই চলে।
এক সময় মহালয়ায় বরাদ্দ থাকতো ছুটি। কলকাতার বেশিরভাগ অফিস এখন এ দিনে খলা থাকে। যদিও শুধু মহালয়া নয়, বেসরকারি ক্ষেত্রে কলকাতায় ছুটি পড়ে সপ্তমীর দিন কাজ করার পর। আর আইটি সেক্টরে পূজার মধ্যে একটি দিনও কাজ বন্ধ থাকে না। মহালয়াসহ পূজার প্রতিদিনই আইটি ক্ষেত্রের কর্মীরা স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যান। তবে ইউরোপ বা আমেরিকার অফিসের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে রাত জেগে কাজ করা এ কর্মীরা ভোরবেলায় রেডিও না চালালেও তাদের ফেসবুকেও ভেসে ওঠে মহালয়ার শুভেচ্ছা।
তবে এতো কিছু বদলে যাওয়ার মধ্যেও মহালয়াই নিয়ে এসেছে চিরচেনা সেই পূজা পূজা গন্ধ, নিয়ে এসেছে শারদ উৎসবের আমেজ। প্রকৃতি কি এক অদ্ভুতভাবে নিজের রূপের পরিবর্তন করে নিয়েছে। আকাশ-বাতাস জানান দিচ্ছে, শুরু হয়ে গেল শারদীয় দুর্গোৎসব। এটাই মহালয়ার মূল সুর।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৫
ভিএস/এএসআর