কুষ্টিয়া: ভিটামিন এ, সি, ই ও ভিটামিন বি-৬ সমৃদ্ধ সবজি স্কোয়াশ। ভিনদেশি এ সবজিতে রয়েছে নানাবিধ উপকারী উপাদান।
এটি কীভাবে খেতে হয়, এর পুষ্টিগুণ কী, এসব সম্পর্কেও তেমন একটা জানেন না গ্রামীণ জনপদের অনেক মানুষ।
অনেকটা শখের বসে অনেকে চাষাবাদ করায় এ সবজি কিছুটা বিস্তার লাভ করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে এ সবজির দাম ভালো হওয়ায় অনেক তরুণ ও বেকার যুবক আধুনিক পদ্ধতিতে স্কোয়াশ চাষ করে লাভবান হয়েছেন। তবে এখনো এ সবজির ব্যবহার এবং প্রচলন খুব একটা না থাকায় স্থানীয় বাজারে দাম পাচ্ছেন না উৎপাদনকারী কৃষকরা। সবজিটির আদি নিবাস উত্তর ইতালিতে। যা জুকিনি নামেও পরিচিত।
এ বছর আবহাওয়া ভালো হওয়ায় দেশে প্রচলিত প্রায় সব ধরনের শীতকালীন সবজির উৎপাদন বেড়েছে। স্কোয়াশ চাষের উপযোগী হওয়ায় আমাদের দেশেও বাণিজ্যিকভাবে এ সবজির চাষাবাদ হয়েছে।
তবে স্থানীয় বাজারে এ সবজির চাহিদা কম থাকা এবং কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি ক্রেতাদের যোগাযোগ না থাকায় অনেকটা লোকসান গুণছেন স্কোয়াশ চাষিরা।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর এলাকার কৃষক হাসানুল হক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার ফুপাতো ভাই এ সবজির চাষাবাদ সম্পর্কে জেনে গত বছর চাষ করে বেশ সাফল্য পেয়েছিলেন। তার দেখাদেখি হাসানুলও লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কোয়াশ চাষ শুরু করেন। যোগাযোগ করেন মিরপুর উপজেলা কৃষি অফিসে। সেখান থেকে সবজি চাষ সম্পর্কে জেনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তামাকের বিকল্প ফসল হিসেবে চাষ করেন স্কোয়াশ।
করোনাকালে কলেজ বন্ধ থাকায় বাড়িতে অবসর সময় না কাটিয়ে তিনি ৫০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন এ নতুন সবজি। এলাকায় প্রথম এ সবজি চাষ শুরু করেছেন তিনি। অনেকে তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, আবার অনেক কৃষক ধিক্কারও দিয়েছেন। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বিদেশি এ সবজি চাষ শুরু করেন। আশার আলো জাগিয়ে এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছে তার স্কোয়াশ। অল্প সময়ে আশানুরূপ ফল পেয়েছেন তিনি। তবে এ বছর সবজির দাম এবং বাজারজাত করণের অসুবিধার কারণে লোকসানের শঙ্কা রয়েছে তার।
তরুণ কৃষক হাসানুল হক বলেন, আমার ফুপাতো ভাই গতবছর স্কোয়াশ চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছিলেন। আমি তার পরামর্শে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে চাষাবাদ পদ্ধতি দেখে ৫০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে স্কোয়াশ চাষ করি। জমি প্রস্তুত করে আধুনিক পদ্ধতিতে মালচিং করে এ এলাকায় প্রথম এ সবজির চাষ করি। নিজে বাড়িতে জৈব সার উৎপাদন করে জমিতে প্রয়োগ করি। এতে আমার রাসায়নিক সার কম লাগার পাশাপাশি বেশ ভালো ফলন হয়। বীজ রোপণের মাত্র ৫৫ দিনেই আমার স্কোয়াশ গাছ থেকে প্রথম ফল সংগ্রহ করি।
৫০ শতাংশ জমিতে আমার জমি বর্গা, জমি প্রস্তুত, সার, মালচিং সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। মোট দুই হাজার ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মতো গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছেই প্রচুর ফুল এবং ফল ধরেছে। প্রত্যেকটি গাছে চার-পাঁচটা করে স্কোয়াশ রয়েছে। দাম যদি ১৫-২০ টাকা কেজিও পেতাম, তাহলে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার ওপরে স্কোয়াশ বিক্রি করতে পারতাম। তবে এ বছর কোনো সবজিরই দাম নেই। আর স্কোয়াশ তো নতুন সবজি। গ্রামের মানুষ অনেকেই কুমড়া মনে করে, নিতে চায় না। কীভাবে খেতে হয় তাও সঠিকভাবে জানে না। তাই স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা অনেক কম। এ পর্যন্ত মাত্র ১০-১২ হাজার টাকার স্কোয়াশ বিক্রি করেছি, যোগ করেন তিনি।
হাসানুল বলেন, বর্তমানে দাম নেই বললেই চলে। লাভ তো দূরের কথা, খরচই উঠবে না। ফলন দিয়ে কি হবে? দাম নেই, বাইরের কোনো ক্রেতাও আসে না কিনতে। সর্বশেষ দু’দিন আগে স্কোয়াশ বাজারে বিক্রি করেছি কেজিতে না, দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের স্কোয়াশ পিস হিসেবে পাইকারি চার-পাচ টাকা করে। এমন দাম হলে সবজি চাষাবাদ কমে যাবে।
স্কোয়াশের রোগবালাই কম, এ বছর আবহাওয়াও বেশ ভালো ছিল। দাম ভালো হলে স্কোয়াশ চাষ খুবই লাভজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমি কৃষি অফিসের পরামর্শে মালচিং ব্যবহার করে অনেকটা সাশ্রয় করেছি। কারণ মালচিং দিলে নিড়ানি লাগে না। লেবার খরচ কম হয়, সেই সঙ্গে ফলগুলো মাটির স্পর্শে না থাকায় সুন্দর থাকে।
দাম যদি ভালো পাওয়া যায়, তাহলে অনেকেই এ স্কোয়াশ চাষ করবে। সেই সঙ্গে কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদিত সবজি কেনার ব্যবস্থা করা হলে স্কোয়াশ চাষ আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
স্থানীয় কৃষক তৈয়ব আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এলাকায় এটা নতুন। এর আগে স্কোয়াশ কেউ চাষ করেনি। হাসানুল এটি প্রথম চাষ করেছে। খুব ভালো হয়েছে। তবে বাজারে এবার সব ধরনের সবজির দাম কম হওয়ায় স্কোয়াশেরও দাম কম। তাই লস হচ্ছে। দাম ভালো হলে এটি চাষ করা যায়।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন বাংলানিউজকে জানান, স্কোয়াশ একটি বিদেশি সবজি। তবে আমাদের অঞ্চলের আবহাওয়া স্কোয়াশ চাষের জন্য উপযোগী। আমরা এ নতুন সবজি চাষ সম্প্রসারণের চেষ্টা করছি। কৃষকদের এসব লাভজনক ফসল উৎপাদনে পরামর্শ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছি।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, মিরপুর উপজেলার কয়েকজন কৃষক তিন-চার একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে স্কোয়াশ চাষ করেছেন।
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, স্কোয়াশ সবজি হিসেবে খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ। এছাড়া এটি খুবই কম সময়ের ফসল। গতবছর মিরপুর উপজেলার কয়েকজন কৃষক স্কোয়াশ চাষ করে বেশ ভালো সাফল্য পেয়েছিলেন। এ বছরও কয়েকজন কৃষক স্কোয়াশ চাষ করেছেন। আমরা তাদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিচ্ছি। এ বছরের আবহাওয়া সবজি চাষের অনুকূল হওয়ায় প্রায় সব ধরনের সবজির উৎপাদন বেড়েছে। স্কোয়াশ সবজি হিসেবে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত নয়। তাই স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা কম।
তবে শীতকালে সবজির ভরা মৌসুমে কৃষকদের উৎপাদিত এসব সবজির ক্ষেত্রে বাজারজাত করণের অসুবিধার কারণে অনেকটাই ন্যায্য দাম থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হন। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে সবজি কেনার উদ্যোগ নিলে কৃষকরা ন্যায্য দামে সবজি বিক্রি করে আরও সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন বলেও মনে করেন এ কর্মকর্তা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) রঞ্জন কুমার প্রামাণিক বাংলানিউজকে জানান, আমরা লাভজনক এবং নিরাপদ সবজি উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। কৃষিটাকে বাণিজ্যিক এবং লাভজনক করার চেষ্টা করছি। স্কোয়াশ বিদেশি সবজি হলেও আমাদের অঞ্চলে এটির প্রসার ঘটানো সম্ভব। এ বছর উৎপাদন বেশি হওয়ায় সবজির দাম কম। তবে দ্রুত ফলন হওয়ায় স্কোয়াশ বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হলে বেশ লাভজনক হবে।
জেলা বাজার কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার মনিটর করছি। যেসব সবজির স্থানীয় বাজারে চাহিদা কম বা দাম কম, জেলার বাইরে কোথাও যদি সেটির দাম ভালো হয়, আমরা সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১
এসআই