জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি): ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সাবেক অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমদকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। যে পদে নিয়োগ সেটির চেয়ে তার উপাচার্য হওয়ার ‘খায়েশ’ বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক চিকিৎসার জন্য ছুটিতে। এ সময় তার রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন ট্রেজারার কামালউদ্দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করলেও কামালকে এ ব্যাপারে বললে বা তার পদ সম্পর্কে লিখতে মন খারাপ করেন তিনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে তার নাম ঘোষণা দিতে হয়।
এমন কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধু কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা।
নিয়ম আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য না থাকলে বা ছুটিতে থাকলে তার রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার। কিন্তু এর আগে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চলতি দায়িত্ব পালন করেন কামালউদ্দিন। সুযোগ পেয়েই তিনি উপাচার্যের অফিস ও গাড়ি নিজের দখলে নেন। এ নিয়ে সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী থেকে শুরু করে সব মহলে সমালোচনা হয়। সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে তিনি উপাচার্যের অফিস ও গাড়ির দখল ছাড়েন।
জানা গেছে, ট্রেজারারকে সে সময় উপাচার্যের অফিস ও গাড়ি ব্যবহারের পরামর্শ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত কয়েকজন অসাধু শিক্ষক-কর্মকর্তা। ট্রেজারারের আশির্বাদপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ দপ্তরের পরিচালক কাজী নাসির উদ্দিন লুটপাটে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অহেতুক কাজ দেখিয়ে মাসিক বেতন সমপরিমাণ বেসিক নিতে পারদর্শী তিনি। তার এসব অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে।
এদিকে, ট্রেজারার কামালউদ্দিনের মেয়াদ শেষ হতে আর বাকি ২ মাস। কিন্তু তাকে ফের এ পদে রাখতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধু শিক্ষক-কর্মকর্তারা। তবে শিক্ষক সমিতির দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অধ্যাপকদের মধ্য থেকে যেন ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়া হয়। এ জন্য তারা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছেন। সর্বশেষে বুধবার (৪ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী ট্রেজারার হিসেবে কামাল উদ্দিনকে শিক্ষক সমিতি চায় না জানিয়েও সংবাদ সম্মেলন করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষক সমিতির নেতারা বলেন, কোষাধ্যক্ষ পদে ড. কামালউদ্দিন আহমদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৬ নভেম্বর। আগামী ট্রেজারার নিয়োগে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে চাই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৫৬ জন অধ্যাপক রয়েছেন। এর মধ্যে দুজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য এবং দুজন উপ-উপাচার্য হিসেবে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া অতীতেও বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার পদে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক অধ্যাপক।
নানা গণমাধ্যমে ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট সংসদীয় কমিটির এক বৈঠকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ বলে তোপের মুখে পড়েন সুবিদ আলী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক কামালউদ্দীন আহমেদের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। তিনি কখনো সাদা দলের পৃষ্ঠপোষক আবার কখনো বাম সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়।
বর্তমানে নিজেকে খাঁটি আওয়ামী লীগার হিসেবে দাবি করেন কামালউদ্দীন আহমেদ। এ নিয়ে শিক্ষক মহলেও নানা সময় চলে আলোচনা-সমালোচনা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারার পদে কামালউদ্দিন আহমদ চার বছরে বিভিন্ন বিতর্কিত কাজকর্ম করেও সমালোচিত হয়েছেন। কখনো মানবতাবিরোধী আসামি সাকা চৌধুরীর পরিবার সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে লেকের টেন্ডার দিয়ে, আইন না মেনে টানা তিন বছর বাজেট নিজে উপস্থাপন না করে অর্থ পরিচালককে দিয়ে উপস্থাপন করা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র না মেনে বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে বেতনের সমপরিমাণ বেসিক নেওয়া, আইনের তোয়াক্কা না করে নির্বাচনী প্রচারণায়, নিয়ম লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিজের মেয়ের বিয়েতে ব্যবহার, উপাচার্য না থাকায় তার গাড়ি-অফিস নিজের দখলে নিয়ে ব্যবহারসহ নানা কাজে বিতর্কিত হন তিনি।
এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এবং সাকা চৌধুরীর পরিবার সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে নিয়ম না মেনে টেন্ডার দেওয়ায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমদকে প্রশাসনিকভাবে চরম অদক্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাকে টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি থেকে অপসারণেরও সুপারিশও করা হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতাদের দাবি, ইংরেজির অধ্যাপক কামালউদ্দিন আহমদ ট্রেজারার হিসেবে শুধু সই করে গেছেন। বাজেট তৈরিসহ সব কাজ করেছেন অর্থ পরিচালক।
ট্রেজারারের নামের আগে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য লেখা নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, একজন যদি পূর্ণ দায়িত্ব না পান তাহলে কোনোভাবেই তার নামের আগে ভারপ্রাপ্ত লেখা যায় না। আমরা আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রুটিন দায়িত্ব পালন করা নিয়ে এমন দেখি নাই। এটা তার জন্যও লজ্জার এবং আমাদের জন্যও লজ্জার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, ট্রেজারার উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বে আছে। এটি ও চলতি দায়িত্ব এক নয়। প্রশাসনেও বেশ কয়েকবার এ বিষয়ে কথা বলেছি। তারাও বলেছে, এ দুটো বিষয় এক নয়। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত লেখার জন্য তাদের চাপ প্রয়োগ করা হয়। ভিসি মীজানুর রহমান যখন মেয়াদ শেষে চলে গেলেন, তখন তিনি (কামাল) উপাচার্যের গাড়ি ও অফিস ব্যবহার করা শুরু করলেন। এ নিয়ে তখনও আমরা বলেছি তিনি এটা করতে পারেন না। এটা তার রুটিন দায়িত্ব।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তরের পরিচালক বাংলানিউজকে বলেন, রুটিন দায়িত্ব বলতে বোঝায় বেসিক কাজগুলো করা। প্রতিদিনের যে স্বাভাবিক কাজকর্ম- সেগুলো করতে হবে। কোনো বড় কাজ যেমন পলিসি মেকিং বা সিদ্ধান্ত এসব রুটিন দায়িত্বে পড়ে না।
ট্রেজারারের নামের আগে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা প্রশাসন বলতে পারবে কাকে কি দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা বলতে পারবো না।
এসব বিষয়ে কথা বলতে চান না ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমদ। তাই তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বারবার কল কেটে দেন তিনি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ইমদাদুল হক চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২৩
এমজে