অনেক জল্পনাকল্পনা ও অপেক্ষার পর হামজা চৌধুরী এখন কেবল বাংলাদেশের। তার নামের পাশে এখন আর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখা লাগবে না।
২০১৭ সালে লেস্টার সিটির হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হওয়ার পর থেকেই আলোচনা চলতে থাকে বাংলাদেশের জার্সিতে হামজাকে কি দেখা যাবে? সেই মুহূর্তটির জন্য কেবল আর কয়েক মাসের অপেক্ষা। সব ঠিক থাকলে আগামী মার্চে বাংলাদেশের হয়ে মাঠ কাঁপাতে দেখা যাবে এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে।
বাংলাদেশের হয়ে খেলার অনুমতির বিষয়টি হামজা প্রথম সামনে আনেন যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ভার্সেস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। যা তুলে ধরা হলো বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য-
কখন বুঝতে পারলেন আপনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চান? এমন কোনো বিশেষ মুহূর্ত কি আছে যা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে?
হামজা: না, সত্যি বলতে তেমন কোনো বিশেষ মুহূর্ত ছিল না। অবশ্যই বাংলাদেশের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং ছোট থাকতে বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছি। তবে এটা বলতে পারব না যে, সেসময় আন্তর্জাতিক ফুটবল নিয়ে খুব একটা ভেবেছি আমি।
অনেকের কাছে, বিশেষ করে যারা ফুটবল খেলে বেড়ে ওঠে, তাদের স্বপ্ন থাকে জন্মভূমিকে প্রতিনিধিত্ব করার এবং আমার জন্য তা ছিল ইংল্যান্ড। তাই যুব দলে খেলার সময় থেকেই ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার লক্ষ্য স্থির করলাম। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ইংল্যান্ডকে প্রতিনিধিত্ব করাটাও অবশ্য সম্মানের। বছরের পর বছর কেটে যাওয়ার পর বাংলাদেশের হয়ে খেলার সম্ভাবনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয় এবং আমি সেটা নিয়ে ভাবতে শুরু করি।
বাংলাদেশের হয়ে খেলতে আমাকে একাধিকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিল আমার পরিবার। তাই এটা এমন কিছু নয়, যা নিয়ে আমি আগে ভাবিনি। তা সবসময়ই আমার মাথায় ছিল এবং এটি নিয়ে অনেকদিন দ্বিধায় ছিলাম। শেষমেষ ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশে থাকা আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে এ সিদ্ধান্ত নিই। তা নিয়ে আমি সত্যিই গর্বিত এবং ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে তা দেখার জন্য আমি মুখিয়ে আছি।
ছোটবেলার কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?
হামজা: ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত আমি প্রতি বছরই পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে যেতাম। মাঝেমধ্যে বছরে দুবারও গিয়েছি। দুঃখজনক হলো, গত ১০ বছর বা এর বেশি সময় ধরে সেখানে যাওয়া হয়নি। একজন ফুটবলারের জীবন অনেক ব্যস্ততায় ভরপুর এবং সবার জন্য সময় বের করাটা কঠিন। এখন আমার তিনটি সন্তান রয়েছে, যারা খুবই ছোট এবং ফুটবলের বাইরে তারা আমাকে যথেষ্ট ব্যস্ত রাখে। তবে আমার অনেক শৈশবের স্মৃতি রয়েছে।
আমার পারিবারিক বাড়ি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলায়। ছোটবেলায় বেশিরভাগ সময়ই আমি বাইরে কাটিয়েছি, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। যা ইংল্যান্ডে বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকে একদমই আলাদা। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো চিন্তা না করে, কোনো উদ্বেগ ছাড়াই গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাটি একদমই ভিন্ন। মনে হতো এলাকার সবাই একে অপরকে চেনে, সবাই খুব ঘনিষ্ঠ এবং একে অপরের দেখভাল করে। এই বিষয়টি আমার কাছে দারুণ লেগেছে।
লফবোরোর মতো ব্যস্ত শহর থেকে আসা এক শিশুর কাছে বেশ অদ্ভূতই লেগেছিল এই পরিবেশ। যেখানে সবসময় বাবা-মা আমাকে নিয়ে চিন্তিত থাকতেন- কোথায় যাচ্ছি, কখন ফিরব এমন প্রশ্ন শুয়নতে হতো নিয়মিতই। তারপর যখন বাংলাদেশে গিয়ে মুক্ত স্বাধীনতা উপভোগ করলাম, তা সত্যিই অনেক আনন্দের ছিল।
বাংলাদেশে এতো নিয়মিত যাওয়ার ফলে আমি তরুণ বয়সেই কৃতজ্ঞ হতে শিখেছি। অনেককেই দেখেছি যারা আমার মতো সুযোগ-সুবিধা পায়নি, কিন্তু তারা খুব খুশি ছিল। অনেক ক্ষেত্রে আমার চেয়ে বেশি এবং জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করত। যা আমাকে সত্যিকার অর্থে কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়েছে। যখনই বাংলাদেশে যেতাম, তখন কিছু পোশাক নিয়ে যেতাম –বেশি লাগেজ থাকায় অবশ্য বিমানবন্দরে প্রচুর ঝামেলা হতো। তবে যে উদারতা ও প্রচেষ্টা সেই জিনিসগুলা নিয়ে আমরা করতাম, সেসব লোকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিত।
আমরা সৌভাগ্যবান যে যুক্তরাজ্যে বড় হয়েছি এবং অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি, এর মধ্যে অনেক কিছু প্রাথমিক চাহিদা বলে মনে হতো, যদিও অনেক কিছুই অপ্রয়োজনীয় ছিল। বাংলাদেশে আমি অনেককে দেখেছি, যাদের কাছে ন্যূনতম চাহিদাগুলোও ছিল, তবে তারা খুশি ছিল। সেটাই আমাকে তরুণ বয়সে এক মূল্যবান শিক্ষা দিয়েছে।
বাংলাদেশে ফুটবল কতটা বড়?
হামজা: অনেকেই মনে করে ক্রিকেট তাদের (বাংলাদেশের) সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু আমি মনে করি, এটা ভুল ধারণা। হয়তো এর কারণ হলো, জাতিগতভাবে ক্রিকেটেই তারা বেশি সাফল্য পেয়েছে। তবে আমি মনে করি, যে খেলাটির প্রতি তাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা রয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে ফুটবল। এখনো পর্যন্ত জাতীয় দল তেমন কোনো সাফল্য পায়নি। কিন্তু বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশে গেলে দেখা যাবে অর্ধেক বাংলাদেশি আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করছে, বাকি অর্ধেক ব্রাজিলকে। তখন চারদিকে যে উত্তেজনা ও প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা বিরাজ করে, তা বলতে গেলে এক অন্যরকম পরিবেশ। এটা আমার কাছে অবাক করার মতো। তবে যেমনটা বলেছি ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার মাত্রাটা সেখানে বিশাল।
প্রিমিয়ার লিগের একজন ফুটবলার হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব সম্পর্কে বলুন...
হামজা: এর দায়িত্ব ও গুরুত্ব বুঝতে পারাটা কঠিন আমার জন্য। কেবল ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা ও উপভোগ করার জন্যই আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে সময়ের সঙ্গে বুঝতে শুরু করেছি বা চেষ্টা করছি প্রিমিয়ার লিগে খেলা প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমার কতটা দায়িত্ব রয়েছে। এটা শুধু কয়েকজনের নয়, বরং পুরো দেশের প্রতিনিধিত্ব। আমার জন্য এটা কেবল গর্বের বিষয়। আমি দায়িত্ব নিয়ে খুব একটা ভাবি না। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছি এবং যাত্রাটা উপভোগ করছি।
বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর প্রথমে কী করেছেন?
হামজা: আমার সঙ্গে লন্ডনের দূতাবাসে বাবা-মা গিয়েছিলেন পাসপোর্ট নিতে। তারা এতে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলেন, কারণ অতীতে ভিসার জন্য অনেক ঝামেলায় যেতে হয়েছে তাদের। এবার তারা একদম নির্ভার ছিলেন এবং তাদের খুবই সুন্দরভাবে আপ্যায়ণ করা হয়। দিনটি অসাধারণ ছিল। আমরা গাড়িতেই উঠতে বাংলাদেশে থাকা পরিবারের মানুষজনের সঙ্গে ফোনে প্রচুর আলাপ শুরু হলো। মা তো গাড়িতে বসেই আংকেল-আন্টিদের কল দিতে শুরু করলেন। পরিবারের সবার সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং তারা আমাকে নিয়ে গর্বিত।
যুক্তরাজ্যে থাকা বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের ওপর এটি কেমন প্রভাব ফেলবে বলে আপনার মনে হয়?
হামজা: আমি মনে করি, এটি বাংলাদেশি ফুটবলকে আরও পরিচিতি দেবে। পরিচিত কোনো মুখ দেখলে অনেক অনুপ্রেরণা মেলে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে আমাদের কমিনিউটিতে ফুটবলের কোনো রোল মডেল না থাকা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এমন কেউ যে আমাদের মতো পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে বা যার জীবনের পথ আমাদের মতোই। এতে করে স্বপ্নটা শুধু বড়ই হয় না, বরং স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়াও সম্ভব মনে হয়। তারা আমার মতো একই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে এবং এমনকি আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে। এটাই আমার মূল লক্ষ্য- মানুষকে দেখানো যে, যেখান থেকেই তারা শুরু করুক না কেন, সুযোগ সবসময়ই থাকে।
আপনার কেন মনে হয় অন্যান্য খেলোয়াড়রা তাদের শেকড়ের প্রতিনিধিত্ব করতে চান?
হামজা: নিজের দেশের লোকেদের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে যে গর্ব অনুভূত হয়- আমার মনে হয় না, এর সঙ্গে কোনো কিছু মেলানো সম্ভব হবে। ইংলিশ ফুটবলে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত অনেক ফুটবলার আছে। যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠাটা যুক্তরাজ্যেই। কিন্তু তারা নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চান, কারণ তাদের শেকড় অনেক শক্তিশালী।
নিজের বাড়ি বলতে, অনেকের কাছে অনেক অর্থ বহন করে এবং যখন কেউ তার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে তখন সেটা একেবারেই প্রকৃত্ব ও নিখাদ অনুভূতি। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো সমালোচনা করা উচিত নয়। প্রচণ্ড চাপ নিয়ে খেলা একজন ইউরোপিয়ান লিগের ফুটবলার হিসেবে আমি মনে করি, ভালোবাসার সেই বিশুদ্ধ অনুভূতি ফুটবলে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ফুটবলে অনেকেই আছে যারা আপনাকে সফল দেখতে চায়। তেমন আবার অনেকেই আছে, যারা চায় না আপনি ভালো করুন। ফুটবল এত প্রতিন্দ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং এত চাপের যে নিজের শেকড়ে ফিরে গিয়ে নিজের দেশের আনন্দ অনুভব করাটা সত্যিই দারুণ। এটা একেবাইরে নিঃশর্ত অনুভূতি। ভালো খেলুন বা খারাপ খেলুন, দেশ অনেকটা পরিবারের মতো, যাদের কাছে আপনি দীর্ঘ পরিশ্রমের পর ফিরে আসতে পারেন। যা আমার কাছে এক ধরনের আশ্রয়ের মতো মনে হয়।
শীর্ষ পর্যায়ে আরও বাংলাদেশি খেলোয়াড়কে দেখার আশা করেন?
হামজা: অবশ্যই! এক মিলিয়ন ভাগ দেখতে চাই। এটি আমাকে অবাক করে কারণ আমি ছোটবেলায় অনেকে বাংলাদেশির সঙ্গে বেড়ে উঠেছি আমি। এর মধ্যে কয়েকজন আমার চেয়েও ভালো ছিল। হয়তো তারা শারীরিকভাবে ভালো ছিল না, কিন্তু টেকনিক্যালি অবশ্যই।
এখন সোমালিয়ার কথাও উঠে আসছে। আমার জীবনে দেখা সেরা কয়েকজন খেলোয়াড় ছিল সোমালিয়ার। আমি জানি, ফুটবলে জায়গা করে নেওয়া তাদের জন্য কতটা কঠিন। তবে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, দক্ষিণ এশিয়ার খেলোয়াড়দের জন্যও সুযোগ তৈরি করছি আমরা। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম বাংলাদেশি ফুটবলার হতে পেরে আমার অবশ্যই গর্ব হয়। তবে আশা করি এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য খেলোয়াড়দের জন্যও দুয়ার খুলে দেবে। প্রথম হতে পারাটা দারুণ তবে আরও ভালো হবে যদি আমিই শেষ না হই।
দক্ষিণ এশিয়ানদের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে ফুটবলকে কীভাবে আরও সহজলভ্য করা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
হামজা: আমার মতে তরুণদের বিভিন্ন লিগে সুযোগ তৈরি করে দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক বছরে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে, তবে আরও অনেক কাজ বাকি আছে। যাতে করে সবাই সমান সুযোগ পায়। আমার প্রজন্মের মানুষদের বাবা-মা ছিলেন প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী। আমাদের সংস্কৃতিতে কঠোর পরিশ্রম ও শিক্ষার ওপর প্রচুর জোর দেওয়া হয়। স্কুলে ভালো ফলাফল ও একাডেমিক দক্ষতাকে ফুটবলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ কারণে মানসিকতা বদলানো ও খেলাধুলায় সুযোগ বাড়ানো– দুই দিকেই কাজ করতে হবে।
তবে যেখানে দক্ষিণ এশিয়ানরা খেলে থাকেন সেসব লিগ বা টুর্নামেন্টে যদি স্কাউটরা নজর না রাখেন তাহলে তাদের সুযোগই বা কোথায়? ক্লাবগুলোকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও ছড়িয়ে দিতে হবে এবং সেসব লিগে লুকানো প্রতিভা খুঁজে বের করতে হবে। কারণ আমি বলছি, আমাদের মতো আরও অনেক আছে সেখানে।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি নিয়ে ছোট হামজা কেমন অনুভব করত বলে আপনার মনে হয়?
হামজা: খুব, খুব গর্ব করতো। ছোটবেলায় বাংলাদেশ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, আশা করি কিছু বিষয় আমি আমার সন্তানদেরও শেখাতে পারব। যাতে করে তাদের ভেতর কৃতজ্ঞতা বোধ ও সবাইকে এক চোখে দেখার মানসিকতা তৈরি হবে। ইংল্যান্ড অবশ্যই আমার বাড়ি, তবে বাংলাদেশও তা। নিজের শেকড়ে ফিরে গিয়ে, নিজেদের লোকেদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারাটাই আমার কাছে সবকিছু। এটা আমাকে প্রচুর আনন্দ ও গর্বে ভরিয়ে তোলে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪
এএইচএস