ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুটবল

সুইস ব্যাংকে এক পেনি জমা রাখলো আর্জেন্টিনা

সালেক সুফী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৫ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০১৪
সুইস ব্যাংকে এক পেনি জমা রাখলো আর্জেন্টিনা

ঢাকা: আর্জেন্টিনা ১ (ডি মারিয়া ১১৪*) : সুইজারল্যান্ড ০, অ্যারেনা ডি সাও পাওলো।

খেলার ফলাফল দেখে বোঝার উপায় নেই যে, পুরো খেলাজুড়ে কার্যত সুইজারল্যান্ড এগিয়ে ছিল।

সুইসদের একের পর এক গোল মিসের মহড়া আর আর্জেন্টিনার দুর্বল আক্রমণে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। শেষ পর্যন্ত মেসির জাদুকরি পাসে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে লাতিন আমেরিকার অন্যতম পরাশক্তি দলটি।

পুরো খেলায় দারুণ খেলছিল সুইসরা এবং প্রথমার্ধে বেশ কিছু নিশ্চিত গোল মিস না করলে ইতিহাসটা একটু অন্যরকম হতে পারত। আর্জেন্টিনা এই ম্যাচেও মেসির ওপর নির্ভরশীলতা দেখাল। সামনের আরও কঠিন লড়াইয়ে তাদের এই দুর্বল ডিফেন্স নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হতে পারে।

স্বাভাবিকভাবেই সুইজারল্যান্ড এখন বিধ্বস্ত। তারা দারুণ লড়েছিল এবং পেনাল্টি শুট আউটের মাত্র দুই মিনিট দূরে ছিল। আর্জেন্টিনা ভক্তদের হৃদয় তখন হাতে চলে আসার অবস্থা। ঠাণ্ডা মেলবোর্নের ভোরে আমার স্ত্রী ও ছেলেকে ঘামতে দেখে এটা আমি অনুভব করতে পারছিলাম।

কাগজে কলমে এটা ছিল ফিফা ৠাংকিংয়ের পাঁচ ও ছয় নম্বর দলের খেলা। কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাসে ‍আর্জেন্টনা বরাবরই টপ ফেভারিট। সেই তুলনায় সুইজারল্যান্ড ততটা নয়। মুখোমুখি শেষ ছয়বারের আন্তর্জাতিক লড়াইয়ে অপরাজিত ছিল আর্জেন্টিনা।  

গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই শেষ ষোলোয় আর্জেন্টিনার প্রবেশ। পুরো নয় পয়েন্ট পাওয়া চার দলের একজন হয়েও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ শুরু হয়েছিল বেশ ধীর গতিতে। প্রথম ম্যাচে বসনিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলের জয়। এরপর ইরানের বিপক্ষে রীতিমত সংগ্রামী জয়। সেই ম্যাচের ৮৯ মিনিট ‍তাদের গোলশূন্য রাখে ইরানিরা। শেষ ম‍ূহুর্তে মেসির অসাধারণ গোলে ১-০ তে জয় পায় নীল-সাদা জার্সির দল।

শেষ ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার চিরায়ত সুন্দর ফুটবলের ঝলক কিছুটা দেখা গেলেও আহমেদ মুসার ক্রমাগত আক্রমণে তাদের রক্ষণভাগে ফাঁক বেরিয়ে আসছিল।

সৌভাগ্যবশত এ ম্যাচে লিওনেল মেসির অসাধারণ জোড়া গোলে ৩-২ ব্যবধানে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ‍আর্জেন্টাইনরা।

অন্যদিকে, সুইজারল্যান্ড গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষে ৫-২ গোলে বিধ্বস্ত হলেও হন্ডুরাসের বিপক্ষে পরের ম্যাচে ৩-০ গোলে জয় পায়। শাকিরি হন্ডুরাসের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন।

নকআউটে খেলার শুরুতেই সুইজারল্যান্ডকে খানিকটা নার্ভাস দেখালেও দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাকের মাধ্যমে খেলায় ফেরে তারা।

প্রথমার্ধ
অনেক নিশ্চিত সুযোগ তৈরি করেও দুই দলই প্রথমার্ধে গোলশূন্য থাকে। মেসি বেশ কিছু জাদুকরি মুহূর্ত তৈরি করলেও সুইসদের কড়া রক্ষণে তারা বলের দখল হারিয়ে ফেলতে থাকে। প্রথমার্ধের আগে তিনটি ফ্রি কিক মিললেও বার্সেলোনা তারকার আক্রমণ রুখে দেন সুইস গোলরক্ষক। কিংবদন্তি পেলে এদিন মাঠে বসে দেখেছেন মেসি-শাকিরিদের খেলা।

খেলার ২৭ মিনিটে প্রথম নিশ্চিত গোলের সুযোগ তৈরি করে সুইসরা। শাকিরির নিচু ড্রাইভ রুখে দেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরো। কয়েক মিনিট বাদেই ২৯ মিনিটে সুইস গোলরক্ষকও অসাধারণ নৈপূণ্যে রুখে দেন আর্জেন্টিনার আক্রমণ। সুইসদের আরেকটি নিশ্চিত গোলের সুযোগ আসে ৩৭ মিনিটে শাকিরির অসাধারণ পাস থেকে। জোসিপ দ্রমিক একদম মুখোমুখি ফাঁকা অবস্থায় পেয়ে যান গোলরক্ষকে। একটু ড্রিবল করলেই সেটি সুইসদের জন্য সুখবর হতে পারতো, কিন্তু দ্রমিক গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে বল পার করতে তা সোজা চলে যায় রোমেরোর হাতে।

মাঝমাঠে বল দখলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে ছিল। তাদের একের পর এক আক্রমণ দুর্ভেদ্য সুইস রক্ষণ থেকে ফিরে আসছিল।

প্রথমার্ধে মেসির বেশকিছু বিখ্যাত ছোঁয়া দেখা গেলেও তা সুইস রক্ষণে বড় ধরনের কোন ফাটল ধরাতে পারেনি। সেই তুলনায় ফিরতি কাউন্টার আক্রমণে সুইসরাই বরং ভয় ধরিয়ে দিচ্ছিল আর্জেন্টাইনদের মনে। বারবার তাদের দুর্বল রক্ষণভাগের ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ছিল শাকিরিরা। প্রতিপক্ষ যখন আর্জেন্টিনা, সেখানে সুইসরা নষ্ট করেছে গোলের দু’টি বড় সুযোগ।

দ্বিতীয়ার্ধ
দ্বিতীয়ার্ধেও চলতে থাকে আর্জেন্টিনার রক্ষণ হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে চলা ঝাকা ও শাকিরির একেরপর এক আক্রমণ। খেলার ৪৮ মিনিটে শাকিরির বাম পায়ের শট আটকে দেন রোমেরো। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উভয় দলেরই গোলের জন্য তাড়াহুড়ো বাড়তে থাকে। মেসির বাড়ানো অসাধারণ একটি ক্রস মিস করেন গঞ্জালো হিগুয়েন।

৬০ মিনিটের পর থেকে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্জেন্টিনা। তখন তাদের মানসিকতা অনেকটা ‘নাও অর নেভার’ গোছের। সুইস রক্ষণ ভাসিয়ে দেয় তাদের ধারাবাহিক আক্রমণের বন্যা। শেষ ১০ মিনিটে দুই দলেরই দুঃশ্চিন্তায় এভারেস্ট ছোঁয়ার দশা। দুই দলই মরিয়া হয়ে ছুটেছে গোলের পেছনে। যেভাবেই হোক বিপক্ষের জালে একটি অন্তত গোল জড়ানোই তাদের প্রধান লক্ষ্য। আর্জেন্টিনা তাদের স্বরূপে দেখা দিতে থাকে। মনে হচ্ছিল, অবশেষে জীবন্ত হলো আর্জেন্টিনা।

শেষ মুহূর্তে দেখা যায় মেসির আরেকটি জাদু। বিপক্ষের গোলবক্সের সামনে ছিলেন মেসি, তার বিশ্বসেরা ভারসাম্যে পরপর দু‘জনকে কাটিয়ে হালকা বাড়িয়ে দেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ঠিকঠাক বোঝাপড়া না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত গোলরক্ষকের হাতে জমা পড়ে। এভাবে চলতে থাকে আর্জেন্টিনার নিষ্ফল আক্রমণ বৃষ্টি।

এর মধ্যে বেশ কিছু সুযোগ এলেও শেষ পর্যন্ত গোলের দেখা পায়নি কোনো দলই। ম্যাচের অবস্থা অনেকটা যেন বাস দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কোথায় যাবে তা জানে না।

আর্জেন্টিনার পাওয়া ২০টি স্ট্রাইকের মধ্যে চারটি মাত্র তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। এক্ষেত্রে সুইসরা অনেকটা এগিয়ে। নয়টির মধ্যে তাদের সাফল্য চারটি। এভ‍াবেই গোলশূন্য অবস্থায় শেষ হয় নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা। সুইস ব্যাংক লকারে খুলল না আর্জেন্টিনার চেক।

অতিরিক্ত সময়

প্রথম পর্ব
নক আউট পর্বের নিয়ম অনুযায়ী খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। প্রথম পর্বের ১০ মিনিট চলতে থাকে পাল্টাপাল্টি খেলা। এ সময় খেলার দ্বিতীয়ার্ধের মত আর্জেন্টিনার ঝটিকা আক্রমণ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে সুইসরা। তারা অবশ্য অতিরিক্ত সময়ের তুলনায় প্রথমার্ধে বেশি আক্রমণে এসেছিল। ক্রমেই ম্যাচ গড়াচ্ছিল পেনাল্টি পর্বের দিকে।

দ্বিতীয় পর্ব
এটা ছিল আর্জেন্টাইন ভক্ত সৈনিকদের জন্য সবচেয়ে উদ্বিগ্ন সময়। সময়টা বিশেষ কেউ একজনের সামনে এগিয়ে নেওয়ার, কিন্তু মেসিকে পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল। এ সময় হিগুয়েনের পাস থেকে ডি মারিয়ার জোরালো শট দুর্দান্তভাবে রুখে দেন বেনাগলিও। ডি মারিয়া সুইস রক্ষণে ফাটল ধরাতে শুরু করেছিলেন প্রায়। আর্জেন্টিনা যখন ক্রমেই গোলের কাছে চলে আসছিল, তখন সুইসরা অপেক্ষা করছিল পেনাল্টির।

অবশেষে শেষ বাঁশি বাজার দুই মিনিট আগে ডি মারিয়ার পা থেকে আসে কাঙ্ক্ষিত গোল। গোলের জন্য ধুঁকতে থাকা আর্জেন্টাইনরা শেষ পর্যন্ত মেসির জাদুকরি পাসে গোলের দেখা পায়। এরপর ইনজুরি সময়ে গোল পরিশোধের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে সুইসরা। এমনকি গোলে সমতা আনতে সুইস গোলরক্ষকও নেমে পড়েন তার সতীর্থদের সাথে। শেষ মুহূর্তে গোলবার ছুঁয়ে যাওয়া একটি হেড ভয় ধরিয়ে দেয় আর্জেন্টিনাদের মনে।

শেষ পর্যন্ত ১-০ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে আর্জেন্টাইনরা। আশাভঙ্গ হলো সুইজারল্যান্ডের। এখানেই থেমে গেল তাদের চলতি বিশ্বকাপ যাত্রা আর প্রতিপক্ষ চলে গেল কোয়ার্টার ফাইনালে। সেইসঙ্গে ব্রাজিলে ভিনগ্রহী মেসির জয়রথ অব্যাহত থাকল। সর্বকালের সেরাদের তালিকায় তার নাম স্থান পেতে আর মাত্র তিনটি ধাপ বাকি।

আর্জেন্টিনা দল
রোমোরো, গেরে, রোজো (ডেমিকেলিস), গ্যাগো, ফার্নান্দেজ, জাবালেতা, মাসচেরানো, ডি মারিয়া, হিগুয়েন, মেসি, লাভেজ্জি (রদ্রিগো প্যালসিও)।

সুইজারল্যান্ড দল
বেনাগলিও, লিশ্চটেইনার, শার, ডিজৌরো, রদ্রিগেজ, ইনলার, বেহরামি, ঝাকা (গেলসন), শাকিরি, মেহমেদি, দ্রমিক

রেফারি
জোনাস এরিকসন (সুইডেন)

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।