নাপোলিকে চেনার কথা আপনার। ইতালির পিছিয়ে পড়া শহর, অন্তত ৩৫ বছর আগে অবশ্যই।
আপনার হয়তো বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। এটা আসলে ছিল দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনার শহরের মতো। ভুল বলা হলো কি না কে জানে, নাপোলি তো আসলে তারই শহর। জন্মস্থান ভিয়া ফাউরিতোকে তিনি খুঁজে পেতেন এখানে। অসম্ভব যন্ত্রণার সময় কাটিয়ে বেড়ে উঠেছেন, ক্ষুধার জ্বালায় ভুগেছেন, পরিষ্কার পানি পাননি, সম্ভ্রান্তরা সবসময় পিস্টে ফেলতে চেয়েছে ম্যারাডোনাদের।
তিনি নাপোলিতে খুঁজে পেতেন নিজেকে। প্রথম দিন শহরে পা রেখেই বলেছিলেন, ‘এই শহরের গরীব ছেলেদের আদর্শ হতে চাই। কারণ তারা তেমন, যেমন আমি ছিলাম বুইন্স এইরেসে। ’ ম্যারাডোনা কি পেরেছিলেন কথা রাখতে? পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা প্রশ্নের তালিকায় হয়তো শীর্ষেই থাকতে পারে এটি।
নাপোলিতে আপনি সব কিছুতে ম্যারাডোনাকে পাবেন। তিনি এখানে ‘ঈশ্বর’। তাকে দলে ভেড়ানোর ঠিক আগে বার্সেলোনো সভাপতির চাওয়া বাড়তি অর্থ তুলতে এখানকার মানুষ চাঁদা তুলতে শুরু করেন প্রশ্ন ছাড়া। প্রথম পা রাখার পর ৭০ হাজার সমর্থক কেবল চিৎকার করেছিলেন কেবল, ‘ম্যারাডোনাকে দেখেছি! ম্যারাডোনাকে দেখেছি!’ বলে।
নাপোলিতে আপনি প্রতিটি ঘরে ঢুকলে ম্যারাডোনার ছবি দেখবেন। এখানে হাজারও বাচ্চার নামে তাকে খুঁজে পাবেন। ম্যারাডোনা নাপোলির সব মায়েদের সন্তান, সব মেয়েদের স্বামী। রাস্তার গলিতে গলিতে তিনি থাকেন। এখানে আপনি ম্যারাডোনাকে নিয়ে বাজে কিছু বললে পড়ে যেতে পারেন মৃত্যুঝুঁকিতেও। ম্যারাডোনা নাপোলিতে ফুটবলারের চেয়ে অনেক বড় কিছু।
ছেড়ে আসার ২০ বছর পর তার মেয়ে গেলেও তাকে ঘিরে মানুষের আগ্রহের কমতি থাকে না তাই। রাস্তায় নেমে যেতে হয় গাড়ি থেকে। পাসপোর্ট দেখার পর অজ্ঞান হয়ে পড়েন কেউ কেউ। হাসপাতালে গেলে দেখা যায় ডাক্তার, নার্স, রোগী সবাই অপেক্ষায় কেবল ম্যারাডোনার মেয়েকে দেখার জন্য। নাপোলিতে আদতে এতটাই বড় তিনি, কিন্তু আর্জেন্টিনায়?
দারিদ্রতাকে জয় করে এসেছেন তিনি এখান থেকে। গরীবদের পক্ষে কথা বলেছেন অতীত না ভুলে। ইতালিতে গিয়ে উত্তরের মানুষদের সবসময় করেছেন ঘৃণা। বিপ্লবী হয়ে প্রতিবাদ করেছেন সব অন্যায়ের। বন্ধু বানিয়েছেন ফিদেল কাস্ত্রোকে।
আর্জেন্টিনার রাস্তাতেও ম্যারাডোনা আছেন। বেশির ভাগ ঘরেই খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে তার ছবি। এখানকার ছেলেরা ফুটবল শুরু করে ম্যারাডোনাকে কল্পনায় রেখে। এই তো, বিশ্বকাপের ঠিক আগেই ১৪৮ ফুট উচ্চতা আর ১৩১ ফুট প্রস্তের এক ছবি আঁকা হয়েছে বুইন্স আইরেসের।
ছবিটা কোন সময়ের জানেন তো? ১৯৯০ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। ওই ম্যাচের জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময়কার। ম্যারাডোনার সঙ্গে সবচেয়ে উপযুক্ত শব্দটা বোধ হয় এলো এতক্ষণে-বিশ্বকাপ। ম্যারাডোনা মানে তো আসলে তাই।
আর্জেন্টিনাকে প্রথম বিশ্বকাপ ম্যারাডোনা জেতাননি। ১৯৭৮ সালেই শিরোপা ছুঁয়ে দেখেছিল তারা। তবে ম্যারাডোনা বিশ্বকাপে জাদু দেখিয়েছেন। ‘হ্যান্ড অব গড’ নামের গোলে তিনি যেমন আছেন, থেকছেন ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরিতেও। ’ প্রহসনের বিরুদ্ধে লড়ে জিতেছেন বিশ্বকাপ।
তবে ম্যারাডোনা সবচেয়ে বেশি বোধ হয় থেকেছেন আবেগে। অন্তত বিশ্বকাপের সময়টুকুতে গ্যালারিতে তার বাধ ভেঙে ফেলা উল্লাসে। মুখে সিগারেট নিয়ে, বুড়িয়ে যাওয়া শরীরে পাগলাটে ম্যারাডোনার উপস্থিতি থাকতো আর্জেন্টিনার প্রায় সব ম্যাচে।
বিশ্বকাপ চলছে, গত কয়েকদিন ধরে বোকা বাক্সে বন্দি কিছু স্থিরচিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। কোথাও বুকে রাখা হাত ছড়িয়ে দিয়ে, কোথাও অন্যভাবে ফিরে আসছেন ম্যারাডোনা। তিনি তো এখন কেবল এভাবেই থাকবেন আসলে, বোকা বাক্সের বন্দি কোনো স্থিরচিত্র অথবা মানুষের মনে!
রক্তে-মাংসের, পাগলাটে, বিপ্লবী ম্যারাডোনা চলে গেছেন দুই বছর হয়ে গেলো। আরেকটা বিশ্বকাপও চলে এসেছে, চলছে। তার দেশের অধিনায়ক ও সাবেক শিষ্য লিওনেল মেসি বলেছেন, ‘ম্যারাডোনা সবসময় আমাদের সঙ্গে আছে। ’
আদতেই কি তাই? ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা ভালো খেলেনি। সৌদি আরবের কাছে হেরে শুরু করেছে বিশ্বকাপ। তিনদিন পেরিয়ে গেলেও এখনও একটা ঠোঁটকাটা মন্তব্য এলো না কারো অথবা অনুপ্রেরণা যোগানো কিছু। তাহলে ম্যারাডোনা কীভাবে থাকলেন, মেসি? বোধ করি উত্তরটা কারো কাছেই নেই; যেমন নেই বিশ্বকাপের বিপ্লবী ম্যারাডোনা!
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২২
এমএইচবি/আরইউ