হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, সুস্থ হৃৎস্পন্দন জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। ২৫ বছর ধরে বিশ্ব হৃদয় সংস্থার উদ্যোগে ২৯ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে ওয়ার্ল্ড হার্ট ডে বা বিশ্ব হৃদয় দিবস।
হৃদরোগ কেন হয়
বর্তমানে সারা বিশ্বে মৃত্যুর একক কারণ হিসেবে শীর্ষস্থান দখল করে আছে হৃদরোগ।
বাংলাদেশেও এই পরিস্থিতি ভয়াবহ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, ধূমপান ও তামাক সেবন, মদ্যপান, স্থূলতা, ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ ও উদ্বেগ—এগুলো সবই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ানোর প্রধান কারণ।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ফাস্ট ফুডের প্রতি আসক্তি এবং নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে।
ধরন
হৃদরোগ বেশ কয়েক ধরনের হতে পারে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগের শুরু রক্তনালি শক্ত ও সরু হয়ে যাওয়া থেকে, যার একটি বড় কারণ রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল থাকা। এ ছাড়া হৃৎস্পন্দনজনিত সমস্যা, জন্মগত ত্রুটিও হতে পারে হৃদরোগের কারণ।
রক্তনালি সরু হয়ে দেখা দেয় করোনারি আর্টারি ডিজিজ, যা থেকে হতে পারে হার্ট ফেইলিউর বা কার্ডিওমায়োপ্যাথি।
হৃৎস্পন্দনজনিত সমস্যা থেকে হতে পারে অ্যারিদমিয়া, জন্মগত ত্রুটি থেকে ভালভের সমস্যা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও বেশ কয়েক রকমের হৃদরোগ দেখা দিতে পারে।
প্রতিরোধে করণীয়
মনে রাখতে হবে, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে হৃদরোগ প্রতিরোধযোগ্য। কিছু সহজ কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে হৃদয়কে সুস্থ রাখা যায়, যেমন—
সুষম ও হৃদয়ের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : খাদ্যতালিকা থেকে অতিরিক্ত লবণ, চিনি, ভাজাপোড়া ও প্রক্রিয়াজাত মাংস বাদ দিতে হবে। এর বদলে খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তাজা শাক-সবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার, ওমেগা-৩ যুক্ত মাছ এবং সম্পূর্ণ শস্য।
নিয়মিত শারীরিক কসরত : সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন ৩০ মিনিট হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা বা যেকোনো ব্যায়াম হৃদযন্ত্রকে সক্রিয় ও শক্তিশালী রাখে।
ধূমপান ও তামাক পরিহার : ধূমপান ত্যাগ করার কয়েক মাসের মধ্যেই হৃদরোগের ঝুঁকি কমতে শুরু করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ ও রক্তচাপ পরীক্ষা : স্থূলতা এড়িয়ে চলা এবং নিয়মিত রক্তচাপ, রক্তে শর্করা ও কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি। দেহের অতিরিক্ত ওজন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ানোর প্রধান কারণ।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ : যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম এবং পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানো, যা আপনার মানসিক প্রশান্তি আনে সেসব কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে।
হৃদরোগ নির্ণয়
হৃদরোগ নির্ণয়ে চিকিৎসক সরাসরি রোগীকে পরীক্ষা করতে পারেন। তবে বেশির ভাগ সময়ে এনজিওগ্রাম, ইকো কার্ডিওগ্রাম, এমআরআই, সিটি স্ক্যানের পাশাপাশি কিছু রক্ত পরীক্ষারও প্রয়োজন হয়ে থাকে।
চিকিৎসা
বাংলাদেশেই এখন সব ধরনের হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে, হৃদরোগ ধরা পড়লেই দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। হৃদরোগের চিকিৎসায় ওষুধ, স্টেন্টিং বা অন্যান্য ইন্টারভেনশন ডিভাইস অস্ত্রোপচারের (বাইপাস সার্জারি/ভালভ সার্জারি) মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসার প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা হতে পারে।
বিশ্ব হৃদয় দিবসের তাৎপর্য
বিশ্ব হৃদয় দিবসে আসুন আমরা সবাই নিজেদের হৃদয়ের প্রতি আরো যত্নশীল হই। পরিবার, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সুস্থ জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করি। মনে রাখবেন, একটি সুস্থ হৃদয়ই হলো একটি সুস্থ, সক্রিয় ও প্রাণবন্ত জীবনের চাবিকাঠি।
বিশ্ব হৃদয় দিবস আমাদের অনুপ্রাণিত করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে হৃদযন্ত্রের যত্নের দায়িত্ব নেওয়ার। এ দিনটি শুধু নিজেকে হৃদরোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করার দিন নয়, বরং সামগ্রিকভাবে হৃদরোগ প্রতিহত করায় কাজ করার অঙ্গীকার নেওয়ার দিন।
আসুন, হৃদয়ের যত্ন নিই, প্রাণ ভরে বাঁচি, নিজের জন্য বাঁচি, সবার জন্য বাঁচি।
লেখক : রেজিস্ট্রার (কার্ডিওলজি) জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল