ঢাকা, রবিবার, ৯ ভাদ্র ১৪৩২, ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অন্যান্য

ভূমিতে ‘ডিজিটাল’ ভোগান্তি

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৪৫, আগস্ট ২৪, ২০২৫
ভূমিতে ‘ডিজিটাল’ ভোগান্তি ছবি: সংগৃহীত

ভূমিবিষয়ক সেবা সহজ করতে সরকারের চালু করা ডিজিটাল নামজারি ব্যবস্থা জনগণের জন্য এখন যন্ত্রণার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইনে আবেদন করেও মানুষকে আবার ভূমি অফিসে ছুটতে হচ্ছে, গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।

সার্ভারের ত্রুটি, অদক্ষ জনবল ও জটিল প্রক্রিয়ার কারণে জমি কেনাবেচা স্থবির হয়ে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকারের রাজস্ব আদায় ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সরেজমিন ঘুরে সেবাপ্রার্থীদের অসীম দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে।

জানা গেছে, সরকার ২০২০ সালে ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্প’ হাতে নেয়। ভূমি ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সেবাগুলো আধুনিক ও সহজলভ্য এবং দেশব্যাপী প্রধান সেবাগুলো অনলাইনভিত্তিক করার জন্য এই প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু পাঁচ বছর পরও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।

বরং সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, অনলাইনে খতিয়ান পাওয়া যায় না, ফাইল হারিয়ে যায় সার্ভার থেকে, আর ভুল হলে তা সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। ফলে মাসের পর মাস আবেদন ঝুলে থাকে।

এসব ডিজিটাল দুর্ভোগের কারণে অর্থনৈতিক সংকট তো আছেই, এমনকি মেয়ের বিয়ে, জরুরি চিকিৎসা কিংবা বিদেশযাত্রার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আটকে রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নামজারি ও খাজনা পরিশোধে ব্যাঘাত ঘটায় ভুক্তভোগীরা জরুরি সেবাগুলো থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

অনেকের বাড়ির নির্মাণকাজ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে।
রাজধানীর গুলশান, বাড্ডা, তেজগাঁও ও আশপাশের ভূমি অফিস ঘুরে দেখা গেছে, মানুষ দিনের পর দিন দৌড়ঝাঁপ করেও করতে পারছে না। অনেকে বাধ্য হয়ে দালালের শরণাপন্ন হচ্ছে। এতে সরকারি ফি থেকে কয়েক গুণ বেশি টাকা দিতে হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দেশের প্রায় সব ভূমি অফিসেই সার্ভার ডাউন হয়ে কাজ বন্ধ থাকে নিয়মিত।

কর্মকর্তাদের উপস্থিতি কম, প্রশিক্ষণের অভাব প্রকট। অনেক জায়গায় দায়িত্বে রাখা হয়েছে প্রশিক্ষণহীন কম্পিউটার অপারেটর। কেউ কেউ স্বীকার করেছেন, ‘কম্পিউটার চালাতে জানলেই হবে, আলাদা প্রশিক্ষণের দরকার নেই। ’ এর ফলে নথি আপলোডে ভুল হয়, আর তা সংশোধনের কোনো পথ নেই। এ ছাড়া পাসপোর্ট দিয়ে আবেদনের সুযোগ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন প্রবাসীরা।

তথ্য বলছে, যেসব খাত থেকে সরকার আয় করে, তার মধ্যে প্রধান হলো ভূমি। দেশে যত বেশি জমির কাজ-কারবার হয়, সরকারের তত আয়। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারের প্রধানতম আয়ের উৎসটিই দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা ডিজিটালের সুফল পাওয়ার বদলে ভোগান্তিতে পড়েছে। নামজারির একটি ফাইল আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া সম্পাদন হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আসতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। এসি ল্যান্ড অফিসে চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে গেলে দেখা যায়, সার্ভারে ফাইলই নেই। তখন দেখা দেয় নতুন জটিলতা। শুরু হয় দীর্ঘসূত্রতা।

এদিকে এসি ল্যান্ড অফিসের কার্যক্রম ডিজিটাইজেশন করা হলেও রেজিস্ট্রার অফিসে কোনো ধরনের আধুনিকায়ন হয়নি। জানতে চাইলে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার মুন্শী মোকলেছুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রেজিস্ট্রার অফিসে সব ধরনের কাজ শেষ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে এলে রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করা হয়। এখানে খুব একটা সময় লাগে না। আমাদের অফিসে ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা না থাকায় কাগজপত্র যাচাই করা কঠিন। যদি এসি ল্যান্ড অফিসের ওয়েবসাইটের তথ্য আমাদের দেখার সুযোগ থাকত তবে এটি সহজ হতো। এটি খুব জরুরি। ’

জমি রেজিস্ট্রি ও নামজারির বিষয়ে ঢাকার একাধিক ভূমি অফিস ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সরেজমিন তথ্য বলছে, অনলাইন হওয়ার পর থেকে আগের তুলনায় ভোগান্তি বেড়েছে। এর বড় কারণ হলো সার্ভার ডাউন। ফলে সঠিক সময়ে নামজারি করা যাচ্ছে না। এ কারণে দলিল করতেও বিলম্ব হচ্ছে। আগে যেখানে ম্যানুয়াল সিস্টেমে সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে সাধারণত নামজারি হয়ে যেত, এখন অনলাইনে শুধু সার্ভার ডাউনের কারণে তাতে এক থেকে দেড় মাস পর্যন্তও লেগে যাচ্ছে।

রাজধানীর রমনা সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সেবাপ্রার্থী আলাপকালে জানান, এখন যেভাবে অনলাইনে নামজারির ক্ষেত্রে ভোগান্তি তাতে মনে হচ্ছে আগেই ভালো ছিল। এ ছাড়া অনলাইন হওয়ার কারণে ভুলও হচ্ছে বেশি।

সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগের কথা স্বীকার করে সেই ভূমি অফিস ও তেজগাঁও ভূমি অফিসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনলাইনে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে এটা সত্য, তাই পুরোপুরি অনলাইন সচল না হওয়া পর্যন্ত ম্যানুয়াল সিস্টেম বন্ধ করা ঠিক হয়নি। কারণ কিছুদিন আগে প্রায় দুই মাস অনলাইনে ত্রুটির কারণে নামজারিসহ সংশ্লিষ্ট নানা কাজ বন্ধ ছিল। তাই আমরা মনে করি, ভূমির মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা অনলাইনে যে অ্যাপে কাজ করছি সেটা কতটুকু পরীক্ষিত সেটাও ভাবার বিষয় আছে। এটা আরো অনেক সময় নিয়ে গবেষণা চালিয়ে উদ্বোধন করলে বর্তমানে যে ভুলগুলো হচ্ছে তা হতো না। কারণ যেকোনো সময় বড় ধরনের হ্যাকারের কবলে পড়লে দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। ’
 
ডিজিটাইজেশনের নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্র
কাজে গতি বৃদ্ধির বদলে বিভিন্ন এলাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে ডিজিটাইজেশন পদ্ধতি। ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি সাবরেজিস্ট্রি অফিসের তথ্য বলছে, ডিজিটাল যন্ত্রণার শিকার হয়ে জমির রেজিস্ট্রি ও নামজারি অর্ধেকে নেমে এসেছে। উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিজিটাল সেবা চালু করা হলেও মানুষ ভোগান্তি এড়াতে ম্যানুয়ালি বেশি রেজিস্ট্রি করছে। দেখা যায়, ২০২২ সালে ম্যানুয়াল ১৩ হাজার ৭৩৯টি, ই-রেজিস্ট্রি ৪০২টি। পরের বছর ম্যানুয়াল ১৪ হাজার ২৬৪টি, ই-রেজিস্ট্রি ৬৯১টি। ২০২৪ সালে ম্যানুয়াল ১২ হাজার ৪১৪টি, ই-রেজিস্ট্রি ৫৪৯টি। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ই-রেজিস্ট্রি বন্ধ আছে।

এদিকে ডিজিটাল নামজারির কারণে নারায়ণগঞ্জ জেলার সব কটি সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা গেছে। কালের কণ্ঠ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার দুটি সাবরেজিস্ট্রি অফিসের চার বছরের দলিল সম্পাদনের পরিসংখান হাতে পেয়েছে। এতে দেখা গেছে, যখন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে দলিল সম্পাদন করা হতো তখন দিনে ১৫০ থেকে ২০০টি দলিল হতো। আর এখন সম্পাদন হয় দিনে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি। এর বেশির ভাগই হেবানামা দলিল ও পাওয়ারনামা দলিল। সাফকবলা দলিল একেবারেই কম হয়। এ তথ্যগুলো জানিয়েছেন রূপগঞ্জ পূর্ব সাবরেজিস্ট্রি অফিসের নকলনবিশ আনোয়ার জাহিদ পাবেল এবং পশ্চিম সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মোহরা আছিয়া আক্তার লিপি।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, রূপগঞ্জ পশ্চিম সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ২০২২ সালে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৫টি। পরের বছর ডিজিটাল হতেই তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৮০২টিতে। ২০২৪ সালে আরো কমে ১৪ হাজার ৩২৯টি। চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত রেজিস্ট্রি হয়েছে মাত্র চার হাজার ২৪৫টি।

এ ছাড়া রূপগঞ্জ পূর্ব সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ২০২২ সালে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে যেখানে কাজ হয়েছে ২২ হাজারটি, সেখানে পরের বছর ডিজিটালে হয়েছে মাত্র ১০ হাজার ৯টি। ২০২৪ সালে ৯ হাজার ৪৫টি এবং চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত তিন হাজার ৮৯০টি।

এদিকে গাজীপুরের রেজিস্ট্রার মো. মিজানুর রহমান জানান, ডিজিটাল নামজারির জমাভাগ দিয়ে কী পরিমাণ দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে, সে বিষয়ে তাঁর অফিসে কোনো তথ্য নেই।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সাবরেজিস্ট্রি অফিসে যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য মেলেনি। কর্মকর্তারা জানান, এ ধরনের তথ্যগুলো আপডেট করা থাকে না।
 
রাজধানীর ভূমি অফিসগুলোতে যা দেখা গেল
অতি সম্প্রতি তেজগাঁও ভূমি অফিসে গিয়ে দেখা যায়, কর্মকর্তাদের অনেকেই অনুপস্থিত। এ সময় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার আনোয়ার হোসেন (৬০) জানান, ২০২৩ সালে অনলাইন নামজারির সময় তাঁর নামে অন্যদের জমি এবং অন্যদের নামে তাঁর জমি নামজারি হয়ে গেছে। দুই বছর ধরে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা ঘুরেও এর কোনো সমাধান তিনি পাননি। সর্বশেষ ঢাকায় এসেও তিনি কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না।

শরীয়তপুরের জাজিরার এলহাম হোসেন একই ধরনের অভিযোগ করেন। তিনি বাবার জমির খারিজের আবেদন করলেও সেটি তাঁর নিজের নামে হয়ে গেছে। স্থানীয় অফিস ও হটলাইনে (১৬১২২) সাড়া না পেয়ে তিনি ঢাকায় এসে দফায় দফায় অপেক্ষা করছেন সংশোধনের জন্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের পরিচালক ও যুগ্ম সচিব মো. পারভেজ হাসান বলেন, ‘নানা কারণে এমন সমস্যা হতে পারে। আমি নতুন দায়িত্বে এসেছি, দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছি। ’

এদিকে গুলশান ভূমি অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অনেকে দিনের পর দিন ঘুরেও কাজের অগ্রগতি পাচ্ছে না। সার্ভারের অজুহাতে সেবাপ্রার্থীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শাখাওয়াত নামের এক সেবাগ্রহীতা বলেন, ‘বনানীর দুটি ফ্ল্যাটের নামজারির জন্য সরকারি ফি দুই হাজার ২০০ টাকা হলেও আমাকে প্রায় ১৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। বেশি টাকা না দিলে কাগজ পড়ে থাকে। ’

ভাটারার সুমন হোসেন জানান, তিন মাস ধরে খাজনা দিতে পারছেন না। অনলাইন সার্ভারে জমির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

সাইফুল নামের একজন বলেন, পড়াশোনা করতে ছেলেকে বিদেশ পাঠাবেন। সে কারণে জমি বিক্রির চেষ্টা করছেন। কিন্তু কাগজপত্র হালনাগাদ করতে পারছেন না বলে জমি বিক্রি করতে পারছেন না তিনি।

ভূমি অফিসে ঘুরতে আসা এক সেবাগ্রহীতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যদি সার্ভার ঠিক থাকে তাহলে ৮০ শতাংশ কাজ সময়ে করা যায়। কিন্তু সার্ভার না থাকলে ৮০ শতাংশ কাজই আটকে যায়। ’
 
অনলাইনে ফাইল না থাকার ভোগান্তি গ্রামেও
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, নামজারি ও খতিয়ান সংশ্লিষ্ট অনলাইন সেবায় ভোগান্তির শেষ নেই। আবেদন করে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও অনেকেই পাচ্ছে না শুনানির নোটিশ বা চূড়ান্ত খতিয়ান।

সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের নুরুন্নবী নামজারির জন্য সব নথি জমা দিয়েছিলেন ভূমি অফিসে। কিন্তু দুই মাস অপেক্ষার পর জানতে পারেন যে তাঁর কোনো ফাইলই নেই। পরে আবার নতুন করে আবেদন করতে বাধ্য হন তিনি।

সোনাইছড়ির বাসিন্দা মো. সোলেমান অভিযোগ করেন, ‘৮-৯ মাস ধরে অফিসে গেলেই বলা হয়েছে সার্ভার ডাউন। এভাবে সময় চলে যাচ্ছে, কাজ হচ্ছে না। ’

মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের জাহেদ হোসেন জানান, তাঁর বাবার মৃত্যুর পর ওয়ারিশদের নামে সম্পত্তি নামজারি করতে গিয়ে অনলাইনে কোনো খতিয়ান খুঁজে পাননি। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন করতে হয়েছে। এতে অতিরিক্ত সময়, খরচ ও ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘অনলাইন হওয়ার পরও যদি হয়রানির শিকার হতে হয়, তাহলে অনলাইন করে লাভ কী হলো? আগের পদ্ধতিই তো ভালো ছিল। ’

এ উপজেলার দলিল লেখক ওমর ফারুক ভূঁইয়া বলেন, ‘অনলাইন হওয়ার ফলে মানুষ এখন আরো বেশি সমস্যায় পড়ছে। সার্ভারে নিয়মিত ত্রুটি দেখা দেয়। তা ছাড়া খাজনা পরিশোধেও জটিলতা বেড়েছে। ’

এদিকে ডিজিটাল দুর্ভোগের কারণে বিভিন্ন এলাকায় লেনদেন স্থবির হয়ে পড়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রতিটি এসি ল্যান্ড কার্যালয়ে পুরনো সফটওয়্যারের কার্যক্রম বন্ধের কারণে গড়ে দেড় থেকে তিন হাজার পুরনো নামজারি, পরচা ও খাজনা পরিশোধের আবেদন মীমাংসা করা যাচ্ছে না। নতুন সফটওয়্যারে এসব আবেদন মীমাংসার সুযোগ রাখা হয়নি।

রূপগঞ্জ পূর্ব ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে এখানে মাত্র ৫১ লাখ ৬৯ হাজার ৯১০ টাকার খাজনা আদায় হয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় রাজস্ব আয়ে বিশাল হ্রাস ঘটেছে। অন্য ভূমি অফিসগুলোরও অবস্থা একই রকম।

রূপগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসের অফিস সহকারী ফয়সাল আহম্মদ বলেন, ‘ডিজিটাল দুর্ভোগের কারণে জমি বেচাকেনা প্রায় চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। সরকারের রাজস্ব কমেছে। ’

দলিল লেখক মফিজুর রহমান যোগ করেন, ‘আগে দিনে আট থেকে ১০টি দলিল করতে পারতাম। এখন সারা দিনে, এমনকি দু-তিন দিনে বড়জোর একটিমাত্র দলিল হয়। এ সমস্যার মূল কারণ ডিজিটাল ব্যবস্থার ব্যর্থতা। ’
 
অদক্ষ কর্মী দিয়ে চলছে সার্ভার
ঢাকার উপকণ্ঠ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভূমি অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, অদক্ষ কর্মীদের কারণে কিভাবে মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। যদিও স্থানীয় কর্মকর্তাদের দাবি বা অজুহাত সার্ভারকে ঘিরে। নতুন আপডেটের কারণে পুরনো তথ্য ঠিকমতো প্রদর্শিত হচ্ছে না বলে দাবি তাঁদের।

রূপগঞ্জ পূর্ব ভূমি অফিসের ভারপ্রাপ্ত নামজারি সহকারী ও নাজির কাম ক্যাশিয়ার ইমরান হোসেন বলেন, ‘মাঝেমধ্যে সার্ভার ডাউন থাকে। আগের চেয়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবু অনেক সময় এরর আসে। সমস্যার জন্য আমাদের কিছু করার নেই। ’

পশ্চিম ভূমি অফিসের নামজারি সহকারী ঝর্ণা আক্তার বলেন, ‘নামজারি করতে প্রায় ২৮ দিন সময় লাগে। সার্ভারের সমস্যার কারণে আরো দেরি হয়। নতুন সার্ভার আপডেটের পর পুরনো রেকর্ডগুলো ঠিকমতো আসছে না। ’
রূপগঞ্জ পূর্বের রাহিম মিয়া এবং পশ্চিমের মো. পলাশ স্বীকার করেছেন, তাঁরা কোনো অফিশিয়াল পদ বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করছেন।

কায়েতপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কম্পিউটার অপারেটর জিসান বলেন, ‘ঠিকমতো কাজ করা যায় না। সার্ভার প্রায় সময়ই ডাউন থাকে, ভোগান্তির শেষ নেই। ’

সীতাকুণ্ড সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমরা যে সার্ভারে কাজ করি তা শতভাগ উপযুক্ত নয়। সক্ষমতা প্রায় ৮০ শতাংশ হওয়ায় কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এই অফিসের কেউ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। ’
 
ডিজিটাল ভুলে হতাশা, তিনবার আবেদনেও সেবা মেলেনি
সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নের মাদামবিবিরহাটের বাসিন্দা মীনা আক্তার চার দাগের ১২ শতক জায়গার নামজারির জন্য অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। আবেদনকালে তিনি চারটি দাগ উল্লেখ করেছিলেন।

তবে শুনানিতে দেখা যায়, চারটি দাগের মধ্যে একটি দাগে তাঁর সম্পত্তি নেই। অনলাইন সিস্টেমে একবার ভুল হওয়ায় ভূমি অফিস আবেদনটি বাতিল করে দেয়। মীনা বারবার অনুরোধ করলেও অনলাইনে আবেদন সংশোধনের সুযোগ নেই বলে জানিয়ে পুনরায় সঠিক তথ্য দিয়ে আবেদন করতে বলা হয়।

ফলে একই জায়গার জন্য তিনবার আবেদন করতে হয় মীনাকে। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল হওয়ায় সেবা সহজ হবে বলে সবাই বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে এখন আরো বেশি জটিল হয়ে গেছে। সমস্যার কোনো সমাধান নেই। ’
 
পাসপোর্ট ছাড়া আবেদন না হওয়ায় বিপাকে প্রবাসীরা
মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নের দুয়ারু গ্রামের মৃত আবুল খায়েরের পুত্র সৌদি আরব প্রবাসী মোহাম্মদ হাছান বলেন, ‘প্রবাস থেকে দেশে এসে টাকার সংকটে পড়ে ৫ শতক জমি বিক্রির জন্য বায়না করি। কিন্তু অনলাইন সিস্টেমের কারণে জন্ম নিবন্ধন ও এনআইডি না থাকায় জমি ক্রেতার নামে রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। পরে ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করি। ভোটার হওয়ার কাজ সম্পন্ন হলেও জমি বিক্রি এখনো সম্ভব হচ্ছে না। ’

একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি পার্শ্ববর্তী সীতাকুণ্ডের মানুষও। এখানকার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পাসপোর্ট দেখিয়ে নামজারি করার কোনো সুযোগ নিয়মে নেই। আমাদের কাছে জন্ম নিবন্ধন বা এনআইডি ছাড়া নামজারি করার কোনো বিকল্প নেই। অনেক সময় এতে মানুষ বিরক্ত হয়। ’

 
দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বয়ান

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণে ডিজিটাল জরিপ পরিচালনা প্রকল্পের পরিচালক যুগ্ম সচিব মো. শেখ শাফায়াত মাহবুব চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি ডিজিটাল জরিপের আওতায় পুরো ভূমি ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে আসতে। এরই ধারাবাহিকতায় আশা করছি, পাঁচটি জেলায় প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করতে পারব। ’

ভূমি বিশেষজ্ঞ ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব (অব.) শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী কালের কণ্ঠকে বলেন, ভূমি অফিসে সমস্যা থাকলেও নাগরিকদের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন এবং দালালদের সঙ্গে সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে।  

নামজারি ও ট্যাক্স পরিশোধে সাময়িক সমস্যার বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। বর্তমানে সার্ভার আপডেট প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং খুব শিগগির সব সমস্যার সমাধান হবে। সফটওয়্যার একীভূতকরণের মাধ্যমে আগের ম্যানুয়াল সিস্টেমগুলোকে আরো উন্নত করা হয়েছে।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।