সিলেট : ‘ইউনিপেটুইউ-জ্বরে কাঁপছে সিলেট। নগদ টাকা বিনিয়োগ করলেই দ্বিগুণ লাভ, অনলাইনে মার-মার কাট-কাট ব্যবসা---এমন হরেক কথা ঘুরছে ফিরছে মানুষের মুখে মুখে।
সহজ সরল মানুষজন লাখ লাখ টাকা জমা দিচ্ছেন ইউনিপেটুইউ’র নিজস্ব অ্যাকাউন্টে। এরপর ব্যাংকের ডিপোজিট স্লিপ নিয়ে ছুটছেন তারা কথিত এজেন্টদের আস্তানায়। সেখানে স্লিপের বিপরীতে তারা অনলাইনে ইউনিপেটুইউ’র সদস্যভুক্ত হচ্ছেন, হাতে পাচ্ছেন শুধু সদস্য নাম্বার ও পাসকোড। এতেই আলাদীনের চেরাগ হাতে পাওয়ার খুশি মনে ফিরছেন বাড়িঘরে।
টাকা বিনিয়োগ করে দ্বিগুণ লাভ আর ঘরে বসেই মোটা অংকের অর্থ আয়—এমন লোভনীয় অফার দিয়ে শহর-গ্রাম জুড়ে হুলস্থূল ব্যবসা ফেঁদে বসেছে ইউনিপেটুইউ বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠানটি। মালয়েশিয়াভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠান নিজেদেরকে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে সোনা বেচাকেনার ব্যবসা করে এবং বিপুল লাভের একটি অংশ সদস্যদের মাঝে বিতরণ করে থাকে বলে প্রচার করে বেড়াচ্ছে।
ইউনিপেটুইউ’র দায়-দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ নেই বাংলাদেশে। তবে প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী হিসেবে দেশ থেকে যাবতীয় অর্থ সংগ্রহ ও তা মালয়েশিয়ার কর্পোরেট কার্যালয়ে পাঠানোর দায়িত্ব পালন করে থাকে ইউনিপেটুইউ-বাংলাদেশ লি. নামের একটি সংস্থা। ইউনিপেটুইউ-বাংলাদেশ লি. কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ, লেনদেন, অন্যদেশে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনোরকম ছাড়পত্র বা অনুমোদন নেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করেনি। একটি সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স, জয়েন্ট স্টক কোম্পানির একটি নিবন্ধন (নং-সি-৮০০৫৩/০৯) ও আমদানিকারক (নিবন্ধন নং-০১৯৮৪২৫) হিসেবে প্রতিষ্ঠানের নাম লিপিবদ্ধ করাই তাদের মূল পুঁজি।
দেশজুড়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের প্রতিষ্ঠান ‘ইউনিপেটুইউ-বাংলাদেশ লি. এর স্থায়ী ঠিকানা/রেজিস্টার্ড অফিস হিসেবে দেখানো হয়েছে ফরিদপুর জেলার পূর্ব খাবাশপুর এলাকার ‘নবীনা’ নামের বাড়িটিকে। তবে বর্তমান যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ঢাকার ৮/২ পরীবাগ (৬ তলা), মোতালিব টাওয়ার, রুম নং-৫/সি, হাতিরপুল ঠিকানা।
সিলেট জুড়ে মাতামাতি
ইউনিপেটুইউ’র কথিত সোনা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ সংগ্রহের নামে সিলেটজুড়ে সীমাহীন মাতামাতি শুরু হয়েছে। মাত্র ১১ মাসেই অনলাইন ব্যবসার ফাঁদে আটকে পড়েছেন এ অঞ্চলের সাড়ে সাত লাখের বেশি মানুষ। সহজ সরল মানুষজন বিনা পরিশ্রমে দ্বিগুণ লাভের লোভ সংবরণ করতে পারছেন না যেন। শুধু যে নিরীহ, অর্ধশিক্ষিত বাসিন্দারাই ইউনিপেটুইউ’র অনলাইন ব্যবসায় মাতামাতি করছে তা নয়, শিক্ষিত অনেকেই যুক্ত হয়েছেন এর সঙ্গে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান থেকে শুরু করে ব্যবসায়ি সমিতির কর্মকর্তা, আইনজীবী, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকমন্ডলীও দলে দলে হাজির হয়েছেন ইউনিপেটুইউ’র ব্যবসার ফাঁদে।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদ খানের সঙ্গে কথা হয় সিলেট নগরীর আম্বরখানা এলাকায়। নিজেকে ইউনিপেটুইউ’র একজন সফল এজেন্ট হিসেবে দাবি করে মাহমুদ বলেন, ‘বিনিয়োগের বিপরীতে শুধু দ্বিগুণ লাভের কথা ভাবিনি- আমি বুদ্ধি খাটিয়ে আরো কিছু সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে অনলাইন ব্যবসাও করছি। ’
গত জুলাই মাস থেকে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা তার আয় হচ্ছে বলেও দাবি করেন মাহমুদ। তিনি জানান, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এ প্রতিষ্ঠানটিতে যুক্ত হচ্ছেন ঘরে বসে বাড়তি অর্থ উপার্জনের আশায়। মাহমুদ খান স্বীকার করেন, কোনো কারণে ইউনিপেটুইউ যদি অনলাইন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়-তাহলে লাখ লাখ গ্রাহক মুহূর্তেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বেন। কারণ, টাকা জমা দেওয়া হলেও দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তিকে তারা কেই চেনেন না, জানেন না। লাখ লাখ টাকা যে বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার কোনো প্রমান থাকছে না গ্রাহকদের কাছে।
সিলেট নগরীর অলিগলিতে অসংখ্য এজেন্ট আর আইডি নম্বরধারী গ্রাহকের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন মার্কেট, বাসা-বাড়ি, অফিসের পাশে রুম নিয়েই শুরু করা হয়েছে ইউনিপেটুইউ’র টাকা সংগ্রহকারী জোটানোর কাজ। কোথাও এজেন্টের অফিসে বা বাইরে চোখে পড়ার মতো কোনো সাইনবোর্ড দেখতে পাওয়া যায়নি। মূল এজেন্টদেরও কাউকে পাওয়া যায়নি তাদের অস্থায়ী কার্যালয়গুলোতে। সেসব কার্যালয়ে শত শত দালালদের ভিড় দেখা গেছে শুধু। সিলেট জল্লারপাড় ১১ ওয়েস্টগেট ভবনের নিচতলায় চার রুমের এজেন্ট অফিস। সেখানে শতাধিক লোকের হরদম আসা-যাওয়া চলছে। নিয়ম কানুন জেনে টাকা জমা দিতে ছুটছে তারা সিটি ব্যাংকে।
ওই এজেন্ট কার্যালয়ে ঢুকতেই তিন-চার জন দালাল এগিয়ে বাংলানিউজ প্রতিবেদককে চটজলদি তাদের মাধ্যমে সদস্য হওয়ার অনুরোধ জানান। নানা রকম লাভের লোভ দেখিয়ে মাত্র ১২০ ইউএস ডলার জমা দিয়ে সদস্য আইডি নেওয়ার সব বন্দোবস্তোও করে দেন তারা। সিটি সেন্টারের ৮ তলায় আইডি-বি-৮১৯১৬৪১ নম্বরধারী এজেন্টের দুই সহকারী নিজেদের টাকাতেই সদস্য বানিয়ে দেওয়ারও উদ্যোগ নেন। এতে তাদের লাভ কি জানতে চাইলে মারুফ হোসেন নামে একজন এজেন্ট সহকারী জানান, একজন সদস্য ভর্তি করা গেলে তার জমা দেওয়া বিনিয়োগের টাকা থেকে একটি অংশ তিনি কমিশন হিসেবে পাবেন। এভাবে অর্ধ শতাধিক সদস্য অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তরুণ মারুফ হোসেন এখন প্রতিদিন ২১/২২ হাজার টাকা কমিশন তুলতে পারছেন বলেও তিনি বাংলানিউজের কাছে দাবি করেন।
সিটি ব্যাংকে আলাদা বুথ
সিলেট জুড়ে ইউনিপেটুইউতে টাকা বিনিয়োগের যে সীমাহীন মাতামাতি চলছে তার প্রমান মিলে নগরীর জিন্দাবাজার এলাকার সিটি ব্যাংক শাখায় গেলেই। কানিজ প্লাজার ২য় তলায় এ ব্যাংক শাখায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দীর্ঘ লাইন দেখতে পাওয়া যায়। ব্যাংকে ইউনিপেটুইউতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী শত শত মানুষের ভিড়ে সাধারণ গ্রাহকরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ব্যাংক কর্মকর্তা কর্মচারীদেরও গলদঘর্ম অবস্থা। সাধারণ গ্রাহকদের ঝামেলামুক্ত রাখতে সিটি ব্যাংকের ভিতরে ইউনিপেটুইউ’র টাকা জমা নিতে আলাদা দুটি বুথ ও কর্মকর্তাকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই বুথ দুটিতে দিনভর শুধু বিনিয়োগের টাকা গ্রহণ করে ডিপোজিট স্লিপ দেওয়া হয়।
সোমবার সকাল সাড়ে ১১ টায় সিটি ব্যাংকের বিশেষ বুথ সংলগ্ন লাইনে দাঁড়িয়ে কথা হয় নতুন-পুরনো বেশ কয়েকজন ইউনিপেটুইউ গ্রাহকের সঙ্গে। মাসুদুর রহমান নামে একজন এনজিও কর্মির বাড়ি দক্ষিণ সুরমা থানার পল্লীতে। গত মে মাসে একজন এজেন্টের (আইডি নম্বর-বি-০১৩) আওতায় সংস্থাটির গ্রাহক হয়েছেন তিনি। প্রথম মাসে ৪২ হাজার টাকা জমা দিয়ে জুলাই মাসেই তিনি লাভ হিসেবে ৮ হাজার ৪শ’ টাকা উত্তোলন করতে পেরেছেন। এতে বিশ্বাস বেড়ে যাওয়ায় স্ত্রী মলিনা বেগম ও মা সামসুন্নাহারের নামে আরো দুটি অ্যাকাউন্ট খুলে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জমা দিয়েছেন তিনি। প্রবাসী বড় ভাইয়ের পাঠানো তিন লাখ টাকাও ব্যাংক থেকে তুলে মাসুদ এরইমধ্যে ইউনিপেটুইউ’র একাউন্টে জমা দিয়েছেন। তবে ওই ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার বিপরীতে এখনও তিনি কোনো লাভ হাতে পাননি বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন।
সিটি ব্যাংকের টাকা জমা দেওয়া লাইনে পাওয়া যায় মুত্তালিব মিয়া নামে এক মুদি ব্যবসায়িকে। সিলেটের আলীনগর গ্রামে তার বাড়ি। স্ত্রীর সাড়ে ৪ ভরি ও মেয়ের এক ভরি ওজনের অলংকার বিক্রি করা ৯০ হাজার টাকা তিনি সোমবার ইউনিপেটুইউ’র একাউন্টটিতে জমা দিয়েছেন। তিনি বাংলানিউজকে জানান, মাস তিনেক পর থেকেই লাভ পাওয়ার আশা আছে তার। মুত্তালিব মিয়া বলেন, যদি এর মধ্যে ইউনিপেটুইউ লাপাত্তা হয়ে যায় তাহলে হায় হায় করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না তার।
সিটি ব্যাংক, জিন্দাবাজার শাখা সূত্রে জানা যায়, গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এক নোটিশে সিটি ব্যাংক শাখার ইউনিপেটুইউ-বাংলাদেশ লিঃ এর অ্যাকাউন্ট জব্দ ঘোষণার পর থেকে চলতি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ১৪৫ কোটি টাকা জমা হয়েছে। নোটিশ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হলে এ জমার পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতো বলেও মন্তব্য করছেন ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা।
বাংলাদেশের সময় : ২১২২ ঘন্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১০