ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বাঘের চেয়ে সাহসী একজন আইয়ুব

রিপোর্ট: জেসমিন পাঁপড়ি, ছবি: নাজমুল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৬ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১২
বাঘের চেয়ে সাহসী একজন আইয়ুব

শ্যামনগরের (সাতক্ষীরা) গাবুরা গ্রাম থেকে: মাস খানেক আগের ঘটনা। কাঁকড়া ধরার উদ্দেশ্যেই সুন্দরবনের গহীনে যান আইয়ুব।

সঙ্গে বড়ভাই বেলাল। এক সপ্তাহের রসদ নিয়ে সুন্দরবনের খাল ধরে এগিয়ে চলেন বনের গহীন থেকে গহীনে। তবে তৃতীয় দিনেই দুই ভাইয়ের বাড়ির জন্য অস্থির হয়ে ওঠে মন। দু`ভাই আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেন সেদিন জাল পেতে যতোটুকু কাঁকড়া পাওয়া যায় তা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গেই কাঁকড়ার অবস্থান আছে এমন একটি খাল দেখে জাল ফেলেন দুই ভাই। খাল বরাবর জালটিকে লম্বা করে ফেলে এরপর ভাটার জন্য অপেক্ষা।

শব্দটি প্রথম আইয়ুবের কানেই আসে। চেনা শব্দ, অভিজ্ঞ কান। বেলালকে বললেন, ‘ভাইরে বাঘ আসতেছে’। এই বাঘ সুন্দরবনের ঐতিহ্য মানুষখেকো বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিনটির কথাই এভাবে বাংলানিউজকে বলছিলেন আইয়ুব।

বললেন, “মুখের কথা শেষ না হতেই সামনে চলে আসে বাঘ। ”

জানালেন, ভয়কে সংবরণ করে দু’ভাই হাতের বৈঠা দিয়ে পানিতে শব্দ করতেই পথ ঘুরে চলে যায় বাঘটি।

পানিতে শব্দ করে বাঘ তাড়ানোর অভিজ্ঞতা তাদের আগেও ছিল। বনে যারা কাজ করে উপরের বর্ণনা তাদের কাছে প্রায় নিত্য দিনের চর্চা।

কিন্তু সেদিনের ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। দু`মিনিটের মধ্যে যখন বাঘটি আবার ফিরে আসে তখন বেশ অস্বাভাবিকই লাগে তাদের কাছে। এবারও বৈঠা দিয়ে পানিতে তৈরি শব্দ ও দু’ভাইয়ের চিৎকারে আবারও চলে যায় বাঘটি।

কিন্তু এবার আর নিশ্চিন্ত হতে পারেন না তারা। নৌকাটিকে একটু উপরে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বড়ভাই বেলাল বৈঠা হাতে এগিয়ে যান। নৌকার মাঝামাঝি একটা কুড়াল হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন আইয়ুব। ভাবছিলেন কী করা যায়। কিন্তু ঘাড় ফেরাতেই দেখতে পান বাঘ আবারও এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

সাহসী আইয়ুবের শক্ত হাতে কুঠার ধরা। মনে মনে ভাবছেন আসুক! কুড়াল দিয়ে ওর মাথা ভাঙবো।

কিন্তু আইয়ুবকে সুযোগ না দিয়ে প্রায় ১৫ হাত দূর থেকে লাফিয়ে আইয়ুবের উপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘটি।

ভাইয়ের চিৎকারে বেলাল ফিরে তাকান। ততোক্ষণে তার ছোটভাইটিকে নৌকার মাঝে ফেলে বাঘটি তার উপর চড়াও হয়েছে। বেলাল বুঝে ফেলেন, আদরের ভাইকে চোখের সামনেই হারাতে হচ্ছে। দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েন তিনি।

সম্বিত ফিরে পান আইয়ুবের চিৎকারে। ‘ভাই বাড়ি মার। বাড়ি মার ভাই!’

এবার বেলাল যেন নিজের হাতে থাকা বৈঠার অস্তিত্ব টের পান। ভাইয়ের কথামতোই বৈঠা দিয়ে আঘাত করেন বাঘটির মাথায়।

কিন্তু এক আঘাতেই দু’ভাগ হয়ে যায় বৈঠা। কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না তিনি।

তখনও যুদ্ধ চলছে বাঘ ও বাঘের চেয়ে সাহসী আইয়ুবের সঙ্গে। বুদ্ধি করে নিজের পা দিয়ে বাঘের দুটি পা নৌকার বাইরে ঠেলে দিলেন তিনি। বেলালের আঘাত ও আইয়ুবের প্রতিরোধে বাঘটি আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। আইয়ুবের পিঠ থাবায় চেপে গলাটিকে নিজের দাঁতের মাঝে আনার চেষ্টায় মরিয়া তখন।
 
এদিকে আইয়ুব নিজের মাথাটিকে রক্ষা করতে হাতের কনুই উঁচু করে ধরেন। বাঘের কামড় বসে যায় সে কনুইয়ে।

জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তখনও আইয়ুবের চিৎকার, “মার ভাই, মার। এবার কুড়ুল (কুঠার) দিয়ে মার। ”
 
এবার বেলালের চোখ পড়ে বাঘ আর আইয়ুবের লড়াইস্থলের পাশেই পড়ে থাকা কুঠারের দিকে।
 
সমস্ত ভয়কে তুচ্ছ করে সেটা হাতে নেন বেলাল। আঘাত করেন বাঘের মাথা বরাবর।   প্রথম আঘাত লাগলো কিনা বোঝার আগেই হানেন দ্বিতীয় আঘাত।

এবার সত্যি আঘাত পায় বাঘটি। আইয়ুবকে ছেড়ে নিজের ফেরার পথ ধরে সে।

শেষ হয় বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ। প্রাণ ফিরে পান দুই ভাই।

কিন্তু এরপর যে যুদ্ধ শুরু করেন আইয়ুব তা শেষ হয়নি আজো।

বাঘের হামলায় আহত ভাইকে নৌকায় নিয়ে পাগলের মতো ছুটতে থাকেন বেলাল। বাঘের দাঁতের আঘাতে ফুটো হওয়া বেলালের হাত থেকে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। প্রায় সাত ঘণ্টা পর তারা পৌঁছান বুড়িগোয়লিনী বাজারে। অন্যান্য জেলের কাছে থাকা মোবাইলের মাধ্যমে তার পরিবার খবর পেয়ে সেখানে একটি অ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে রাখে আগে থেকেই।

থানা শহর শ্যামনগরে যখন বেলাল তার ভাইকে নিয়ে পৌঁছান তখন রাত সাড়ে আটটা।

রাতে শ্যামনগর থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দিয়ে আইয়ুবকে পাঠানো হয় সাতক্ষীরা শহরের একটি ক্লিনিকে। কিন্তু সেখানে সাতদিনে খরচ হয়ে যায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। পুরোটাই ধার করে আনে তার পরিবার। আর সম্ভব নয়- এমন ভেবে সাতদিন পর বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয় তাকে। বাড়িতেই এখন তার চলছে কবিরাজি চিকিৎসা।

আইয়ুবের মা জানান, ক্লিনিক থেকে আনার পর প্রচুর ফুলে ওঠে আইয়ুবের হাত।

কবিরাজের মতে, পচন ধরেছে ক্ষতস্থানে। সে স্থানের মাংস ফেলে দিয়ে চলছে তার চিকিৎসা। বাঘের দাঁতের আঘাতে আইয়ুবের হাতের শিরা বলতে কিছু নেই। হাতের হাড়টিও এমনভাবে ভেঙেছে যে সেটা হয়তো আর কখনো সোজা হবে না। পরিষ্কার করার প্রয়োজনে বাম হাত দিয়ে ধরে আঘাতপ্রাপ্ত হাতটি মাঝে মাঝে উঁচু করে ধরেন তিনি। নিজের ঘরের বারান্দায় শুয়ে কাটে আইয়ুবের সময়।
 
‘সারারাত যন্ত্রণায় ঘুমুতে পারি না’- বলেন আইউব। ‘পচন ধরার পর গন্ধে কেউ কাছে আসতে চায় না। নিজের ছেলেডাও কেমন পর হয়ে যাচ্ছে। কাছে আসতি ভয় পায়। ’ ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন আইয়ুব।
 
বাঘে ধরার পর সরকারি কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাব আইয়ুবের পাশে বসে থাকা তার অসহায় মা মনোয়ারা বলেন, ‘সরকারি সাহায্য কি জিনিস তাই জানি না। `

ঘূর্ণিঝড় আইলায় সব হারানো একটি পরিবার আইয়ুবদের। সে ঝড়ের পর সামান্য খাবার ছাড়া আর কিছই পায়নি তাদের পরিবার।

মনোয়ারা জানালেন, ``ছেলেরা বনে গিয়ে কাঁকড়া ধরে খানিকটা অবস্থার উন্নতি করছিলো। কিন্তু এখন ওর চিকিৎসা খরচ আর সংসার কী করে চালাচ্ছি তা আমরা জানি। কদিন পর ওর চিকিৎসার জন্য আমাকে পথে বসতে হবে। ``

নিজের সংসারের বর্ণনা দিয়ে মনোয়ারা বলেন, “১১ জনের সংসার। সবার পেট ওই বনের ওপর চলে। সেখানে না গিয়ে উপায় কী!”

মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন চার ছেলের মধ্যে মেজ ছেলে আইয়ুব বাঘের থাবায় আহত হয়ে পড়ে থাকলেও মনোয়ারা বেগমের অন্য ছেলেরা বনেই অবস্থান করছিলেন।

তারা টাকা নিয়ে ফিরলেই আইয়ুবের জন্য কবিরাজের কাছ থেকে ওষুধ আনা হবে, জানালেন তিনি।

বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে এলেও আইয়ুবরা হেরে যাচ্ছে দৈন্যর কাছে। কখনো সময়ের কাছে।

মনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে জানা যায়, আইয়ুবকে বাঘে ধরে সকাল ১১টায়। আর সে চিকিৎসা পায় রাত সাড়ে ৮টায়। ততোক্ষণে তার শরীর থেকে ঝরে যায় প্রচুর রক্ত।

সেদিন নৌকার ভেতরে এতো রক্ত জমে যে তা সেচে ফেলতে হয়েছিল। পথেই ভিজে যায় দু’টি লুঙ্গি, একটি গামছা আর একটি শার্ট।

শ্যামনগরের গাবুরা গ্রামে এখন যে আইয়ুব শুয়ে আছেন তার শরীরটিকে কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। “আগে অনেক জোয়ান তাগড়া ছিলো আইয়ুব”, বলছিলেন তার প্রতিবেশী জয়নাব।
 
দূরে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় আইয়ুবের স্ত্রীকে। ছোট্ট একটি সন্তান নিয়ে অসহায় মুখে স্বামীর অসহায়ত্বকেও বরণ করে নেওয়াই যেন তার ভাগ্য!

বাংলাদেশ সময় : ২১৫৫ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১২
জেপি/সম্পাদনা : মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ, সাইফুল ইসলাম, কান্ট্রি এডিটর. জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।