ঢাকা: “হুমায়ূন আহমেদের ওপর আমাদের আস্থা আছে। তার কাছে একটাই প্রত্যাশা, তিনি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনাটিকে এমনভাবে তুলে ধরবেন যাতে জাতির চেতনা জাগ্রত হয়।
এ কথা বলেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
রোববার বিকেলে দেশের এই সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার সঙ্গে বাংলানিউজের একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে আইন ও বিচার বিভাগের সমসাময়িক বিভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে আলাপচারিতার সূত্রপাত হয় হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ উপন্যাসকে ঘিরে।
‘দেয়াল’ প্রসঙ্গ উঠতেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনিই হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের প্রথম দুটি অধ্যায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই উপন্যাসের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে ভুল তথ্য সংশোধন করে তা নতুন করে লেখার জন্য হুমায়ূন আহমেদকে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ের পেপারবুক হুমায়ূন আহমেদকে সরবরাহ করারও নির্দেশ দেন আদালত।
মাহবুবে আলম বলেন, হুমায়ূন আহমেদকে পেপারবুক সরবরাহ করা হয়েছে তবে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দেওয়ার আগে তিনি নিজে থেকেই পেপারবুকটি সংগ্রহ করে তা দেখে নিতে পারতেন।
তিনি বলেন, “তবে হুমায়ূন আহমেদ দেশের একজন দায়িত্বশীল জনপ্রিয় লেখক, তার ওপর আমাদের আস্থা আছে, আমরা আশা করি এবার তিনি এমনভাবে তার উপন্যাসটি রচনা করবেন যাতে সাধারণ মানুষের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে যায়। ”
আবেগাপ্লুত অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলানিউজকে জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সঙ্গে ১৯৯৮ সাল থেকে তার সম্পৃক্ততা। দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা মামলার প্রক্রিয়ায় জেলা জজ পর্যায়ে ৬১ দিন, হাইকোর্টে ৬৩ দিন, তৃতীয় বিচারকের বেঞ্চে ২৩ দিন ও আওয়ামী লীগ নতুনভাবে সরকার গঠনের পর আরও ২৫ দিন শুনানি করা হয়েছে। এই সব শুনানিতে বাদী ও সাক্ষীদের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে।
মাহবুবে আলম বলেন, এর মধ্যে সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ছিলো শিশু রাসেল হত্যার ঘটনাটি। সে কাহিনী শুনে মামলার শুনানির এক পর্যায়ে আমি নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী মুহিতুল ইসলামের বক্তব্যে জানা যায় রাসেলকে যখন নিচে নামিয়ে এনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তখন সে বার বার মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিলো। এক পর্যায়ে তাকে ভিতরে পাঠানো হলো। এর পরক্ষণেই শোনা গেলো একটি গুলির শব্দ। পরে ভেতরে গিয়ে দেখা যায় রাসেলের মরদেহ। একটি চোখ বের হয়ে এসেছে। মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন। ’
“সেদিন আমি আদালতে কেঁদে ফেলেছিলাম। একজন অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে কাঁদছেন এমন দৃশ্য হয়তো অনেককে অবাক করেছে। কিন্তু আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারিনি,” বলে এই সাক্ষাৎকারের সময়ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন অ্যাটর্নি জেনারেল।
নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন, “এই রাসেল হত্যার অংশটুকু হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে যেভাবে এসেছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়, আর সে কারণেই আমি তা আদালতের গোচরে এনেছি। ”
মাহবুবে আলম বলেন, হুমায়ূন আহমেদের পাঠক লাখ লাখ মানুষ। তার মধ্যে যুবক-তরুণরাই বেশি। তাদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টিও করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এমন একজন লেখকের লেখা, যা হাজার লক্ষ পাঠক পড়বে তাতে কোনো ভুল তথ্য থাকলে তা গোটা সমাজকে প্রভাবিত করবে বলেই আমি মনে করি। ”
“আমি চাই ইতিহাসের এই বিয়োগান্তক ঘটনাটি মানুষের কাছে এমনভাবে পৌঁছাক যাতে তাদের চেতনা জাগ্রত হয়। ”
মাহবুবে আলম আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব প্রাণ ভিক্ষা চাননি। বঙ্গবন্ধুকে যখন মেরে ফেলা হয় তখন তিনিও একটি কথাই বলেন তা হচ্ছে ‘আমাকেও মেরে ফেলো। ’ আমরা চাই এই কথাগুলো উপন্যাসে সেভাবেই উপস্থাপিত হোক। ”
অ্যাটর্নি জেনারেল আক্ষেপের সুরে বলেন, ``এমন একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা তুলে ধরে এ পর্যন্ত একটি রচনাও প্রকাশিত হলো না। কেউ লিখলেন না। যা পড়ে সাধারণ মানুষ ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে। ``
হুমায়ূন আহমেদ যখন কাজটিতে হাত দিয়েছেন তখন তার কাছে প্রত্যাশা, ঘটনাটি সেভাবেই উঠে আসবে।
![atg atg](../../../images/PhotoGallery/2012May/Intervew-atg-sm20120529160600.jpg)
“মামলায় নেই এমন সব চরিত্রকেও আরো বেশি গবেষণার মধ্য দিযে ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসে নিয়ে আসতে পারেন, যা আদালতের সীমাবদ্ধতাকেও উৎরে দেবে,” বলেন মাহবুবে আলম।
খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতো ইতিহাসের ন্যক্কারজনক দুটি চরিত্রও যেনো কোনোভাবেই ইতিবাচক রূপ না পায় সেটি অবশ্যই দেখা প্রয়োজন বলে মত দেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
“আমরা আশা করি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে বিষয়গুলো যথার্থভাবে উঠে আসবে,” বলেন মাহবুবে আলম।
উপন্যাসটি লেখা শেষ হলে তা প্রকাশের আগে কী তা দেখে নেওয়া হবে? এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সাহিত্যিকের কাজের ওপর খবরদারি করার কিছু নেই। আমরা তার কাছে শুধু প্রত্যাশাই করতে পারি। আর হুমায়ূন আহমেদের চেতনা নিয়ে আমরা সবাই যথেষ্ট আস্থাবান। ”
বাংলাদেশ সময় ১০০০ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১২
এমএমকে/জেএ/ সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]