ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

“এতো কবর কার?”

আদিত্য আরাফাত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, আরশীনগর, শরীয়তপুর থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫২ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১২
“এতো কবর কার?”

আরশীনগর, সখীপুর, শরীয়তপুর থেকে: গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে/
তুমি যে কহিলা বাজানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে/ তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে/
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!...”

পল্লীকবির কালোত্তীর্ণ কবিতা ‘কবর’ এর এই ক’টি লাইন নিজের অলক্ষ্যেই মনে এসে ভিড় করলো আরশীনগর এসে। এটা ফকির লালনের আরশীনগর নয়, এই আরশীনগর ফ্লাইট লে. শাহেদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের সখীপুর।

এই আরশীনগর সব হারানো জাকির চেয়ারম্যানের গ্রাম আরশীনগর।

কবর কবিতার উল্লেখিত পংক্তিগুলোতে এক স্মৃতিকাতর দাদু তার নাতিকে বয়ান করছেন, ছেলের শবযাত্রার দৃশ্যের। একে একে পরিবারের সবাই কিভাবে ক্রমশ তাকে ছেড়ে চলে যান না-ফেরার দেশে-- তার বর্ণনায় ‘কবর’ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠককে অশ্রুসিক্ত, বেদনাবিধুর করে রাখে।

আর এখানে, এই আরশীনগরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর গর্বিত সদস্য ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শাহেদ যখন বাড়ির উঠোনে এসে চি‍ৎকার দিয়ে বলেন—

“এতো কবর কার?” তখনও কবি-বর্ণিত সেই পাথরসম মুহূর্ত সামনে এসে দাঁড়ায় যেন। আমাদের সবার সামনে- সারা দুনিয়ার সব ভাষা কেঁদে ফিরে যায় ব্যর্থতায়; কারণ শাহেদের প্রশ্নের উত্তর দিতে তারা ব্যর্থ।    

বাড়ির উঠোনে শুয়ে আছেন মা, আদরের ছোট ভাই। তার একটু দূরে ফুফু, ফুফাতো বোন। বর্তমান কর্মস্থল আফ্রিকার কঙ্গোতে শুনেছিলেন “মা মৃত্যুশয্যায়” তাই বিশেষ বিমানে ছুটে এসেছেন।

পরে জেনেছেন অনেকটাই, তবে আরশীনগর গ্রামে নিজ পরিবারের এতটা চরম আর ভয়াবহ এ ট্রাজেডি দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।

গত বৃহস্পতিবার গ্রামে এসে দেখেন সারি সারি কবর।

রোদনসিক্ত শাহেদের “এতো কবর কার?” প্রশ্নের জবাবে পাড়া প্রতিবেশীদের কেউ কিছু বলেন না। অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখ বেয়ে নীরবে গড়াচ্ছে নোনাজল।     

ওদিকে শাহেদ বুকফাটা আর্তনাদ করতে করতে বলেন, “তোমরা আমার মায়েরে এনে দাও, আমার ছোট ভাইটারে দাও। ``

আকাশে উড়ে বেড়ান শাহেদ হাসান! জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে কঙ্গোতে কর্মরত। ছেলে পাইলট হয়েছে তাই অনেক গর্ব করে মানুষকে শাহেদের গল্প শোনাতেন মা ফেরদৌসী বেগম। এই তো গত সপ্তাহেও ফোনে মা বলেছেন, “বাবা সাবধানে বিমান চালাবে, তোমার কিছু হলে মা বাঁচবো না। ”

শাহেদ তখন বলেছিলেন- “ভয় নেই মা, তোমরা সাবধানে থেকো। ” জবাবে ছেলেকে মা বলেন- “আমরা নিচে থাকি আর তোমাকে আকাশে আকাশে থাকতে হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করো তুমি...”

শোকে পাথর শাহেদ বাংলানিউজকে বলেন, “দিন কয়েক আগে মা ফোন করে বলেন, “বাবা দেশে আয়, তোকে নিয়ে গ্রামে যাবো, আম কাঁঠাল খাবো মা-ছেলে। ” শাহেদ মাকে বলেন-“গ্রীষ্মে না এলেও এরপরে আসবো মা। ”

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল পড়ুয়া ছোট সায়েম হোসেন শাহেদকে দুষ্টুমি করে বলেছে, “ভাই, বিমান নিয়ে চলে আসো। আমার গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। গ্রামে যাবো আমরা। ”
জবাবে শাহেদ বলেন, “আসবো রে পাগলা...”
শাহেদ বিশেষ বিমানে দেশে এসেছেন। পদ্মার বুক চিরে আরশীনগর গ্রামে সরদার বাড়িতে গিয়ে দেখেন শোকের মাতম।
আকাশে ওড়া পাইলট শাহেদের যেন এখন মাটির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। শোকে স্তব্ধ বিমানসেনা এখন হতবিহবল।
শাহেদের মা ও ভাইয়ের কবরের একটু দূরে আমগাছে এখনও কিছু আম ঝুলে আছে। গাছে পাকা কাঁঠাল। মা বলেছিলেন, দেশে এসে গ্রীষ্মকালীন ফল খেতে। শাহেদ একবার গাছের দিকে তাকান আরেকবার মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে বুক চাপড়ান।
সশস্ত্র বাহিনীতে যারা কাজ করেন তাদেরকে যে কোনো পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে শক্ত থাকার মত করে গড়ে তোলা হয় কঠোর প্রশিক্ষণে। কিন্তু সেখানে নিশ্চয়ই এতটা শক্ত থাকার কোনও প্রশিক্ষণ পাননি শাহেদ যাতে করে মা-ভাইসহ স্বজনদের এই বিশাল কবর-মিছিল দেখেও নির্বাক থাকা যায়!

শাহেদ নিজেকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন? কে শাহেদকে সান্ত্বনা দেবে?

grave

সখীপুর থানার আরশীনগরের পুরো গ্রাম জুড়ে কেবলই শোকের মাতম। একদিকে পাইলট শাহেদের মামা আরশীনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন সরদার স্ত্রী, মেয়ে, বোন, ভগ্নিপতি, ভাগ্নে ও ভাগ্নি হারিয়ে শোকে মূহ্যমান অপরদিকে শাহেদ মা, ছোট ভাই, ফুপু, খালাসহ স্বজনদের হারিয়ে বাকরুদ্ধ। কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন! পুরো আরশীনগরই তো এখন বুক চাপড়ে কাঁদছে। এই গ্রামের বিলাপ যেন ছড়িয়ে পড়ছে পুরো শরিয়তপুরজুড়ে।

জাকির চেয়ারম্যান শাহেদকে ধরে বিলাপ করতে করতে বলছেন, “আমারে ছেড়ে আর তুই কঙ্গোতে যাইসনে...তুই ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই...আমি ছাড়াও তোর কেউ নেই...তুই আমার ছেলে এখন...তুই আমার বাপ!”
এসময় উপস্থিত অনেকেই অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি।

আবার কঙ্গোতে কবে যাবেন? এ প্রশ্ন করতে শাহেদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন, “জানি না। জীবনের এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ”

জানা গেছে, শাহেদের মা, ছোট ভাই আর বাবাকে নিয়ে তাদের ছোট্ট সুখের সংসার ছিল। বাবা শাহেন শাহ কর্মসূত্রে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।

“বাবা কি জানেন ঘটনা?” শাহেদ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আনমনে বলেন, ``জানি না। ``

গত বুধবার ভোরে ঢাকার কেরানীগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় শাহেদদের পরিবারের ১১ জন সদস্যসহ ১২ জন নিহত হয়েছেন। গ্রীষ্মের প্রখর তাপদাহ আর ইট-কাঠ-বালুর নিষ্প্রাণ ঢাকা শহর থেকে একটু প্রশান্তির পরশ পেতে পরিবারের সবাই ছুটে যাচ্ছিলেন শরীয়তপুরের চিরচেনা গ্রাম আরশীনগরে। কিন্তু তাদের বহন করা মাইক্রোবাসটিকে বিপরীত দিক থেকে আসা সাকুরা পরিবহনের যাত্রীবাহী মুখোমুখি ধাক্কা দেয়। আর তাতেই এক ফুৎকারে আরশীনগর গ্রামের একটি পরিবারকে ঢেকে দ্যায় মৃত্যুর কফিন। আর আরশীনগর হয়ে ওঠে এক মৃত্যুর উপত্যকা। জীবনের কলহাস্য নিভে গিয়ে আকাশে বাতাসে শুধু শোকের মাতম! শুধু হাহাকার!!

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১২
এডিএ/সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর 

[email protected]
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।