ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

আইভি স্যালাইন সংকট, জিম্মি রোগ

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১২
আইভি স্যালাইন সংকট, জিম্মি রোগ

ঢাকা: জীবনরক্ষাকারী আইভি বা ইন্ট্রাভেনাস (শিরায় দেওয়া হয়) স্যালাইনের  মূল্য বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা রোগীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে আসল মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা।



বাজারে স্যালাইনের এ অস্থিরতা কাটানোর জন্যে গত রোববার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়েছে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শিগগিরই উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজার মনিটরিংয়ের জন্যে কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উৎপাদনে ঘাটতির কারণ ও বেশি দামে বিক্রির কারণও জানতে চেয়েছে অধিদপ্তর।

সোমবার সকালে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক সেলিম বারামী বাংলানিউজকে বলেন, স্যালাইন সংকটের খবর জানার পর গত রোববার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারণ জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। মূল্য বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে এবং উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মনিটরিং করতে বলা হয়েছে।

সেলিম বারামী আরো বলেন, মৌখিকভাবে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা হয়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, ঈদের সময় বেশ কিছুদিন ছুটি ছিল, এসময় উৎপাদন কম হয়েছে। এছাড়া বছরে একবার কারখানায় রিসাইক্লিং করতে হয়। এ কারণেও হয়তো উৎপাদন কম ছিল। শিগগির আগের অবস্থা ফিরে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে, ক্রমান্বয়ে গত তিন মাস ধরেই বাজারে আইভি স্যালাইনের সংকট ও দাম বেড়েছে। এর ফলে চিকিৎসা কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এ সুযোগে বিক্রেতারা দামও নিচ্ছে ইচ্ছেমতো, ৫৫ টাকার স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে এখন ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। তবে অনেক স্থানে টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না।

কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক মিলন খান সোমবার বাংলানিউজকে জানান, গত কয়েক মাস ধরেই মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত স্যালাইন ও স্যালাইন ইনফিউশন সেট সরবরাহ কমে গেছে। খুচরা বিক্রির ফার্মেসি, এমনকি মিটফোর্ডের পাইকারি দোকানেও ওষুধের সরবরাহ কম।

দেশীয় কোম্পানিগুলো চাহিদা মতো স্যালাইন বাজারে সরবরাহ না করায় এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া স্যালাইন সেটসহ অন্যান্য সামগ্রী আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে বলে তিনি জানান।

বিক্রেতারা বলছেন, গত দুই থেকে তিন মাস ধরেই এ অবস্থা চলছে। রাজধানীতে এখন কেবল শাহবাগ ও মিটফোর্ডের ওষুধবাজারেই অল্প পরিমাণে স্যালাইন মিলছে ।

মিটফোর্ড ও শাহবাগের ওষুধের বাজারসহ বিভিন্ন দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বাজারে অন্তত পাঁচ ধরনের আইভি স্যালাইনের চরম সঙ্কট রয়েছে। এগুলো হলো ডেক্সট্রোজ স্যালাইন, ডিএনএস স্যালাইন, নরমাল স্যালাইন, হেমোডাইলোসিস ফ্লুইড ও হার্টসম্যান স্যালাইন।

সোমবার সকালে শাহবাগের বিভিন্ন ওষুধ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্যালাইন ইনফিউশন সেটের সংকট রয়েছে বাজারে। ৫৫ টাকার স্যালাইন এখন ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোম্পানিগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই স্যালাইন সরবরাহ হবে বলে আশা দিচ্ছে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না।

‘পলাশ ফার্মেসি’র বিক্রেতা রাকিব বাংলানিউজকে জানান, পাঁচটি কোম্পানির স্যালাইনের চাহিদা বেশি। এগুলো হচ্ছে, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, অরিয়ন গ্রুপ, অপসোনিন, লিবরা ও পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস। কিন্তু এসব কোম্পানির স্যালাইনের সরবরাহ কমে গেছে। তাই অনেকেই বেশি মুনাফার আশায় বেশি দামে বিক্রি করছেন।

স্যালাইনের সংকট ও দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আকাশ বলেন, কোম্পানি প্রতিনিধিরা খুচরা বিক্রেতাদের বলছেন উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া রোগের প্রকোপ বেশি, কাঁচামাল সংকট, যন্ত্রপাতি নষ্টেরও ওজুহাত দিচ্ছেন তারা। আর্ন্তজাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) কলেরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চাহিদা বেড়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহাখালী জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি পর্যায়ে স্যালাইন উৎপাদনেও রয়েছে সংকট। মহাখালীর আইভি ফ্লুইড ইউনিট বর্তমানে ডেক্সট্রোজ, সলিউশনসহ বিভিন্ন ধরনের স্যালাইন জোড়াতালি দিয়ে চালানোর কারণে অবস্থা আরও চরম আকার ধারণ করছে।

সরকারি পর্যায়ে স্যালাইনের সংকটের ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাপাতালের ওষুধ বিতরণ কেন্দ্রের প্রধান সিনিয়র লেকচারার অব প্র্যাকটিক্যাল ফার্মেসির ডা. মশিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন হাসপাতালে পাঁচ ধরনের প্রায় দু’হাজার প্যাকেট স্যালাইন দরকার। সেখানে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ৬০০ থেকে ৭০০ প্যাকেট।

এদিকে মিটফোর্ড হাসপাতালেও ৩৫টি ওয়ার্ডে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ স্যালাইনের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র একশ ব্যাগ।

সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনের ছয়টি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধুমাত্র একটি দোকানে স্যালাইন রয়েছে অল্পসংখ্যক। বাকি তিনটি দোকানে গত তিন মাস ধরেই কোনো স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে না। দুটিতে গত দু’সপ্তাহ ধরেই কোন স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না।

সোমবার সকালে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিকালসের বিক্রয় প্রতিনিধি রাশিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান সময়ে আবহাওয়াজনিত কারণে রোগব্যাধির প্রকোপ বেশি। এ কারণে স্যালাইনের চাহিদাও বেশি। হয়তো কোথাও কোথাও সংকট রয়েছে, তবে দাম বাড়েনি।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বিভিন্ন ধরনের স্যালাইনে দাম বৃদ্ধির কারণে দরিদ্র রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। স্যালাইন কেনার টাকা সংগ্রহ করতে না পেরে অনেকেই বিপাকে পড়ছেন।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার মো. শিফায়েত উল্লাহকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলেছেন, স্যালাইনের সংকট যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উৎপাদিত স্যালাইন সংগ্রহ ও কেনা হচ্ছে।

ওষুধ কোম্পানির মালিকদের সংগঠন ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব আবদুল মোক্তাদির কোম্পানির কারসাজির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে আগে ও পরে প্রায় অর্ধ মাস উত্পাদন বন্ধ ছিল। পাশাপাশি রোগীও বেড়েছে। সাময়িক সঙ্কট দেখা দিতে পারে, তবে তা ঠিক হয়ে যাবে।

স্যালাইনের সংকটের প্রভাব সর্ম্পকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, পানিশূন্যতা কাটাতে ও শরীরে লবণ ঘাটতি পূরণের জন্যে আইভি স্যালাইন জীবন রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করে। এটি জরুরি অবস্থায় রোগীকে দেয়া হয়।  

অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেন, বছরের এ সময়টায় আবহাওয়াজনিত কারণে রোগব্যাধির প্রকোপ কিছুটা বেশি। ওষুধ কোম্পানিগুলোর উচিত এ সময়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা। তা না করে তারা সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। এটি উচিত নয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১২
এমএন/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।