ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সংসদীয় কমিটির তদন্ত

অনিয়মের মচ্ছব কর্ণফুলী পেপার মিলে

সাজিদুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১২
অনিয়মের মচ্ছব কর্ণফুলী পেপার মিলে

ঢাকা: অনিয়ম আর দুর্নীতির মচ্ছব চলছে কর্ণফুলী পেপার মিলে (কেপিএম)। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন আর কেনা-কাটায় অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।



জানা গেছে, ব্যালেনিং মর্ডানাইজেশন রেনোভেশন অ্যান্ড এক্সপেনশন (বিএমআর) প্রকল্প আর কেপিএম এর ব্লিচিং প্ল্যান্ট স্থাপনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এছাড়া টেবিল রোলার ক্রয় অনিয়ম, টেলকম পাউডারে যথাযথ উপাদান পাওয়া যায়নি। কাগজ উৎপাদনে ব্যবহার করা চুনাপাথর ও আর লবণেও ‘অপদ্রব্য’ পাওয়া গেছে।

শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২ নম্বর উপ-কমিটির তদন্তে এসব অনিয়ম পাওয়া গেছে। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে উপ-কমিটি। ২০০৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এ উপ-কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক মুহিবুর রহমান মানিক। প্রথম পর্যায়ে কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আনোয়ারুল আশরাফ খান ও এসএম আব্দুল মান্নান। পরে মেরাজ উদ্দিন মোল্লা ও আলী আজগরকে কমিটির সদস্য করা হয়।

উপ-কমিটি প্রায় তিনবছর ধরে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, কেপিএম ও আশুগঞ্জ সার কারখানার বিভিন্ন অনিয়ম তদন্ত করে।

বিএমআর প্রকল্প
কেপিএম এর বিএমআর প্রকল্পের ওপর বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি) একটি তদন্ত করে। পরে সংসদীয় কমিটি আরো তদন্তের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি টিম গঠন করে। ওই টিমে সংসদীয় উপ-কমিটির বাইরে বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও রসায়ন বিভাগ থেকে একজন করে মোট তিনজন প্রতিনিধি ছিলেন।

সংসদীয় কমিটি ও বিশেষজ্ঞদের তদন্তে দেখা গেছে, বিএমআর প্রকল্পে অধিকাংশ যন্ত্র পরীক্ষামূলক ব্যবহারের সময়ই নষ্ট হয়ে গেছে। এ প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত নকশাও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে।

ব্লিচিং প্ল্যান্ট এর ক্লোরিন টাওয়ার নির্মাণেও কমিটি অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। জাপানের মারুবিনি করপোরেশনের তৈরি করা এ প্ল্যান্টে স্টিলের পাইপ ব্যবহার করা হয়। পরে এগুলো নষ্ট হয়ে গেলে সেখানে গ্লাস ফাইবার ব্যবহার করা হয়। স্টিলের পাইপ ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিশেষজ্ঞ টিম।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ‘ক্লোরিন এনভায়রনমেন্ট’এ স্টিল ব্যবহার করা নিয়ে মারুবিনির প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কমিটিকে জানান, এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ভুল হয়েছে।
 
এছাড়া এ প্ল্যান্টে স্থাপন করা ওভারহেড ক্রেনের ভার উত্তোলন ক্ষমতা ১৫ টন হওয়ার কথা থাকলেও ক্রেনের গায়ে তা লেখা নেই। পরে জানা গেছে, একটির বদলে দুইটি ক্রেন দিয়ে ১৫ টন ভার উত্তোলন করা হচ্ছে। যা প্রকল্পের মূল নকশার সঙ্গে অসঙ্গিপূর্ণ।

টেবিল রোলার ক্রয়ে অনিয়ম
সংসদীয় উপ-কমিটি ও বিশেষজ্ঞ টিম কেপিএম পরিদর্শনের সময় টেবিল রোলারে কিছু অবাঞ্ছিত দাগ দেখতে পায়। পরে কেপিএমের এমডি জানান, বিমান থেকে নামানোর সময় কয়েকটি রোলার পড়ে যাওয়ায় এ রকম দাগ পড়েছে। পরে বিদেশি সরবরাহকারীর প্রতিনিধি এসে এগুলো ঠিক করে দিয়ে যায়। তবে বিশেষজ্ঞ টিম মনে করছে, এই রোলারগুলো পুরনো এবং বহুবার ব্যবহার করা।

এদিকে কাগজ তৈরিতে যে মানের ট্যালকম পাউডার ব্যবহারের কথা, তার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে বেশি গুনাগুনের পাউডার কেনা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, কাগজ তৈরিতে ফাইবার সাশ্রয় করা, কাগজকে ছিদ্রমুক্ত করা এবং কাগজের মসৃণতা বাড়াতে এ পাউডার ব্যবহার করা হয়।

এদিকে কমিটি কাগজ তৈরিতে ব্যবহার করা চুনাপাথর ও লবণে ‘অপদ্রব্য’ পেয়েছে, যা কাগজের গুনাগুন নষ্ট করবে বলে কমিটি মনে করে।

পরিদর্শন শেষে সংসদীয় কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, বিএমআর প্রকল্পটি বাস্তবতা বর্জিত। প্রকল্পের টেন্ডার ডকুমেন্ট ত্রুটিপূর্ণ। এই প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআইসি) ও শিল্প মন্ত্রণালয় চরম গাফিলতি ও উদাসীনতা দেখিয়েছে। এ প্রকল্পে ব্যবহার করা যন্ত্রপাতি পুরনো। টাকা ছাড়ের ক্ষেতে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে কমিটি এ প্রকল্পে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের প্রায় ২’শ কোটি টাকা অপচয়ের দায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সুপারিশ করেছে। এ অনিয়ম তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।

এদিকে স্থায়ী কমিটি উপ-কমিটির সুপারিশের পাশাপাশি মারুবিনি করপোরেশনের পারফরমেন্স গ্যারান্টি (পিজি) বাতিল করার সুপারিশ করেছে।

উপ-কমিটির আহ্বায়ক মুহিবুর রহমান মানিক বাংলানিউজকে বলেন, “উপ-কমিটি কেপিএম বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছে। তারপরই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এখানে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ”

সরকারি কোষাগারের ২’শ কোটি টাকা অপচয়ের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, “কমিটি মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। ”

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১২
এসএইচ/সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।