ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

প্রভাবশালীদের ভয়ে পুষ্প রানী ‘বাকপ্রতিবন্ধী’

এ কে এম রিপন আনসারী, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০১২
প্রভাবশালীদের ভয়ে পুষ্প রানী ‘বাকপ্রতিবন্ধী’

গাজীপুর: কথা বলতে পারলেও সন্ত্রাসীদের ভয়ে মুখ খোলেন না পুষ্প রানী দাস। এভাবে দীর্ঘ ‍দিন চলতে থাকায় তিনি লোকজনের কাছে ‘বাকপ্রতিবন্ধী’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হন।

এখনো তিনি ‘বাকপ্রতিবন্ধী’ হয়েই আছেন। তবে কথা বলেছেন বাংলানিউজের সঙ্গে।

সাংবাদিক, পুলিশ বা অপরিচিত কোনো লোক বাড়িতে এলে তিনি কথা বলতে পারেন না, কারণ হুমকিদাতারাও নতুন লোকদের সঙ্গে থাকেন। আগন্তুক দেখলেই পুষ্প রানীর সামনে চলে আসে প্রতিপক্ষের লোকজন। ঠিক সিনেমার মতো ঠেকলেও ব্যাপারটি সত্যি।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে পুষ্প রানীর ‘বাকপ্রতিবন্ধী’ হওয়ার প্রকৃত কারণ।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, পুষ্প রানী দাসের স্বামী গোপাল চন্দ্র দাস। বাড়ি গাজীপুর সদর উপজেলার জয়দেবপুর থানার বাড়িয়া ইউনিয়নের কুমুন গ্রাম। পৈত্রিক ও কেনা প্রায় এক বিঘা জমিতে পরিবার পরিজন নিয়ে পুষ্প রানী বসবাস করেন। ওই জমির বর্তমান মূল্য দুই কোটি টাকার ওপরে। ৪/৫ বছর আগে পুষ্প রানী একই গ্রামের লেহাজ উদ্দিনের ছেলে মোঃ সুলতান উদ্দিনের কাছ থেকে সুদে ৩০ হাজার টাকা ধার নেন। টাকা দেওয়ার সময় সুলতান উদ্দিন পুষ্প রানীর ভাই হরেকৃষ্ণর কাছ থেকে ১০ টাকা মূল্যমানের ছয়টি খালি ননজুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন। প্রায় এক বছর পূর্বে পুষ্প রানী ওই টাকা স্থানীয় নাসির উদ্দিনের ছেলে খোকন মিয়ার সামনে সুলতান উদ্দিনকে ফেরত দেন। কিন্তু স্ট্যাম্পগুলো পরে পাঠিয়ে দেবেন বলে পুস্প রানীকে ধমকা-ধমকি দিয়ে বিদায় করে দেন সুলতান উদ্দিন। অনেক ঘুরাঘুরির পর স্ট্যাম্প ফেরত না পেয়ে পুষ্প রানী জয়দেবপুর থানায় চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন, যার নম্বর ৫৭৭ দায়ের করেন।

সম্প্রতি স্থানীয় সেলিম নামে এক ব্যক্তি নিজেকে মালিক দাবি করে পুষ্প রানীর জমি দখল শুরু করেন। সংবাদ পেয়ে গাজীপুর থেকে একাধিক সাংবাদিক ঘটনাস্থলে গিয়েও প্রতিপক্ষের বাধার মুখে পুষ্প রানীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। তবে পুলিশ গিয়ে দখলকারীদের পক্ষে কথা বলেছেন বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।

বাংলানিউজের এ প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে গিয়ে পুষ্প রানীর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু সেলিম ও তার লোকজনের উপস্থিতির কারণে পুষ্প রানী ঘর থেকে বের হয়ে কিছু বলতে পারেননি। প্রতিপক্ষের রক্তচক্ষুর উপস্থিতির কারণে পুষ্প রানী বাকরুদ্ধ হয়ে যান। এক পর্যায়ে হাতে ঈশারা দিয়ে বাইরে উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিককে ঘরের ভেতরে ডাকলেন পুষ্প রানী দাস। কিন্তু সাংবাদিকরা ঘরের ভেতরে ক্যামেরা নিয়ে গেলেও মুখ দিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারেননি পুষ্প রানী। এবারও সাংবাদিকরা ভেতরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেলিমসহ কয়েকজন ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েন। ফলে পুষ্প রানী ‘বাকপ্রতিবন্ধী’ হয়ে পড়েন।

স্থানীয়রা বলছেন, পুষ্প রানী গৃহবন্দী অবস্থায় আছেন। বাইরে গেলে প্রতিপক্ষের লোকজন পুষ্প রানীর গতিবিধি অনুসরণ করেন।

ঘটনাস্থলে অনুসন্ধানে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে কাগজপত্র ও সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে সেলিমকে নিয়ে সাংবাদিকরা তার চাচা স্থানীয় বাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের বাগানবাড়িতে যান। সেখানে হাবিবুর রহমান জমিটি নিজের বলে দাবি করেন। সাংবাদিকসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসলে ভাতিজা সেলিমের বাধা সৃষ্টির বিষয়টি চেয়ারম্যানের গোচরে আনলে চেয়ারম্যান ভাতিজাকে ধমক দেন।

পুষ্প রানীর জমি নিজের দাবি করে চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, “এই সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি। পুষ্প রানীর ভাই হরেকৃষ্ণ দাস আমার কাছে পজিশন বিক্রি করেছেন। এই মর্মে প্রতিটি ১০ টাকা মূল্য মানের ৩টি ননজুডিসিয়াল  স্ট্যাম্পের (অনিবন্ধিত) ফটোকপি দিয়ে চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জমিটি নিজের বলে জানিয়ে দেন। চেয়ারম্যানের বাগান বাড়িতে উপস্থিত বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যানের ইজারা নেওয়া জমির পক্ষে সাক্ষ্য দেন। পুষ্প রানী চেয়ারম্যানকে জমির দখল বুঝিয়ে দিয়েছেন বলে সাক্ষীরা জানান।

এভাবে জমি হস্তান্তর আইন সিদ্ধ কিনা প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, “পজিশন কিনেছি। আমার নির্বাচনী প্রতিপক্ষ, পুষ্প রানী, নূরু মিয়া ও এমরান হোসেন জব্বার নামে তিন ব্যাক্তিকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করছেন। আমার ইমেজ নষ্ট করে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য প্রতিপক্ষ এগুলো করাচ্ছেন। ”

নূরু মিয়ার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “নূরু জালিয়তির মাধ্যমে এক জনের জমি নিয়েছিল। আমি জমি উদ্ধার করায় আমার প্রতি ক্ষিপ্ত। ”

এমরান হোসেন জব্বারকে খারাপ প্রকৃতির লোক বলে আখ্যায়িক করেন চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান। তিনি তার বিরুদ্ধে অপ্রচারের অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।

এ প্রসঙ্গে নূরু মিয়া বলেন, “চেয়ারম্যান আমার ভাই। নির্বাচনের সময় আমার কাছ থেকে ১৩ লাখ  টাকা নিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর ৮৩ হাজার টাকা ব্যাংক চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করেন। বাকি টাকা চাওয়ার অপরাধে আমাকে কুমুনবাজারে শত শত লোকের সামনে অমানুষিক নির্যাতন করে সমাজচ্যুত করেন। এই সংবাদ একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত হয়। ”
 
এমরান হোসেন জব্বার বলেন, “চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমার পোল্ট্রি ফার্ম বেদখল হয়েছে। রাতে পুলিশ দিয়ে হামলা করে দিনের বেলায় ট্রাকে করে গরু নিয়ে গেছেন একটি চক্র। পরে পুলিশ দিয়ে গরু উদ্ধার করা হয়। এ ব্যাপারে মামলাও হয়েছে। ”

জয়দেবপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বাচ্চু মিয়া বলেছেন, ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। অভিযোগ পেয়েছি, হয়েছে তদন্ত চলছে। ”

বাংলাদেশ সময়: ১২১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।