ঢাকা: ফতোয়াবাজির শিকার শরীয়তপুরের হেনার কথা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। জাতিসংঘ শিশু সনদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৪ বছরের হেনা ছিল একজন শিশু।
গত ১৩ অক্টোবর শনিবার গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে এক নারীকে নির্যাতনের পর সালিশ বসিয়ে তাকে গ্রাম ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় মাতবররা। এর আগে তাকে বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দফায় নির্যাতন করার ফলে তাকে গাইবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।
এভাবেই গ্রামে-গঞ্জে এখনো স্থানীয় মাতবরদের হাতে সালিশের নামে ফতোয়াবাজির শিকার হয়ে নির্যাতিত হচ্ছেন নারীরা। অথচ দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন, ‘শিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য আলেমরা ফতোয়া দেবেন। ফতোয়া গ্রহণের বিষয়টি হতে হবে স্বত:স্ফূর্ত। ফতোয়ার মাধ্যমে কারও সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা যাবে না এবং ফতোয়ার নামে গ্রাম্য সালিশে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। ’
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওই রায়ে ফতোয়ার নামে ‘শারীরিক ও মানসিক কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে না’ বলে বলা হলেও এ রায় ও নির্দেশনা কেউ মানছেন না। নারী অধিকার সংগঠক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামে-গঞ্জে গ্রাম্য সালিশের নামে ফতোয়াবাজি ও এর মাধ্যমে নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাবেরী গায়েন তার এক লেখায় বলেছেন, ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহীর তানোরে ভিক্ষুক ওমর আলীর স্ত্রী সুফিয়ার দোররায় মৃত্যু, ৩১ মে সিলেটের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কমলা বেগমকে ১০১ দোররা মারা, ২১ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক তরুণীকে ১০১ দোররা মেরে গ্রামছাড়া করা, ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর আয়েশা নামের এক নারীর ৫০০ দোররার শিকার হওয়া, ১ সেপ্টেম্বর দুপচাঁচিয়ায় এক গৃহবধূকে দোররা মারা, পত্মীতলায় গ্রাম্য সালিশে ১০১ দোররা মারার ঘটনা সাম্প্রতিককালে ফতোয়ার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
অপরদিকে, ২০১১ সালে ফতোয়ার শিকার হয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের ৫৮ জন নারী।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে নির্যাতনের শিকার ওই নারী জানান, বুধবার রাতে প্রতিবেশী এক যুবক তার বাড়িতে এলে তার সঙ্গে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ তোলেন মাতবররা। তিনি জানান, রাতেই তাদের দু’জনকে পাশের ভগবানপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে হাত-পা বেঁধে পেটানো হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে সালিশ বসিয়ে তিন দিনের মধ্যে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ঘটনা জানার পর তার ওপর নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছিলেন পলাশবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কোরবান আলী। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত এ ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো অগ্রগতির কথা জানা যায়নি।
২০০১ সালে গ্রাম্য মাতবরদের ফতোয়া দেওয়াকে হাইকোর্ট নিষিদ্ধ করেন। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বেঞ্চ ফতোয়াকে অবৈধ ও কর্তৃত্ব বর্হিভুত বলে রায় দেন।
রায়ে বলা হয়, ‘একমাত্র আদালতই আইন সংক্রান্ত প্রশ্নে মতামত দিতে পারবেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। ’
ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে তা নয় বছর আটকে থাকে।
ফতোয়া নিয়ে ওই আপিলের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ঐতিহাসিক রায় দেন ২০১১ সালের ১২ মে। সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ে ফতোয়া বৈধতা পায়, তবে ‘এর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে না’ বলে বলা হয়। আপিলের পর সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৬ বিচারকের বেঞ্চ এ রায় দেন।
২০০১ সালে দেওয়া ‘সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ’ বলে যে রায় দেওয়া হয়, সেই রায়ের বিরুদ্ধে দু’জন আলেমের দায়ের করা রিটের ভিত্তিতে ওই রায় স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
এরপর শরীয়তপুরের হেনার মৃত্যু হলে উচ্চ আদালতে সেই রিটের শুনানি হয়। মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে মোট নয় দিন শুনানি শেষে ১২ মে আপিল বিভাগ ফতোয়া বৈধ বলে ঘোষণা করেন।
একই সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত রায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয় যে, শিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য আলেমরা ফতোয়া দেবেন। ফতোয়া গ্রহণের বিষয়টি হতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত। ফতোয়ার মাধ্যমে কারও সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা যাবে না এবং ফতোয়ার নামে গ্রাম্য সালিশে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
আপিল বিভাগের ওই শুনানিতে ৫ জন আলেম এবং আমিকাস কিউরি হিসেবে টিএইচ খান, রফিক উল হক, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, মাহমুদুল ইসলাম, এম জহির, এবিএম নুরুল ইসলাম, এএফ হাসান আরিফ, তানিয়া আমীর এবং এমআই ফারুকীর বক্তব্য শোনেন আদালত।
রায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আমি এ বিষয়ে এখনই কিছু বলবো না। যখন পূর্ণাঙ্গ রায় বের হবে, তখন কথা বলবো। এখন এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না। ’’
‘’আপনি কি রায় লিখছেন?’’-- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি এমনিতেই তোপের মুখে আছি, নানা ধরনের কথা হচ্ছে। সুতরাং, আর কোনো বিষয়ে কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ’’
তবে বিশ্বস্ত একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানান, এবিএম খায়রুল হক রায়টি এখনো লিখছেন।
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আমি মনে করি, যখনই যে মামলার রায় হয়, তখনই সে মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় বের হয়ে যাওয়া উচিত। হয়তো ৭ থেকে ১০ দিন লাগতে পারে লেখার কাজে। কিন্তু যখন যে মামলার রায় হয়, তখন যদি সে মামলার রায়টা পূর্ণাঙ্গভাবে বের হয় তাহলে সেটা মানুষের মধ্যে এর প্রভাবটা হয় বেশি। ’’
তিনি বলেন, ‘‘ফতোয়ার সঙ্গে যারা তৃণমূল পর্যায়ে জড়িত তারা এ বিষয়ে সচেতন নন, কিংবা সচেতন হতে উদ্যোগীও নন। সরকার যদি স্থানীয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে একই সঙ্গে দায়িত্বশীল এবং সচেতন করতে পারে তাহলে ফতোয়ার হার অনেক কমে যাবে। বাংলাদেশে অনেক ভালো আইন আছে। কিন্তু তার কোনো প্রয়োগ নেই, তাই কাজ হয় না। ’’
অন্যদিকে এসব ফতোয়াবাজি নিরসনে স্থানীয় প্রশাসন ও থানা প্রশাসন পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো সালিশকারী ফতোয়াবাজদের সহায়তা করছে এবং শেষ পর্যন্ত আদালতকেই হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নে সংঘটিত ফতোয়াবাজির নামে এক নারী নির্যাতনের ঘটনায় মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও সালিশকারী ইউপি সদস্যকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। আদালত এ ব্যাপারে রুল জারি ছাড়াও নির্যাতিতা ওই নারীর নিরাপত্তা প্রদান, তিনি মামলা করলে তা গ্রহণ আর না করলে পুলিশ নিজে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে আসামিদের গ্রেফতারেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
জানা গেছে, খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুর রশিদ পণ্ডিত বাড়ির বাসিন্দা প্রবাসী আনোয়ার ইসলামের স্ত্রী আসমা আক্তারের সঙ্গে তার প্রতিবেশীদের দীর্ঘদিন ধরে কলহ চলছিল। গত ২৭ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে একই বাড়ির বাসিন্দা নুরুল আফছার (৪৮), আবদুল্লাহ (৫০), আবুল কাশেম (৩৮) ও নুর নবী (৪৫) তাকে ধরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে উঠোনে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর অন্য প্রতিবেশীরা এসে তাকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় যৌন হয়রানির মামলা করেন আসমা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও কোনো ভূমিকা না রেখে উল্টো তাকে একঘরে করে রাখায় স্থানীয় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাহফুজুল হক ওরফে জুনু মেম্বারকেও (৫০) মামলার আসামি করেন তিনি।
এ ঘটনায় গত ২ অক্টোবর ওয়ার্ডের মসজিদিয়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় এক সালিশের আয়োজন করেন জুনু মেম্বার। শতাধিক মানুষের উপস্থিতিতে তিনি ফতোয়া দেন, আসমাকে বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। নির্যাতনের শিকার আসমা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ওই ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। শুনানি শেষে মঙ্গলবার হাইকোর্ট উল্লেখিত আদেশ দেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১২
জেএ/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]